ইসলামে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) এর বিধান
[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]
সংকলন : মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম
গ্রন্থনা ও পরিমার্জনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
2011 - 1432
﴿ أحكام التسويق الشبكي في الفقه الإسلامي ﴾
« باللغة البنغالية »
جمع وتأليف: محمد تاج الإسلام
ترتيب وتصحيح مع الإضافة: د. محمد منظور إلهي
مراجعة: د. أبو بكر محمد زكريا
2011 - 1432
ইসলামে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) এর বিধান
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) বা বহুজাত বিশিষ্ট পণ্য বাজারজাত পদ্ধতি বাংলাদেশে নতুন হলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অর্ধ শতকের বেশি সময় আগে এটি চালু হয়েছিল। নেটওয়ার্ক মার্কেটিং, ডিরেক্ট সেলিং ও রেফারেন্স মার্কেটিং হিসাবেও এটি পরিচিত। মাল্টিলেভেল মার্কেটিং মূলত ডিস্ট্রিবিউটরদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি করার একটি প্রক্রিয়া। আধুনিক অভিধানে এর সংজ্ঞা এভাবে দেয়া হয় : (Multi-level marketing, also known as MLM or network marketing, is a business
structure where products are sold through a networking process as opposed to a
storefront. ... is a way of selling goods and services through distributors) অর্থাৎ 'মাল্টি লেভেল মর্কেটিং যা এএলএম বা নেটওয়ার্ক মার্কেটিং নামেও পরিচিত, তা হল একটা ব্যবসায় পদ্ধতি যেখানে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করা হয় ... আর তা মূলত ডিস্ট্রিবিউটরদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রি করার একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ায় আপলাইন ও ডাউনলাইন নামে বহু স্তরের (Multi level) ডিস্ট্রিবিউটর তৈরি হয়। ডাউনলাইনের কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বিক্রিত পণ্যদ্রব্যের একটি কমিশন আপলাইনের ডিস্ট্রিবিউটররা পেয়ে থাকে। একে সংক্ষেপে MLM বলা হয়। যেসব দেশে এ ব্যবসা প্রচলিত রয়েছে সেখানে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো আইন না থাকায় তা এখনও চালু রয়েছে। ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বোচ্চ বিকাশের কারণে অনেকাংশেই ব্যবসাটি বহাল রয়েছে। কিন্তু সেসব দেশের সচেতন মহল প্রতিনিয়তই জনগণকে এ ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে নিরুৎসাহিত করছে।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোর অন্যতম। এ দেশে যেমনি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি তেমনি বেকার লোকের সংখ্যাও কম নয়। শতকরা ৬৫ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে দরিদ্র ও বেকারদের অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে এমএলএম ব্যবসায়। কিন্তু যেহেতু এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী সেহেতু মু'মিনদের অন্তরে একটি সংশয় রয়েই যাচ্ছে যে এ ব্যবসাটি শরী'আতের সাথে সংগতিপূর্ণ কিনা? আমরা আমাদের এ প্রবন্ধে সে দিকটিই তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো ইনশাআল্লাহ।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর শরয়ী বিধান :
মাল্টিলেভেল মার্কেটিং-এর শরয়ী বিধান আলোচনা করার পূর্বে ইসলামি শরী'আতের কতিপয় বিধান ও নীতিমালা যেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা ও লেনদেনের বৈধতা-অবৈধতা নির্ভর করে সেগুলো আলোচনা করা দরকার। নিম্নে সংক্ষেপে তা আলোকপাত করা হলো:
