Articles

নিয়ত: একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা





মু. সাইফুল ইসলাম





সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া





সূচিপত্র





১. শব্দ-বিশ্লেষণ. 3





২. শরী‘আতের দৃষ্টিতে নিয়ত ও তার প্রকারভেদ. 5





৩. নিয়তের শর‘ঈ বিধান. 6





৪. নিয়তের উদ্দেশ্য.. 7





৫. নিয়ত: প্রসঙ্গ আল-কুরআন. 8





৬. নিয়ত: প্রসঙ্গ আল-হাদীস. 24





সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............





‘নিয়ত: একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা’ এতে নিয়তের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ, বিধান, গুরুত্ব ও ফযীলত এবং নিয়ত সংক্রান্ত কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কিছু হাদীস উল্লেখ করে নিয়তের সাথে সম্পৃক্ততা বর্ণনা করা হয়েছে।





নিয়ত: একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা





শব্দ-বিশ্লেষণ:





নিয়ত আরবী শব্দ (نية বা نيَّة) অর্থ: اَلْقَصْدُ وَ الْاِرَادَةউদ্দেশ্য, অভিপ্রায়, অভিলাষ, মনোবাঞ্ছা, মনের ঝোঁক, কোনো কিছু করার ইচ্ছা, কোনো কাজের প্রতি মনকে ধাবিত করা ইত্যাদি। ইংরেজিতে বলা হয় Intension[1] ভাষাতত্ত্ববিদদের মতে, মনের মধ্যে কোনো ভাবের উদয় হলে, সে ভাব অনুযায়ী ‘আমল করা কিংবা না করার কোনো দিকেই মন ধাবিত না হলে, মনের ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া সে ভাবকে বলা হয় হাদসুন-নাফস বা ওয়াস্ওয়াসা। আর সে ভাবকে বাস্তবে রূপদানের জন্য মনকে ধাবিত করার নাম ‘হাম্ম’ বা নিয়ত (অভিপ্রায়) এবং মজবুত নিয়তকে বলা হয় ‘আযম তথা সংকল্প।[2] আবার নিয়ত (অভিপ্রায়) এবং ইরাদাহ (ইচ্ছা) শব্দ দু’টি বাহ্যত সমার্থক মনে হলেও এবং কখনো কখনো এক অর্থে ব্যবহৃত হওয়া সত্ত্বেও উভয়ের মাঝে কিছু পার্থক্য রয়েছে। যেমন,





এক. ইরাদাহ (ইচ্ছা)-এর সম্পর্ক নিজের কাজের সাথেই নির্দিষ্ট নয়; বরং অন্যের কাজের সাথেও ইরাদাহ (ইচ্ছা)-এর সম্পর্ক হতে পারে। পক্ষান্তরে নিয়তের সম্পর্ক শুধু নিয়তকারীর কাজের সাথেই হয়ে থাকে। যেমন, এটা বলা চলে যে, “আমি তোমার নিকট এ ধরনের আচরণের ইরাদাহ বা ইচ্ছা (কামনা) করি নি” কিন্তু এভাবে বলা যায় না যে, ‘‘আমি তোমার নিকট এ ধরনের আচরণের নিয়ত বা উদ্দেশ্য করি নি।”





দুই. ইরাদাহ (ইচ্ছা) সম্ভাব্য কাজের ব্যাপারেই কেবল ব্যবহৃত হয়। পক্ষান্তরে নিয়ত শব্দটি সম্ভব-অসম্ভব সকল কাজের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর এজন্যই আল্লাহর ব্যাপারে নিয়ত শব্দের ব্যবহার করা যায় না। যেহেতু তাঁর নিকট সবকিছুই সম্ভব তাই তিনি কোনো কাজ করার ইরাদাহ বা ইচ্ছা করেন, নিয়ত নয়। তবে যেহেতু কখনো কখনো উভয় শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হয় তাই কুরআন মাজীদে অনেক স্থানে আল্লাহ তা‘আলা ইরাদাহ শব্দটিকে নিয়ত অর্থে ব্যবহার করেছেন।[3]





শরী‘আতের দৃষ্টিতে নিয়ত ও তার প্রকারভেদ:





মাওয়ারদী রহ. বলেন:





النية هي قصد الشيء مقترنًا بفعله.





“কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট মনের উদ্দেশ্য।”[4]





কাযী বায়যাভী রহ. বলেন:





النية هي عبارة عن انبعاث القلب نحو ما يراه موافقا لغرض من جلب نفع اودفع ضرر حالا اومالا.