(ক) ইসলামি শরী'আতে হালাল ও হারাম উভয়টিই সুস্পষ্ট। শরী'আত যেটা হালাল করেছে সেটাকে হারাম করা বা ঘোষণা দেয়া আবার যেটা হারাম করেছে সেটাকে হালাল ঘোষণা দেয়ার অধিকার আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারও জন্য প্রযোজ্য নয়। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ এ ব্যাপারে সীমালঙ্ঘনকারীদের সাবধান করে ঘোষণা দিয়েছেন,
﴿قُلۡ أَرَءَيۡتُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ لَكُم مِّن رِّزۡقٖ فَجَعَلۡتُم مِّنۡهُ حَرَامٗا وَحَلَٰلٗا قُلۡ ءَآللَّهُ أَذِنَ لَكُمۡۖ أَمۡ عَلَى ٱللَّهِ تَفۡتَرُونَ ٥٩﴾ [يونس: 59]
''তুমি বল, তোমরা কি কখনো এ কথা চিন্তা করে দেখেছ, আল্লাহ্ তা'আলা তোমাদের জন্য যে রিযক নাযিল করেছেন তার মধ্য থেকে কিছু অংশকে তোমরা হারাম আর কিছু অংশকে হালাল করে নিয়েছ; তুমি বল, এসব হালাল-হারামের ব্যাপারে আল্লাহ তোমাদের কোনো অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহ্র প্রতি মিথ্যা আরোপ করছ? [সূরা ইউনুস, আয়াত : ৫৯]
(খ) ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি হলো তা বৈধ ও অনুমোদিত।[1] সুতরাং যে ব্যবসার ক্ষেত্রে শরী'আতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেগুলো ছাড়া অন্য সকল ব্যবসা বৈধ। কোনো ব্যবসাকে হারাম সাব্যস্ত করতে হলে এর পক্ষে শরয়ী নিষেধাজ্ঞা থাকতে হবে। কোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে শরয়ী নিষেধাজ্ঞা না থাকলে ধরে নিতে হবে তা হালাল ও অনুমোদিত।
(গ) ইসলামি শরী'আত যা যা হালাল করেছে এবং যা যা হারাম করেছে তা সম্পূর্ণ ইনসাফের ভিত্তিতে করেছে। যার মধ্যে মানুষের কল্যাণ রয়েছে শরী'আত প্রণেতা শুধু তাই তাদের জন্য হালাল করেছেন এবং যার মধ্যে তাদের অকল্যাণ রয়েছে তাই তাদের জন্য হারাম করেছেন। আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে হালালের কল্যাণ এবং হারামের অকল্যাণ বুঝে আসুক বা না আসুক তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানের দাবি। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন,
﴿وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡخَبَٰٓئِثَ وَيَضَعُ عَنۡهُمۡ إِصۡرَهُمۡ وَٱلۡأَغۡلَٰلَ ٱلَّتِي كَانَتۡ عَلَيۡهِمۡۚ﴾ [الأعراف: 157]
''যে তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করে; আর যে মুক্ত করে তাদেরকে তাদের গুরুভার ও শৃংখল হতে, যা তাদের ওপর ছিল।'' [সূরা আল-আ'রাফ, আয়াত : ১৫৭]।
(ঘ) ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতি ও আন্তরিক সন্তুষ্টি থাকা। বেচা-কেনা বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য একটি শর্ত হলো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি ও সন্তুষ্টি। মহান আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে এ মর্মে ঘোষণা করেছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ﴾ [النساء: 29]
''হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাযী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ'' [সূরা আন-নিসা : ২৯]।
তবে সম্মতি ও সন্তুষ্টি বলতে সব ধরনের সম্মতি ও সন্তুষ্টিই এখানে উদ্দেশ্য নয়। বরং হাদীস থেকে জানা যায় এখানে সম্মতি ও সন্তুষ্টি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বেচা-কেনার ক্ষেত্রে শরী'আত যে সকল নীতিমালা নির্ধারণ করেছে সেগুলোর আওতায় থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি ও আন্তরিক সন্তুষ্টি থাকা। কাজেই শরী'আত অসংগত কোনো বিষয়ে কারও পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি ও সম্মতি থাকলেও সেটা ইসলামি শরী'আতের বিচারে হালাল ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত হবে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, মদ ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর যদি ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে সম্মতি ও আন্তরিক সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তথাপি তা বৈধ হবে না। কারণ মদটাকে ইসলাম হারাম করেছে। অনুরূপ সুদের কারবার যদি কেউ সন্তুষ্টচিত্তে করে তথাপি তা বৈধ হবে না। কারণ ইসলাম সুদকে হারাম করেছে। আবার ব্যবসার ক্ষেত্রে যদি প্রতারণা ও ধোঁকার আশ্রয় নেয়া হয় তবে সেখানেও ক্রেতা-বিক্রেতার সম্মতি ও আন্তরিক সন্তুষ্টি সেটাকে বৈধ করতে পারে না। কারণ ইসলাম প্রতারণাকে হারাম করেছে।
আমরা আমাদের এ প্রবন্ধে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর বৈধতা-অবৈধতার বিষয়টি দু'টি দিক থেকে আলোচনা করবো ইনশাআল্লাহ্।
প্রথমত : ভিত্তিগত (substantive and theoretical)
দ্বিতীয়ত : পদ্ধতিগত (procedural)
ভিত্তিগত দিক : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর পদ্ধতি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের হলেও তত্ত্বগত ভিত্তিটি (theoretical basis) সবসময় একই। তা হলো, নিম্ন লেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর কর্তৃক বিক্রিত পণ্যের একটি কমিশন সর্বোচ্চ লেভেল পর্যন্ত পায়। যেটাকে এক কথায় 'শ্রমের বহুস্তর সুবিধা' বলা যায়। কোনো কোনো লেখক এর নাম দিয়েছেন ''Chain reaction of labour'', কেউবা আবার ব্যক্ত করেছেন ''Chain pyramidal commission'' কিংবা ''Compound brokerage'' ইত্যাদি নামে। তাদের এ নীতিটির সাথে ইসলামের শ্রমনীতির রয়েছে সরাসরি সংঘর্ষ। কারণ ইসলামের শ্রমনীতি হলো,
﴿أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰ ٣٨ وَأَن لَّيۡسَ لِلۡإِنسَٰنِ إِلَّا مَا سَعَىٰ ٣٩﴾[النجم: 38-39]
''কোনো মানুষই অপরের বোঝা উঠাবে না। মানুষ ততটুকুই পাবে যতটুকু সে চেষ্টা করে'' [সূরা আন-নাজম, আয়াত : ৩৮-৩৯]। এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, মানুষ কেবল তার নিজের শ্রমের প্রত্যক্ষ ফল লাভের অধিকারী। কারও নিযুক্ত কর্মী না হলে একজন আরেকজনের শ্রমের ফলে অংশীদার হতে পারে না। একইভাবে মানুষ তার শ্রমের ফল কেবল নিকটবর্তী লেভেল থেকে আশা করতে পারে। কোনো ক্রমেই তা বহুস্তর (multi level) পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না। এটি যেমন ইসলামি শ্রমনীতির সাথে অসংগতিপূর্ণ তেমনি মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনায় অস্বীকৃত। কারণ, এ ব্যবসায় এক পর্যায়ে দেখা যায় নিম্নলেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর ফরিদপুরের মাসুদ উচ্চলেভেলের ডিস্ট্রিবিউটর বরিশালের নোমানকে চিনে না, তাদের সাথে কোনো যোগাযোগ ও কথা-বার্তা নেই অথচ নিম্নলেভেলের মাসুদ থেকে উচ্চলেভেলের নোমান কমিশন পাচ্ছে। মানবীয় সুস্থ বিবেক বলছে, কোনো পণ্যের পেছনে যে প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়েছে কেবলমাত্র সেই পারিশ্রমিক পেতে বাধ্য। কিন্তু যে পরোক্ষ শ্রম দিয়েছে সে পারিশ্রমিক পেতে বাধ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন শিক্ষক সে তার প্রত্যক্ষ শ্রমের ফল হিসেবে বেতন দাবি করতে পারে। কিন্তু সে যদি দাবি করে, তার ছাত্ররা যত জনকে শিক্ষিত করে কর্মক্ষম করে তুলবে এবং ভবিষ্যতে তারা আরও যাদেরকে শিক্ষিত করে তুলবে তাদের প্রত্যেকের আয়ের একটি ক্ষুদ্র অংশ উর্ধবতন শিক্ষককে কমিশন হিসেবে দিতে হবে তাহলে বিষয়টি মেনে নেয়ার মত নয়। কারণ এখানে শিক্ষকের শ্রম শুধু তার সরাসরি ছাত্রদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তার ছাত্রদের ছাত্র বা তাদের ছাত্রের প্রতি তাঁর কোনো শ্রম নেই। তার শ্রমের ভিত্তিতে সরাসরি তার ছাত্রদের কাছ থেকে সে বেতন বা সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখে কিন্তু ডাউনলাইনের ছাত্রদের কাছ থেকে সে কিসের ভিত্তিতে কমিশন বা বেতন ভোগ করবে?