“বর্তমান বা ভবিষ্যতের ভালো কিংবা খারাপ কোনো স্বার্থের জন্য কোনো কাজের প্রতি মনের অভিনিবেশ।”[5]





অর্থাৎ মানুষ কোনো কাজ করার সময় তার মনের অভ্যন্তরে যে উদ্দেশ্য থাকে, যার কারণে মানুষ কাজটি করার জন্য উদ্ভুদ্ধ হয় সে উদ্দেশ্য বা কারণটিকেই শরী‘আতের পরিভাষায় নিয়ত বলা হয়। কোনো ইবাদত করার সময় সে ইবাদতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সংক্রান্ত মনের ভাব বা অবস্থাই নিয়ত। নিয়ত ভালো কিংবা খারাপ উভয়ই হতে পারে। শরী‘আতের দৃষ্টিতে নিয়ত দু’ প্রকার।





এক. ইখলাস, দুই. রিয়া।





যখন কোনো মানুষ আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোনো ইবাদত করে তখন সে ইবাদত সংক্রান্ত মনের ঐ অবস্থাকে ইখলাস বলা হয়। আর কেউ লোক দেখানো বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ইবাদত করলে ইবাদতকালীন মনের সেই অবস্থাকে বলা হয় রিয়া।





নিয়তের শর‘ঈ বিধান:





ইসলামে নিয়তের গুরুত্ব অপরিসীম। সকল ইবাদতের জন্য শুরুতে মনে মনে নিয়ত করে নেওয়া আবশ্যক। নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদতই আদায় হবে না।





নিয়তের উদ্দেশ্য:





নিয়তের দু’টি উদ্দেশ্য থাকে:





এক. ‘আমল বা কাজের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মাঝে পার্থক্য নিরূপণ। অর্থাৎ ‘আমলের উদ্দেশ্য কি লা-শরীক আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি, নাকি সরাসরি আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো সন্তুষ্টি অথবা আল্লাহর সাথে সাথে অন্য কারো সন্তুষ্টিও? -তার পার্থক্য নিরূপণ করা। উদাহরণত: সালাত আদায় করা। নিয়তের মাধ্যমে সহজে এ পার্থক্য নির্ণয় করা যায় যে, বান্দা কি শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর নির্দেশ পালনার্থেই তা আদায় করছে, নাকি তার সালাত আদায়ের পেছনে লোক-দেখানো কিংবা যশ-খ্যাতি পাওয়ার মতো হীন কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে।





দুই. আমল বা ইবাদতের মাঝে পার্থক্য নির্ণয় করা অথবা ইবাদতকে অভ্যাসগত নিত্যকর্ম থেকে পৃথক করা। যেমন, যোহরের সালাতকে আসরের সালাত থেকে পৃথক করা এবং রমযান মাসের সাওমকে অন্য মাসের সাওম থেকে পৃথক করা যায় নিয়তের মাধ্যমে। আবার নিয়তের দ্বারাই অপবিত্রতার গোসলকে অভ্যাসগত পরিচ্ছন্নতা ও শীতলতা লাভের গোসল থেকে ভিন্ন করা যায়।


 নিয়ত: প্রসঙ্গ আল-কুরআন





এক. আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿فَٱعۡبُدِ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ﴾ [الزمر: ٢]





“তুমি আল্লাহর ইবাদত করো তাঁরই জন্য ইবাদতকে বশুদ্ধ করে।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ০২]





তিনি অন্যত্র আরো বলেন:





﴿أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصَُۚ﴾ [الزمر: ٣]





“জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহরই নিমিত্ত।” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ০৩]





উক্ত আয়াতদ্বয়ে দীন (دين) শব্দটি আনুগত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যকে তারই জন্য খাঁটি করুন। যাতে শির্ক, রিয়া ও যশ-খ্যাতির উদ্দেশ্যের নাম-গন্ধও না থাকে। এরই তাগিদার্থে দ্বিতীয় আয়াতে বলা হয়েছে যে, খাঁটি ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই শোভনীয়। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এর যোগ্য নয়। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, ‘আমি মাঝে মাঝে দান-খয়রাত করি অথবা কারো প্রতি অনুগ্রহ করি, এতে আমার নিয়ত আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টিও থাকে এবং এটাও থাকে যে, মানুষ আমার প্রশংসা করুক।’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: সে সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, আল্লাহ তা‘আলা এমন কোনো বস্তু কবূল করেন না, যাতে অন্যকে শরীক করা হয়। অতঃপর তিনি প্রমাণস্বরূপ ﴿أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصَُۚ﴾ [الزمر: ٣] আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন।[6] বস্তুতঃ নিয়তের একনিষ্ঠতা অনুপাতে আল্লাহর নিকট ‘আমল গৃহীত হয়। কুরআনে কারীমের অনেক আয়াত সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহর কাছে ‘আমলের হিসাব গণনা দ্বারা নয় -ওযন দ্বারা হয়ে থাকে। আর ‘আমলের মূল্যায়ন ও ওযন নিষ্ঠাপূর্ণ নিয়তের অনুপাতে হয়ে থাকে এবং পূর্ণ খাঁটি নিয়ত এই যে, আল্লাহ ব্যতীত কাউকে লাভ-লোকসানের মালিক গণ্য করা যাবে না। নিজের কাজকর্মে কাউকে ক্ষমতাশীল মনে করা যাবে না এবং কোনো ইবাদত ও আনুগত্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কল্পনা ও ধ্যান করা যাবে না। যে সাহাবায়ে কেরাম মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রথম সারিতে অবস্থিত, তাদের ‘আমলের পরিমাণ তেমন একটা বেশি দেখা যাবে না। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের সামান্য ‘আমল অবশিষ্ট উম্মতের বড় বড় ‘আমলের চেয়ে উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠ তো তাদের পূর্ণ ঈমান ও পূর্ণ নিষ্ঠার কারণেই ছিল।[7]