সুতরাং ইসলামি শ্রমনীতি ও মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনায় শ্রমের বহুস্তর সুবিধা (multi level benefit of labour) নীতিটি শরী'আত সম্মত হতে পারে না। অথচ এ নীতিটিই মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক ভিত্তি। এ ভিত্তি সরিয়ে ফেললে এ প্রকার ব্যবসার অস্তিত্বই থাকবে না। কোনো সাধারণ কোম্পানি থেকে পণ্য কিনে অপরজনের কাছে বিক্রির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার বৈধ অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে। অনুরূপ কোনো ক্রেতা সংগ্রহ করে দেয়ার মাধ্যমে কোম্পানির কাছ থেকে দালালীর কমিশন (brokerage fee) নেয়ার অধিকারও প্রত্যেকের রয়েছে। কারণ এ উভয় ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ শ্রম জড়িয়ে আছে। এ প্রত্যক্ষ শ্রমের প্রত্যক্ষ সুবিধা নিকটতম স্তর থেকে একবারই পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট ভ্যালুর পণ্য কিনে দালালীর অধিকার অর্জন করা যা বাস্তবায়ন করতে প্রত্যক্ষ শ্রম দিয়ে নতুন ক্রেতা সংগ্রহ করতে হয়। যে যত বেশি ক্রেতা সংগ্রহ করতে পারে সে ততজনের কমিশন লাভ করার অধিকার রাখে। কিন্তু কোনো ক্রমেই আপলেভেলের প্রত্যক্ষ শ্রম স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সুদূর-বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না। অথচ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ তা-ই ঘটে।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, প্রত্যেক ব্যক্তির আয় ও দায় (income and liability) সবসময় ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। তবে এ স্বাভাবিক নীতির ব্যতিক্রম যে সকল বৈধতা শরী'আতে পাওয়া যায় তা শরী'আতের বিধান হিসেবে সমালোচনার উর্ধ্বে। যেমন ধনীর সম্পদে অভাবী মানুষের অধিকার, সদকায়ে জারিয়ার সাওয়াব, গোনাহে জারিয়া ইত্যাদি। এগুলো শরী'আত প্রণেতা কর্তৃক গৃহীত। কাজেই তা স্বাভাবিক নিয়ম বহির্ভূত।
পদ্ধতিগত দিক : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর তাত্ত্বিক ভিত্তি (Theoretical Basis)-এর সাথে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত শ্রমনীতি ও মানবীয় বুদ্ধি বিবেচনার সাংঘর্ষিক দিকটি আলোচনা করার পর এবার আমরা এর কিছু পদ্ধতিগত সংঘাত নিয়ে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ্।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা নেটওয়ার্ক-এর পদ্ধতিসমূহের মধ্যে শরী'আত নিষিদ্ধ বহু বিষয় বিদ্যমান। যার প্রধানগুলো নিম্নরূপ :
1. শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম (الأجرة بلا عمل والعمل بلا أجرة)
2. একটি আকদ (চুক্তি)-এর জন্য আরেকটিকে শর্ত করা (جمع الصفقتين في صفقة)
3. অর্জিত হওয়া না-হওয়ার অনিশ্চয়তা (الغرر)
4. সুদের সাদৃশ্য ও দৃঢ় সন্দেহ (شبهة الربا)
5. জুয়ার সাদৃশ্য (شبهة الميسر)
6. বাতিল পন্থায় মানুষের মাল ভক্ষণ (أكل أموال الناس بالباطل)
7. প্রতারণা ও ধোঁকা (الغش)
8. বর্ধিত মূল্যে বিক্রয় (البيع بالسعر الغالي)
9. 'আকদুল ইজারাহ'-এর উসূল পরিপন্থী (خلاف أصول عقد الإجارة)
নিম্নে প্রতিটির বিস্তারিত আলোকপাত করা হলো :
(ক) শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম (الأجرة بلا عمل والعمل بلا أجرة) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং পদ্ধতি শরী'আতের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো এতে 'শ্রমবিহীন বিনিময় এবং বিনিময়বিহীন শ্রম' রয়েছে যা ইসলামি আইন সমর্থন করে না।
বিনিময়বিহীন শ্রমের বিষয়টি ফুটে উঠে তাদের প্রচলিত সে নীতিতে যাতে রয়েছে, একজন ডিস্ট্রিবিউটর (পরিবেশক)-এর ডান ও বাম উভয় দিকের নেট না চললে সে কমিশন পাবে না। অর্থাৎ কেউ যদি নির্ধারিত পয়েন্টের একজন ক্রেতা জোগাড় করে কিন্তু আরেকজন জোগাড় করতে অক্ষম হয়, তবে লোকটি কমিশন থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হবে। এমনিভাবে কেউ যদি দু'জন ক্রেতাও কোম্পানিকে এনে দেয়, কিন্তু তারা কোম্পানির নির্ধারিত পয়েন্ট থেকে কম পয়েন্টের মালামাল ক্রয় করে তবে এর জন্যও ঐ ব্যক্তি কমিশন পায় না। ফলে এটি বিনিময়বিহীন শ্রমে পরিণত হয় যা ইসলামি আইনে নিষিদ্ধ। হাদীসে কুদসীতে রয়েছে, আল্লাহ্ তা'আলা বলেন,
« ثَلاثَةٌ أَنَا خَصْمُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ رَجُلٌ أَعْطَى بِي ثُمَّ غَدَرَ وَرَجُلٌ بَاعَ حُرًّا فَأَكَلَ ثَمَنَهُ وَرَجُلٌ اسْتَأْجَرَ أَجِيرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِ أَجْرَهُ »
''কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির সাথে ঝগড়া করবো। (এক) যে ব্যক্তি আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে। (দুই) যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রয় করে তার মূল্য ভোগ করে এবং (তিন) যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিককে কাজে নিযুক্ত করে তার কাছ থেকে কাজ আদায় করার পর মজুরী পরিশোধ করে না'' [সহীহ বুখারী : ২২২৭]।
ইসলামি শরী'আতে 'একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ করতে না পারলে পারিশ্রমিক পাবে না' এ ধরনের শর্ত দিয়ে কোনো চুক্তি করা বৈধ নয়। আল্লামা ইবন রুশদ তার 'আল-মুকাদ্দামাত' গ্রন্থে বলেছেন, ''কাপড়ের নির্দিষ্ট সংখ্যার ওপর এ চুক্তি করে লোক নিয়োগ দেয়া যে, 'কাপড়ের এত সংখ্যক বিক্রয় করতে না পারলে সে কোনো পারিশ্রমিক পাবে না' তাহলে চুক্তিটি বৈধ হবে না। কারণ এরূপ ক্ষেত্রে নিয়োগদাতা কর্মচারীর অল্প সংখ্যক বিক্রয় দ্বারা যে উপকৃত হচ্ছে তা তার জন্য বৈধ হবে না।'' [২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০৯]
আর শ্রমবিহীন বিনিময়টি সুন্দরভাবে ফুটে উঠে তাদের ভিত্তিগত দিকে যা ইতোপূর্বে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, তাদের নীতিমালা রয়েছে, কোনো ব্যক্তি নির্ধারিত পরিমাণ পণ্য খরিদান্তে ডিস্ট্রিবিউটর (পরিবেশেক) হওয়ার পর যদি সে দু'জন ক্রেতা নিয়ে আসে এবং তারা প্রত্যেকে আরও দু'জনকে এবং সে চার জন আরও আটজনকে কোম্পানির সাথে যুক্ত করে, তবে প্রথম ব্যক্তি এবং দ্বিতীয় লেভেলের দু'ব্যক্তি নিম্ন লেভেলের আট ব্যক্তি ক্রেতা-পরিবেশকের সুবাদেও কোম্পানি থেকে কমিশন পেয়ে থাকে। অথচ এ আটজনের কাউকেই প্রথম ব্যক্তি ও দ্বিতীয় লেভেলের দু'ব্যক্তি কোম্পনির সাথে যুক্ত করে নি; বরং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর নীতি অনুযায়ী এরা কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে তাদের সরাসরি ওপরের ব্যক্তির রেফারেন্সে এবং এর জন্য ঐ ব্যক্তি নির্ধারিত হারে কমিশনও পাবে। এটি সুস্পষ্টই শ্রমবিহীন বিনিময় যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, তাদের এ কারবারে বিনিময়বিহীন শ্রম ও শ্রমবিহীন বিনিময় দু'টিই পুরোপুরিভাবে বিদ্যমান রয়েছে যা শরী'আতের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