ইমাম বুখারী রহ. সহীহ বুখারীর শেষ বাবের শিরোনাম করেছেন:





بَابُ قَوْلِ اللهِ تَعَالَى ﴿وَنَضَعُ ٱلۡمَوَٰزِينَ ٱلۡقِسۡط﴾ [الانبياء: ٤٧]





“অধ্যায় আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ‘আমি ইনসাফের পাল্লা স্থাপন করবো” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৪৭] আল্লাহর এ উক্তি।”[8]





এ আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ ‘আলিমের মত হলো, কিয়ামতের দিন মানুষের ‘আমলকে ওযন করা হবে; গণনা নয়। আর এ ক্ষেত্রে মানুষের একই ‘আমলের মধ্যে ওযনের কম বেশি হবে তাদের নিয়তের কারণে এবং ‘আমলের মধ্যে ইখলাস কম-বেশি হওয়ার কারণে।





আবদুল্লাহ ইবন মুবারক রহ. বলেন:





رُبَّ عَمَلٍ صَغِيْرٍ تُعَظِّمُهُ النِّيَّةُ، وَرُبَّ عَمَلٍ كَبِيْرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةِ





“নিয়ত অনেক ক্ষুদ্র ‘আমলকে মহৎ আমলে রূপান্তরিত করে। আবার অনেক বৃহৎ ‘আমলকেও তা ক্ষুদ্র করে দেয়।”[9]





নিয়তের গুরুত্ব আমলের চেয়েও বেশি। মানুষের নিয়ত তার ‘আমলের চেয়ে অধিক কার্যকারী। যেমন, এক ব্যক্তি ৬০/৭০ বছর ঈমান অবস্থায় জীবিত ছিলো এবং ইবাদত করল; কিন্তু তার এ নিয়ত ছিলো যে, সে যদি সব সময় জীবিত থাকতো তাহলে ঈমান অবস্থায়ই থাকতো এবং ইবাদত করতে থাকতো। এজন্যই মৃত্যুর পর সে অনন্ত কাল জান্নাতে থাকবে। পক্ষান্তরে বেঈমানরা ৬০/৭০ বছর জীবিত থাকলেও তাদের নিয়তে এটা থাকে যে, তারা যত দিন জীবিত থাকবে বেঈমান অবস্থাতেই থাকবে। তাই তারাও এরূপ বদ-নিয়তের কারণে সব সময় জাহান্নামে থাকবে।[10]





দুই. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿مَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلۡأٓخِرَةِ نَزِدۡ لَهُۥ فِي حَرۡثِهِۦۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرۡثَ ٱلدُّنۡيَا نُؤۡتِهِۦ مِنۡهَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ ٢٠﴾ [الشورا: ٢٠]





“যে পরকালের ফসল প্রত্যাশা করে আমরা তার জন্য সে ফসল আরো বাড়িয়ে দেই। আর যে ইহকালের ফসল কামনা করে আমরা তাকে এর কিছু দিয়ে দেই। কিন্তু পরকালে তার জন্য কিছু থাকবে না।” [সূরা আশ-শূরা, আয়াত: ২০]





তিন. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿فَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ رَبَّنَآ ءَاتِنَا فِي ٱلدُّنۡيَا وَمَا لَهُۥ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنۡ خَلَٰقٖ﴾ [البقرة: ٢٠٠]





“যে সকল লোকেরা বলে যে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে দান করুন। তাদের জন্য পরকালে কোনো অংশ নেই।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২০০]





চার. অন্য আয়াতে আছে:





﴿لَن يَنَالَ ٱللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ ٱلتَّقۡوَىٰ مِنكُمۡۚ﴾ [الحج: ٣٧]





“আল্লাহর কাছে কখনো এগুলোর (কুরবানীর) গোশত পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের (অন্তরের) তাক্বওয়া।” [সূরা আল-হাজ, আয়ত: ৩৭]





কুরবানীর ক্ষেত্রে করবানীর জন্তুর গোশত ও রক্ত নয়; বরং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে আল্লাহর আদেশ পালন করাই কুরবানীর মূল উদ্দেশ্য। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতি শফী রহ. লিখেন যে, কুরবানী একটি মহান ইবাদত। কিন্তু আল্লাহর কাছে এর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না এবং করবানীর উদ্দেশ্যও এগুলো নয়; বরং আসল উদ্দেশ্য জন্তুর ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা এবং পূর্ণ আন্তরিকতাসহ রবের আদেশ পালন করা।[11] অন্যান্য সব ইবাদতের মূল উদ্দেশ্যও তাই। সালাতে উঠা-বসা করা এবং সাওমে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকা আসল উদ্দেশ্য নয় । বরং আল্লাহর আদেশ পালন করাই আসল লক্ষ্য। আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বর্জিত ইবাদত প্রাণহীন কাঠামো মাত্র।