(খ) একটি আকদ (চুক্তি)-এর জন্য আরেকটিকে শর্ত করা (جمع الصفقتين في صفقة) : মাল্টি লেভেল নেটওয়াকিং বৈধ না হওয়ার আরও একটি অন্যতম কারণ হলো এতে হাদীসে নিষিদ্ধ 'একই চুক্তির জন্য আরেকটিকে শর্ত করা'-এর বিষয়টি রয়েছে। কারণ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ পণ্য ক্রয়ের শর্তেই শুধু ডিস্ট্রিবিউটর হওয়া যায়। অর্থাৎ কোম্পানি থেকে পণ্য ক্রয় ছাড়া ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে এখানে পণ্য ক্রয়কে ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার জন্য শর্ত করা হচ্ছে, যা হাদীসে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« لاَ تَحِلُّ صَفْقَتَانِ فِيْ صَفْقَةٍ »
''একই আকদের জন্য আরেকটিকে শর্ত করা হালাল নয়'' [তবারানী : ১৬১০]।
অপর এক হাদীসে রয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন,
نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ صَفْقَتَيْنِ فِي صَفْقَةٍ وَاحِدَةٍ
''রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একই আকদে (চুক্তিতে) দু'টি আকদ (চুক্তি) করতে নিষেধ করেছেন'' [মুসনাদ আহমাদ : ৩৭৮৩]।
এ প্রকারের বেচা-কেনা সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন,
صَفْقَتَانِ فِيْ صَفْقَةٍ رِبًا
''একটি আকদ (চুক্তি)-এর জন্য আরেকটিকে শর্ত করা সুদী কারবার।'' [সহীহ ইবন হিব্বান : ১০৫৩]
ইমাম শাফিঈ রহ. এ ধরনের হাদীসের দু'টি ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন,
এক. বিক্রেতা বলল, আমি এ পণ্যটি তোমার নিকট নগদে বিক্রি করলে এত টাকায় বিক্রি করব আর বাকিতে বিক্রি করলে এত টাকায় বিক্রি করবো। অর্থাৎ নগদে কিনলে মূল্য কম ধরা হবে।
দুই. বিক্রেতা বলল, আমি তোমার নিকট এটি ধরা যাক একশত টাকায় বিক্রি করছি, তবে শর্ত হলো আমার নিকট তোমার ঘরটি এত টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতে হবে।
ইসলামিক স্কলারদের সর্বসম্মতিক্রমে এ দু'প্রকারের লেনদেনই বাতিল ও অবৈধ। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এর পদ্ধতি ইমাম শাফিঈর ব্যাখ্যার দ্বিতীয়টির সাথে মিলে যায়। কারণ তারা ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার জন্য পণ্য ক্রয়কে শর্ত করে থাকে। যা আকদের ওপর আকদের নামান্তর।
কোনো কোনো মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি উপরোক্ত শরয়ী সমস্যা এড়ানোর জন্য দু'টি পৃথক ফরমের ব্যবস্থা করেছে। একটি পণ্য ক্রয়ের অর্ডার ফরম, অন্যটি ডিস্ট্রিবিউটরশীপের আবেদন ফরম। তারা বুঝাতে চেয়েছে, এখানে পৃথক দু'টি চুক্তি হচ্ছে। অথচ মূলত কার্যক্ষেত্রে একটি চুক্তির জন্য অন্যটি এখনও জরুরি। অর্থাৎ পণ্য-ক্রয় ছাড়া ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া দুই ফরমবিশিষ্ট এ ধরনের কোম্পানির নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, ''আপনি কি জানেন যে, নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য ক্রয় ছাড়া এখানে ডিস্ট্রিবিউটর হবার কোন সুযোগ নেই?'' [ডেসটিনি-২০০০ লিমিডেট, বিক্রয় ও বিপনন পদ্ধতি, পৃষ্ঠা : ২৬] এমনকি এ সকল কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ ফরমেও বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে এসেছে। আবার ডিস্ট্রিবিউটর হওয়ার জন্য পণ্য ক্রয়ের শর্তের কথাতো দুই ফরমধারীগণও অস্বীকার করেন না; বরং তারা তো ডিস্ট্রিবিউটরদেরকে 'ক্রেতা ডিস্ট্রিবিউটর' নামেই উল্লেখ করেন।
সুতরাং দুই ফরমের ব্যবস্থা করায় ব্যবসাটি উপরোক্ত হাদীসের নিষেধাজ্ঞা থেকে বের হয়ে যায় নি, বরং যথারীতি আগের অবস্থাতেই বহাল আছে যা শরী'আতে নিষিদ্ধ।
(গ) হাসিল হওয়া না-হওয়ার অনিশ্চয়তা (الغرر) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং অবৈধ হওয়ার আরো একটি কারণ হলো তাতে হাদীসে নিষিদ্ধ الغرر (হাসিল হওয়া না-হওয়ার অনিশ্চয়তা) রয়েছে। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,
«نَهَى رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَنْ بَيْعِ الْحَصَاةِ وَعَنْ بَيْعِ الْغَرَرِ»
রাসূলুল্লাহ স. নুড়ি পাথর নিক্ষেপ করে ক্রয়-বিক্রয় সাব্যস্ত করা এবং বাইয়ুল গারার (অনিশ্চিত ক্রয়-বিক্রয় করা) থেকে বারণ করেছেন। [সহীহ মুসলিম : ৩৮৮১]
বাইয়ুল গারারের সংজ্ঞা : ইসলামি পণ্ডিতগণ বাইয়ুল গারার -এর সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে প্রদান করেছেন। নিম্নে তা প্রদত্ত হলো :
(ক) আল্লামা কাসানী রাহ. বলেন, ''গারার হচ্ছে এমন একটি অনিশ্চয়তা, যাতে হওয়া এবং না-হওয়া উভয় দিক বিদ্যমান।'' [বাদায়ে'উস সানায়ে'উ, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৩৬৬]
(খ) আল্লামা ইবনুল আসীর জাযারী রাহ. বলেন, ''যার এমন একটি প্রকাশ্য রূপ রয়েছে যা দ্বারা মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হয়; কিন্তু এমন অদৃশ্য কারণ রয়েছে যে কারণে তা অস্পষ্ট। এর প্রকাশ্য রূপ ক্রেতাকে ধোঁকায় ফেলে। আর এর ভিতরের রূপ অজানা'' [জামেউল উসূল, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫২৭]
(গ) আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, ''বাইয়ুল গারার ঐ কারবারকে বলা হয় যাতে পণ্য বা সেবা পাওয়া যাবে কিনা তা অনিশ্চিত অথবা চুক্তিভুক্ত ব্যক্তি নিজে তা যোগান দিতে অক্ষম অথবা যারা পরিণাম অজানা'' [যাদুল মা'আদ, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৭২৫]।
(ঘ) কারো কারো মতে, বাইয়ুল গারার হলো, ''যে কোনো কারবারের চুক্তির মধ্যে অনিশ্চয়তা।'' যেমন, পুকুরে বা নদীতে মাছ কেনা-বেচা, আকাশে উড়ন্ত পাখি বেচা-কেনা ইত্যাদি।
মোটকথা, যাতে হাসিল হওয়া বা না-হওয়ার অনিশ্চয়তা রয়েছে তাই হচ্ছে আল-গারার। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী যে ব্যবসায় এ গারার পাওয়া যাবে তা অবৈধ ও নাজায়িয। আল্লামা ইবন কুদামাহ তার 'আশ-শারহুল কাবীর' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইবরাহীম হারবীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, কোনো লোক যদি এ শর্তে মোরগ ভাড়া নিতে চায় যে, এ মোরগ তাকে সালাতের সময় ঘুম থেকে জাগাবে তবে এ ধরনের কারবার জায়িয হবে কি না? তিনি উত্তর দিলেন, না। কারণ এটি অনিশ্চিত কারবার। হতে পারে কখনো কখনো মোরগ ডাকবে না, আবার কখনো সালাতের সময়ের আগে ডাকবে বা পরে ডাকবে, আবার কখনো হয়তো তার মুখ থেকে ডাক বের করার জন্য প্রহারের প্রয়োজন হবে ইত্যাদি। সুতরাং নানাবিদ অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা থাকায় এ ধরনের চুক্তি জায়িয নেই। [খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ৩১৯]
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির পদ্ধতির দিকে তাকালে অনুমেয় হয় যে, সেখানে বহু পদ্ধতিতে গারারের উপস্থিতি রয়েছে। একজন ডিস্ট্রিবিউটর যে চুক্তিতে কোম্পানির সাথে যুক্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো, লোকটি তার ডাউনলাইন থেকে কমিশন লাভ করতে থাকবে। অথচ তার নিজের বানানো দু'জন ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের বিষয়টি সম্পূর্ণই অনিশ্চিত এবং অন্যের কাজের ওপর নির্ভরশীল। কারণ তার নিম্নের নেটগুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অগ্রসর না করলে লোকটি কমিশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে; যে কমিশনকে কেন্দ্র করেই সে মূলত এ মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়েছে।