পাঁচ. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿مَن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡحَيَوٰةَ ٱلدُّنۡيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيۡهِمۡ أَعۡمَٰلَهُمۡ فِيهَا وَهُمۡ فِيهَا لَا يُبۡخَسُونَ ١٥ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ لَيۡسَ لَهُمۡ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ إِلَّا ٱلنَّارُۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُواْ فِيهَا وَبَٰطِلٞ مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٦﴾ [هود: ١٥، ١٦]





“যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করে, আমি তাদের দুনিয়াতে ‘আমলের প্রতিফল ভোগ করিয়ে দেই এবং তাতে তাদের প্রতি কিছুমাত্র কমতি করা হয় না। এরাই হল সে সব লোক আখেরাতে যাদের জন্য আগুন ছাড়া কিছুই নেই। তারা এখানে যা কিছু করেছিল সবই বরবাদ করেছে আর যা কিছু উপার্জন করেছিল সবই বিনষ্ট হলো।” [সূরা হূদ, আয়াত: ১৫-১৬]





মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, মায়মুন ইবনে মিহরান ও মুজাহিদ রহ.প্রমুখ উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন: অত্র আয়াতে ঐ সব লোকের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে যারা তাদের যাবতীয় সৎকাজ শুধু পার্থিব ফায়দা হাসিলের জন্য করে থাকে, চাই সে আখেরাতের প্রতি অবিশ্বাসী কাফির হোক অথবা নামধারী মুসলিম হোক, যে পরকালকে মৌখিক স্বীকার করেও কার্যত: সে দিকে কোনো লক্ষ্য রাখে না বরং পার্থিব লাভের দিকেই সম্পূর্ণ মগ্ন ও বিভোর থাকে।[12] সহীহ মুসলিমে আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি যুলুম করেন না। সৎকর্মশীল মুমিন ব্যক্তিরা দুনিয়াতে আংশিক প্রতিদান লাভ করে থাকে এবং পূর্ণ প্রতিদান আখেরাতে লাভ করবে। আর কাফিররা যেহেতু আখেরাতের কোনো ধ্যান-ধারনাই রাখে না, তাই তাদের প্রাপ্য হিস্যা ইহজীবনেই তাদেরকে পুরোপুরি ভোগ করতে দেওয়া হয়। তাদের সৎ কার্যাবলীর প্রতিদানস্বরূপ তাদেরকে ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েশ, বস্তুগত উন্নতি ও ভোগ-বিলাসের সামগ্রী দান করা হয়। অবশেষে যখন আখেরাতে উপস্থিত হবে, তখন সেখানে তাদের প্রাপ্তব্য কিছুই থাকবে না।”[13]





আয়াতটি অবতরণের প্রেক্ষাপট বা শানে নুযূল:





ইসলাম বিরোধীদেরকে যখন ‘আযাবের ভয় দেখানো হতো, তখন তারা নিজেদের দান-খয়রাত, জনসেবা ও জনহিতকর কাজসমূহকে সাফাইরূপে তুলে ধরতো। তারা বলত যে, এতসব সৎকাজ করা সত্ত্বেও আমাদের শাস্তি হবে কেন? উক্ত আয়াতে সে মনোভাবেরই জবাব দেওয়া হয়েছে। জবাবের সারকথা এই যে, প্রতিটি সৎকার্য গ্রহণযোগ্য ও পারলৌকিক মুক্তির কারণ হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে, সেটি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের জন্য করতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার জন্য তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তরীকা মোতাবেক হতে হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তদিয় রাসূলের প্রতি ঈমানই রাখে না ,তার কার্যকলাপ গুণ-গরিমা, নীতি-নৈতিকতা প্রাণহীন দেহের ন্যায়। যার বাহ্যিক আকৃতি অতি সুন্দর হলেও আখেরাতে তার কানাকড়িরও মূল্য নেই। তবে দৃশ্যতঃ সেটা যেহেতু পুণ্যকার্য ছিল এবং তা দ্বারা বহু লোক উপকৃত হয়েছে, তাই আল্লাহ তা‘আলা এহেন তথাকথিত সৎকার্যকে সম্পূর্ণ বিফল ও বিনষ্ট করেন না; বরং এসব লোকের যা মুখ্য উদ্দেশ্য ও কাম্য ছিল যেমন তার সুনাম ও সম্মান বৃদ্ধি হবে, লোকে তাকে দানশীল, মহান ব্যক্তিরূপে স্মরণ করবে, নেতারূপে তাকে বরণ করবে ইত্যাদি আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ইনসাফ ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে তা ইহজীবনেই দান করেন। অপরদিকে আখেরাতে মুক্তি লাভ করা যেহেতু তাদেরও কাম্য ছিলনা এবং প্রাণহীন সৎকার্য আখেরাতের অপূর্ব ও অনন্ত নি‘আমতসমূহের মূল্য হওয়ার যোগ্য ছিল না, কাজেই আখেরাতে তার কোনো প্রতিদানও লাভ করবে না। বরং নিজেদের কুফুরী, শির্কী ও গুনাহের কারণে জাহান্নামের আগুনে চিরকাল তাদের জ্বলতে হবে।