কোনো কোনো মাল্টি লেভেল কোম্পানিতে 'ট্রি প্লান্টেশন' নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। বছরখানেক আগে এ প্রতারণা নিয়ে পত্রিকায় ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। ৮০০০ (আট হাজার) টাকা নিয়ে ১২ বছর পর ৩০,০০০ (ত্রিশ হাজার) টাকা অথবা সমপরিমাণ অর্থের গাছ প্রদানের অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করা হয়। গাছ লাগানোর জন্য আদৌ কোনো জায়গা ক্রয়া করা হয়েছে কি না বা কতজন গাছ লাগানোর জন্য টাকা দিয়েছে— এসব বিষয়ে একটা অস্পষ্টতা থেকেই যাচ্ছে। এ সকল অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতার কারণে ইসলামি শরী'আত এ লেনদেনকে বৈধ সাব্যস্ত করে না।
(ঘ) সুদের সাদৃশ্য ও দৃঢ় সন্দেহ (شبهة الربا) : মাল্টি লেভেল মার্কেটিং হালাল না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এতে শরী'আত নিষিদ্ধ সুদের সাদৃশ্য ও সন্দেহ বিদ্যমান। ইসলামি আইন অনুযায়ী যে সকল কারবারে সুদের সাদৃশ্য ও সন্দেহ রয়েছে তা না জায়িয। ইসলামি আইনবিদগণ এ কারণে বহু কারবারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কারণ রাসূলুল্লাহ স. বলেছেন,
«الْحَلالُ بَيِّنٌ وَالْحَرَامُ بَيِّنٌ وَبَيْنَهُمَا مُشْتَبِهَاتٌ لاَ يَعْلَمُهُنَّ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ ، فَمَنِ اتَّقَى الشُّبُهَاتِ اسْتَبْرَأَ لِدِينِهِ وَعِرْضِهِ ، وَمَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الْحَرَامِ»
''হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট। এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে সন্দেহ ও সাদৃশ্য বিষয় যা অধিকাংশ মানুষই জানে না। কাজেই যে সাদৃশ্য ও সন্দেহ থেকে বেঁচে থাকে সে নিজের দ্বীন ও ইজ্জত রক্ষা করল। আর তাতে জড়ালো সে হারামে নিপতিত হলো'' [সহীহ বুখারী : ৫২]।
অপর এক হাদীসে এসেছে,
«دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَالا يَرِيبُكَ»
''তোমাকে যা সন্দেহে ফেলে তা ছেড়ে তুমি নিশ্চিত জিনিসের দিকে ধাবিত হও।'' [সুনান তিরমিযী : ২৫১৮, হাদীসটি সহীহ]
ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
إِنَّ آخِرَ مَا نَزَلَ مِنْ الْقُرْآنِ آيَةُ الرِّبَا وَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُبِضَ وَلَمْ يُفَسِّرْهَا فَدَعُوا الرِّبَا وَالرِّيبَةَ
''কুরআনের সর্বশেষ আয়াত হচ্ছে রিবা (সুদ)-এর আয়াত। রাসূলুল্লাহ স.-এর মৃত্যু হয়ে গিয়েছে কিন্তু তিনি সুদের আয়াতের ব্যাখ্যা দেন নি। কাজেই তোমরা সুদ এবং এমন জিনিস যাতে সুদের সন্দেহ রয়েছে তা বর্জন করো'' [মিশকাত : ২৮৩০, সুনান ইবন মাজাহ : ২৪৭, হাদীসটি সহীহ]।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘোষণা হলো, যেহেতু রাসূলুল্লাহ স. রিবার আয়াতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে যান নি সেহেতু যাতে সরাসরি রিবা রয়েছে তাতো বর্জন করতেই হবে পাশাপাশি যাতে রিবার সন্দেহ ও সাদৃশ্য রয়েছে তাও বর্জন করতে হবে।
মাল্টি লেভেল মার্কেটিং-এ সুদের সাদৃশ্য-এর বিবরণ এভাবে দেয়া যায় যে, এসব কোম্পানিগুলোতে ডিস্ট্রিবিউটররা পণ্য ক্রয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ হয় কমিশন পাওয়ার আশায়। এতে বুঝা যায়, সে পণ্য ক্রয় বাবদ যে টাকাটি দিয়েছে তা শুধু ঐ পণ্যের মূল্য হিসেবেই দেইনি বরং তা দেয়ার পেছনে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ডাউনলাইনদের কাছ থেকে কমিশন ভোগ করা। পণ্যের মূল্য প্রদানের পাশাপশি কমিশনের যে সুযোগের আশায় সে এ কারবারটি করছে তাই ইসলামি শরী'আতের পরিভাষায় সুদের সাদৃশ্য।