ছয়. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿ فَوَيۡلٞ لِّلۡمُصَلِّينَ ٤ ٱلَّذِينَ هُمۡ عَن صَلَاتِهِمۡ سَاهُونَ ٥ ٱلَّذِينَ هُمۡ يُرَآءُونَ ٦ وَيَمۡنَعُونَ ٱلۡمَاعُونَ ٧ ﴾ [الماعون: ٤، ٧]





“অতএব, দুর্ভাগ্য সে সব সালাত আদায়কারীর, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে বে-খবর। যারা তা লোক দেখানোর জন্য করে এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দেয় না।” [সূরা আল-মা‘ঊন, আয়াত: ৪-৭]





উক্ত পাঁচটি আয়াতে সেসব মুনাফিকদের কথা আলোচনা করা হয়েছে যারা লোক দেখানো এবং ইসলামের দাবীকে প্রমাণ করার জন্য বাহ্যত সালাত আদায় করে। কিন্তু তারা যেহেতু সালাত ফরয হওয়াকেই স্বীকার করে না তাই তারা সময়ের কোনো গুরুত্ব প্রদান করে না। তদ্রূপ মূল সালাতেও অলসতা করে এবং তারা (مَاعُونَ) তথা যৎকিঞ্চিৎ তুচ্ছ বস্তু যেমন- কুড়াল, কোদাল, রান্না-বান্নার পাত্র, ছুরি ইত্যাদি কার্পন্যবশতঃ প্রতিবেশিদেরকে দেয় না। উক্ত আয়াতগুলোতে এ কথার প্রতি কঠোর সতর্কবাণী রয়েছে যে, লোক দেখানোর জন্য সালাত আদায় বা অন্য কোনো ইবাদত করা মুনাফিকদের স্বভাব। কোনো মুসলিম যদি একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি ছাড়া লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করে তবে তা হবে মুনাফিকসুলভ আচরণ, যা সওয়াব প্রাপ্তির যোগ্যতা রাখে না।





সাত. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُۥ فُرُطٗا ٢٨﴾ [الكهف: ٢٨]





“আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের রবকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নিবেন না এবং যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না।” [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ২৮]





অর্থাৎ আপনি নিজেকে তাদের সাথে বেঁধে রাখুন। সম্পর্ক ও মনোযোগ তাদের প্রতি নিবদ্ধ রাখুন। কাজ-কর্মে তাদের থেকেই পরামর্শ নিন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা খাঁটি নিয়তে সকাল সন্ধ্যায় অর্থাৎ সর্বাবস্থায় আল্লাহর ইবাদত ও যিকির করে। তাদের কার্যকলাপ একান্তভাবেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে নিবেদিত।





আট. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿مَّن كَانَ يُرِيدُ ٱلۡعَاجِلَةَ عَجَّلۡنَا لَهُۥ فِيهَا مَا نَشَآءُ لِمَن نُّرِيدُ ثُمَّ جَعَلۡنَا لَهُۥ جَهَنَّمَ يَصۡلَىٰهَا مَذۡمُومٗا مَّدۡحُورٗا ١٨ وَمَنۡ أَرَادَ ٱلۡأٓخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعۡيَهَا وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ كَانَ سَعۡيُهُم مَّشۡكُورٗا ١٩﴾ [الاسراء: ١٨، ١٩]





“যারা ইহকাল কামনা করে, আমি সে সব লোককে যা ইচ্ছা সত্ত্বর দিয়ে দিই। অতঃপর তাদের জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করি। ওরা তাতে নিন্দিত-বিতাড়িত অবস্থায় প্রবেশ করবে। আর যারা পরকাল কামনা করে এবং মুমিন অবস্থায় তার জন্য যথাযথ চেষ্টা-সাধনা করে, এমন লোকদের চেষ্টা স্বীকৃত হয়ে থাকে।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১৮-১৯]





উপরোক্ত প্রথম আয়াতটি কাফিরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যারা নিজেদের প্রত্যেক কাজকে ক্রমাগতভাবে ও সদা সর্বদা শুধু ইহকালের উদ্দেশ্যেই আচ্ছন্ন করে রাখে-পরকালের প্রতি কোনোই লক্ষ্য রাখে না। দ্বিতীয় আয়াতে মুমিনদের কথা বলা হয়েছে অর্থ এই যে, মুমিন যখনই যে কাজে পরকালের ইচ্ছা ও নিয়ত করবে, তার সে কাজ গ্রহণযোগ্য হবে। মুমিনের যে কর্ম খাঁটি নিয়ত সহকারে অন্যান্য শর্তানুযায়ী হবে, তা কবুল করা হবে আর যে কর্ম এরূপ হবে না, তা কবুল করা হবে না।





নয়. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥﴾ [البينة: ٥]





“তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে এবং সালাত কায়েম করতে ও যাকাত প্রদান করতে। আর এটাই সঠিক দীন।” [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ০৫]





দশ. অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿قُلۡ إِن تُخۡفُواْ مَا فِي صُدُورِكُمۡ أَوۡ تُبۡدُوهُ يَعۡلَمۡهُ ٱللَّهُۗ﴾ [ال عمران: ٢٩]





“বলুন, তোমাদের মনে যা আছে তা যদি তোমরা গোপন রাখ কিংবা প্রকাশ করে দাও, আল্লাহ তা‘আলা তা অবগত আছেন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ২৯]


 নিয়ত: প্রসঙ্গ আল-হাদীস





এক. উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:





«إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ، وَإِنَّمَا لِامْرِئٍ مَا نَوَى، فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ، وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوْ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ».





“যাবতীয় কাজ/আমলের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর মানুষের তাই প্রাপ্য যার সে নিয়ত করবে। অতএব, যে ব্যক্তির হিজরত আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর রাসূলের জন্য হবে তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্যই হবে। আর যে ব্যক্তির হিজরত পার্থিব সম্পদ অর্জন কিংবা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার জন্য হবে; তার হিজরত যে নিয়তে করবে তারই জন্য হবে।”[14]





এ হাদীসটি ইসলামী জীবনাচারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি। মানুষের সকল প্রকার কাজকর্মের গ্রহণযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য হওয়া একমাত্র তার নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। যাবতীয় আমলের প্রতিদান পাওয়া না পাওয়া সে আমলকারীর নিয়তের খাঁটি-অখাঁটি হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত। এ হাদীস দ্বারা এটা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শরী‘আতে নিয়তের অবস্থান অতি উঁচু স্থানে। বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত কোনো আমলই গ্রহণযোগ্য হয় না। আমলের শুদ্ধি ও গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম শর্ত হচ্ছে নিয়ত। এ কারণে আল্লাহ তা‘আলা সকল ইবাদতে নিয়তকে খাঁটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো আমল কিছুতেই সঠিক হতে পারে না। উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণিত উক্ত হাদীস থেকে এ বিষয়টিও সাব্যস্ত হয় যে, মানুষ তার নিয়ত অনুসারেই কৃতকর্মের ফলাফল লাভ করে। এমনকি সে নিজের ব্যবহারিক জীবনে পানাহার, উপবেশন, নিদ্রা ইত্যাদির ন্যায় যে কাজগুলো সে অভ্যাস-বশে সম্পাদন করে সে সব কাজও সদিচ্ছা এবং সৎ নিয়তের কারণে পুণ্যময় আমলে পরিণত হতে পারে। পারে সওয়াব অর্জনের মাধ্যম হতে। যেমন, কেউ হালাল খাবার খাওয়ার সময় উদর ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ইবাদতের জন্য শক্তি ও সক্ষমতা লাভের নিয়তও যদি করে নেয় তাহলে এর জন্য সে অবশ্যই সওয়াবের অংশিদার হবে। এমনিভাবে মনোমুগ্ধকর ও মনোরঞ্জক যে কোনো বৈধ বিষয়ও নেক নিয়তের সঙ্গে উপভোগ করলে তা ইবাদতে রূপান্তরিত হয়। উক্ত হাদীসে এ বিষয়টিও লক্ষ্যনীয় যে, নিয়তের সম্পর্ক অন্তরের সাথে। কাজেই কোনো ইবাদতের সময় ‘নিয়তের দো‘আ’ জাতীয় কিছু মুখে উচ্চারণ করা যাবে না; কাজের সাথে অন্তরের উদ্দেশ্যেরও সমন্বয় থাকতে হবে। বরং মুখে উচ্চারণের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যেমন, যদি কোনো ব্যক্তি জোহরের সালাত আদায় করার সময় অন্তরে জোহরের সালাত আদায় করার নিয়ত করে আর মুখে অন্য সালাতের কথা এসে যায়। তাহলে তার জোহরের সালাতই আদায় হবে। এতে জোহরের সালাতের নিয়তের কোনো ত্রুটি হবে না।[15]





দুই. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:





«يَغْزُو جَيْشٌ الْكَعْبَةَ، فَإِذَا كَانُوا بِبَيْدَاءَ مِنْ الْأَرْضِ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ، قَالَتْ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ! كَيْفَ يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ وَفِيهِمْ أَسْوَاقُهُمْ وَمَنْ لَيْسَ مِنْهُمْ؟ قَالَ: يُخْسَفُ بِأَوَّلِهِمْ وَآخِرِهِمْ، ثُمَّ يُبْعَثُونَ عَلَى نِيَّاتِهِمْ».





“একটি বাহিনী কা‘বা ঘরের উপর আক্রমন করার উদ্দেশ্যে বের হবে। অতঃপর যখন তারা সমতল মরুপ্রান্তরে পৌছবে তখন তাদের প্রথম ও শেষ ব্যক্তি সকলকেই যমীনে ধসিয়ে দেয়া হবে। তিনি (আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন যে, আমি (এ কথা শুনে) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কেমন করে তাদের প্রথম ও শেষ সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হবে? অথচ তাদের মধ্যে তাদের বাজারের ব্যবসায়ী এবং এমন লোক থাকবে যারা তাদের (আক্রমণকারীদের) অন্তর্ভুক্ত নয়। তিনি বললেন, তাদের প্রথম ও শেষ সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হবে। তারপর তাদেরকে তাদের নিয়ত অনুযায়ী পুনরুত্থিত করা হবে।”[16]





অর্থাৎ, বাহ্যত কা‘বা ঘরের উপর আক্রমনকারীদের দলভুক্ত থাকার কারণে সকলকেই ধসিয়ে দেওয়া হলেও কিয়ামত দিবসের চূড়ান্ত হিসাব নিয়তের ভিত্তিতেই হবে।





তিন. অন্যত্র আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:





«لاَ هِجْرَةَ بَعْدَ الْفَتْحِ وَلَكِنْ جِهَادٌ وَنِيَّةٌ وَإِذَا اسْتُنْفِرْتُمْ فَانْفِرُوا».





“মক্কা বিজয়ের পর (মক্কা থেকে) হিজরত নেই; বরং বাকী আছে জিহাদ ও নিয়ত। সুতরাং যদি তোমাদেরকে জিহাদের জন্য ডাক দেওয়া হয় তাহলে তোমরা বেরিয়ে পড়।”[17]





চার. আবূ আব্দুল্লাহ জাবের ইবন আব্দুল্লাহ আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন:





«كُنَّا مَعَ النَّبيِّ ﷺ في غَزَاةٍ، فَقالَ : «إِنَّ بالمدِينَةِ لَرِجَالاً ما سِرْتُمْ مَسِيراً، وَلاَ قَطَعْتُمْ وَادِياً، إلاَّ كَانُوا مَعَكمْ حَبَسَهُمُ الْمَرَضُ».





“আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এক অভিযানে ছিলাম। তিনি বললেন, মদীনাতে কিছু লোক এমন আছে যে, তোমরা যত সফর করছ এবং যে কোনো উপত্যকা অতিক্রম করছ, তারা তোমাদের সঙ্গে রয়েছে। অসুস্থতা তাদেরকে মদীনায় থাকতে বাধ্য করেছে।”[18]





অর্থাৎ পূর্ণ নিয়ত বা সদিচ্ছা থাকার পরও অসুস্থতার কারণে যারা অভিযানে অংশ নিতে পারে নি, শুধুমাত্র নিয়তের কারণে তারাও অভিযান পরিচালনাকারীদের সমপরিমাণ সাওয়াবের অধিকারী হবে।





পাঁচ. অন্য হাদীসে এসেছে,





«وعَنْ أَبِي يَزيدَ مَعْنِ بنِ يَزيدَ بنِ الأخنسِ رضي الله عنه، وهو وأبوه وَجَدُّه صحابيُّون، قَالَ : كَانَ أبي يَزيدُ أخْرَجَ دَنَانِيرَ يَتَصَدَّقُ بِهَا، فَوَضعَهَا عِنْدَ رَجُلٍ في الْمَسْجِدِ، فَجِئْتُ فأَخذْتُها فَأَتَيْتُهُ بِهَا . فقالَ: واللهِ، مَا إيَّاكَ أرَدْتُ، فَخَاصَمْتُهُ إِلى رسولِ اللهِ ﷺ ، فقَالَ: «لكَ مَا نَوَيْتَ يَا يزيدُ، ولَكَ ما أخَذْتَ يَا مَعْنُ».





“আবূ ইয়াযীদ মা‘ন ইবন ইয়াযীদ ইবনে আখনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু- তিনি (মা‘ন) এবং তার পিতা ও দাদা সকলেই সাহাবী বলেন: আমার পিতা ইয়াযীদ দান করার জন্য কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা বের করলেন। অতঃপর তিনি সেগুলো (দান করার জন্য) মসজিদে একটি লোককে দায়িত্ব দিলেন। আমি মসজিদে এসে তার কাছ থেকে অন্যান্য ভিক্ষুকের মত তা নিয়ে নিলাম এবং তা নিয়ে বাড়ি এলাম। (যখন আমার পিতা এ ব্যাপারে অবগত হলেন তখন) বললেন, আল্লাহর কসম! ‘তোমাকে দেওয়ার নিয়ত আমার ছিল না’। ফলে (এগুলো আমার জন্য হালাল হবে কি না তা জানার জন্য) আমি আমার পিতাকে নিয়ে আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে উপস্থিত হলাম। তিনি বললেন, ‘হে ইয়াযীদ! তোমার জন্য সে বিনিময় রয়েছে যার নিয়ত তুমি করেছ আর হে মা‘ন! তুমি যা নিয়েছ তা তোমার জন্য হালাল’।”[19]





আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা‘আতের সর্বসম্মতিক্রমে আকীদা হলো পিতা কর্তৃক নিজ সন্তানকে যাকাত দেওয়া জায়েয নেই। এভাবে যাকাত আদায় হবে না।[20] কিন্তু উক্ত হাদীসে দেখা যাচ্ছে, পিতার যাকাতের টাকা পুত্র গ্রহণ করেছে। তথাপি পিতা কর্তৃক পুত্রকে দেওয়ার নিয়ত না থাকার কারণে এবং পুত্রের তা গ্রহণ করার সময় পিতার যাকাত হওয়ার কথা নিয়তে (জানা) না থাকার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হে ইয়াযীদ! তোমার জন্য সে বিনিময় রয়েছে যার নিয়ত তুমি করেছ আর হে মা‘ন! তুমি যা নিয়েছ তা তোমার জন্য হালাল।





ছয়. অন্য হাদীসে সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাসকে লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:





«وَإنَّكَ لَنْ تُنفِقَ نَفَقَةً تَبْتَغي بِهَا وَجهَ اللهِ إلاَّ أُجِرْتَ عَلَيْهَا حَتَّى مَا تَجْعَلُ في فِيِّ امْرَأَتِكَ».





“মনে রেখ, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় তুমি যা ব্যয় করবে তোমাকে তার বিনিময় দেওয়া হবে। এমনকি তুমি যে গ্রাস তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দাও তারও তুমি বিনিময় পাবে।”[21]





স্ত্রীর মুখে গ্রাস তুলে দেওয়া নিত্য প্রয়োজনীয় একটি পার্থিব কাজ মাত্র। তথাপিও নিয়ত বিশুদ্ধ রেখে শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য তা করলে তারও বিনিময় বা সাওয়াব পাওয়া যাবে।





সাত. আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





«إنَّ الله لاَ ينْظُرُ إِلى أجْسَامِكُمْ، وَلاَ إِلَى صُوَرِكمْ، وَلَكن ينْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعمَالِكُم»





“নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা তোমাদের দেহ এবং তোমাদের আকৃতি দেখেন না; বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও ‘আমল দেখেন।”[22]





অর্থাৎ আমল ও আকৃতি মৌলিক বিষয় নয়; বরং নিয়তই মূল।





আট. আবূ মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,





«سُئِلَ رَسُولُ اللهِ ﷺ عَنِ الرَّجُلِ يُقاتلُ شَجَاعَةً، ويُقَاتِلُ حَمِيَّةً، ويُقَاتِلُ رِيَاءً، أَيُّ ذٰلِكَ في سبيلِ الله ؟ فَقَالَ رَسُول الله: مَنْ قَاتَلَ لِتَكونَ كَلِمَةُ اللهِ هي العُلْيَا، فَهوَ في سَبِيلِ اللهِ».





“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, যে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য যুদ্ধ করে, অন্ধ পক্ষপাতিত্বের জন্য যুদ্ধ করে; এবং লোক দেখানোর (সুনাম অর্জনের) জন্য যুদ্ধ করে, এর কোনো যুদ্ধটি আল্লাহর পথে হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমাকে উঁচু করার জন্য যুদ্ধ করে একমাত্র তারই যুদ্ধ আল্লাহর পথে হয়।”[23]





দেখুন, অন্ধ পক্ষপাতিত্বের জন্য যুদ্ধ করাও -চায় সেটি মুসলিমদের পক্ষেই হোক না কেন- আল্লাহর পথের জিহাদ নয়। একমাত্র আল্লাহর কালেমাকে উঁচু করার নিয়তই জিহাদ কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত।





নয়. আবু বাকরাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:





«إِذَا التَقَى المُسلِمَان بسَيْفَيهِمَا فالقَاتِلُ وَالمَقْتُولُ في النّارِ» قُلتُ : يا رَسُولَ اللهِ! هَذا القَاتِلُ فَمَا بَالُ المقْتُولِ ؟ قَالَ: إنَّهُ كَانَ حَريصاً عَلَى قتلِ صَاحِبهِ».





“যখন দু‘জন মুসলিম তরবারী নিয়ে পরস্পরে লড়াই করে, তখন হত্যাকারী ও নিহত দু’ জনই জাহান্নামে যাবে। (বর্ণনাকারী সাহাবী বলেন) আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! হত্যাকারীর জাহান্নামে যাওয়া তো স্পষ্ট; কিন্তু নিহত ব্যক্তির ব্যাপার কী?’ তিনি বললেন, ‘‘সেও তার সঙ্গীকে হত্যা করার জন্য লালায়িত ছিল’’।[24]





দেখুন, নিহত ব্যক্তির প্রতিপক্ষকে হত্যা করার নিয়ত, সংকল্প বা হত্যা করার জন্য লালায়িত থাকাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।





দশ. আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত,





 





 



Recent Posts

সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের ...

সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের ক্ষেত্রে করণীয়

প্রতিবেশীর অধিকার ...

প্রতিবেশীর অধিকার

ঈদুল ফিতরের আনন্দ ও আ ...

ঈদুল ফিতরের আনন্দ ও আমাদের করণীয়

হজ-উমরার ফাযাইল ও উপক ...

হজ-উমরার ফাযাইল ও উপকারিতা