তবে জ্ঞান থাকলেও যদি হাদীসের জ্ঞান না থাকে অথবা হাদীসকে বাদ দেয়া হয়, তবুও কুরআন বুঝা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের কিছু ঘটনা দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরা যায় :
ক. আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَلَمۡ يَلۡبِسُوٓاْ إِيمَٰنَهُم بِظُلۡمٍ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمُ ٱلۡأَمۡنُ وَهُم مُّهۡتَدُونَ ٨٢﴾ [الأنعام : 82]
‘যারা ঈমান এনেছে এবং নিজ ঈমানকে যুলমের সাথে সংমিশ্রণ করেনি, তাদের জন্যই নিরাপত্তা এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত’। {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ৮২}
আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, যখন আল্লাহ জাল্লা জালালুহূ এ আয়াত নাযিল করলেন, তখন সাহাবীগণ রাদিআল্লাহু ‘আনহুম একে ভারী মনে করলেন। তাঁরা আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে পাপের মাধ্যমে নিজের ওপর কোনো ‘যুলুম’ করে নি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্লাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, তোমরা আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হও নি। আয়াতে ‘যুলুম’ বলে শিরককে বুঝানো হয়েছে। দেখ অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআ‘লা বলেন,
﴿ وَإِذۡ قَالَ لُقۡمَٰنُ لِٱبۡنِهِۦ وَهُوَ يَعِظُهُۥ يَٰبُنَيَّ لَا تُشۡرِكۡ بِٱللَّهِۖ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣ ﴾ [لقمان: ١٣]
‘আর স্মরণ কর, যখন লুকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল, ‘প্রিয় বৎস, আল্লাহর সাথে শিরক করো না; নিশ্চয় শিরক হল বড় যুলম।’ {সূরা লুকমান, আয়াত : ১৩}
কাজেই এ আয়াতের অর্থ হবে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস স্থাপন করে, অতঃপর আল্লাহর সত্তা, নাম ও গুণাবলিতে এবং ইবাদতের বেলায় কাউকে অংশীদার না বানায়, সে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও সুপথপ্রাপ্ত।[9]
খ. আয়েশা রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
« لَيْسَ أَحَدٌ يُحَاسَبُ إِلاَّ هَلَكَ ».
‘কেয়ামতের দিন যে ব্যক্তিরই হিসাব নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।’
قَالَتْ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ جَعَلَنِي اللهُ فِدَاءَكَ أَلَيْسَ يَقُولُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ [فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَابًا يَسِيرًا] قَالَ
আয়েশা বলেন, একথা শুনে আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য কোরবান করুন। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ কি বলেন নি,
﴿ فَأَمَّا مَنۡ أُوتِيَ كِتَٰبَهُۥ بِيَمِينِهِۦ ٧ فَسَوۡفَ يُحَاسَبُ حِسَابٗا يَسِيرٗا ٨ ﴾ [الانشقاق: ٧، ٨]
‘অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেয়া হবে; অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে।’ {সূরা ইনশিকাক, আয়াত : ৭-৮} উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
« ذَاكَ الْعَرْضُ يُعْرَضُونَ وَمَنْ نُوقِشَ الْحِسَابَ هَلَكَ ».
‘আমলনামা পেশ করার কথা যা এভাবে পেশ করা হবে। কিন্তু পরখ করে যার হিসাব-নিকাশ নেয়া হবে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।’[10]
গ. আল্লাহ তা‘আালা ইরশাদ করেন,
﴿ وَكُلُواْ وَٱشۡرَبُواْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلۡخَيۡطُ ٱلۡأَبۡيَضُ مِنَ ٱلۡخَيۡطِ ٱلۡأَسۡوَدِ مِنَ ٱلۡفَجۡرِۖ ﴾ [البقرة: ١٨٧]
‘আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৭}
এই আয়াত নাযিল হবার পর আদী ইবন হাতেম রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহু একটি কালো সুতা ও একটি সাদা সুতা নিয়ে বালিশের নীচে রাখলেন। রাত অতিবাহিত হওয়ার পর থেকে তিনি সে দুটোকে বার বার দেখতে লাগলেন। কিন্ত কালো সাদার পার্থক্য ধরা পড়ল না। সকাল হলে তিনি বললেন,
يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّى أَجْعَلُ تَحْتَ وِسَادَتِى عِقَالَيْنِ عِقَالاً أَبْيَضَ وَعِقَالاً أَسْوَدَ أَعْرِفُ اللَّيْلَ مِنَ النَّهَارِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « إِنَّ وِسَادَتَكَ لَعَرِيضٌ إِنَّمَا هُوَ سَوَادُ اللَّيْلِ وَبَيَاضُ النَّهَارِ ».
ইয়া রাসূলাল্লাহ আমি কালো ও সাদা দুটি সুতো আমার বালিশের নীচে রেখেছিলাম। (তারপর সব ঘটনা বললেন।) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাহলে তো দেখছি তোমার বালিশ বেজায় চওড়া! (কারণ রাতের কালো প্রান্তরেখা ও ভোরের সাদা প্রান্তরেখার জন্য তোমার বালিশের নীচে স্থান সংকুলান হয়েছে।) আসলে এ দুটি সুতো নয় বরং রাতের অন্ধকার এবং দিনের আলো’।[11]
ঘ. আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ ﴾ [التوبة: ٣٤]
‘আর যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদের বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।’ {সূরা আত-তাওবা, আয়াত : ৩৪}
এই আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম মনে করলেন কোনো ধন-সম্পদ জমা রাখা যাবে না, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
« إِذَا أَدَّيْتَ زَكَاةَ مَالِكَ فَقَدْ أَذْهَبْتَ عَنْكَ شَرَّهُ ».
‘যদি তুমি তোমার মালের যাকাত আদায় কর তাহলে নিজ থেকে তার ক্ষতিকে তুমি দূর করে দিলে।’[12]
খালেদ ইবন আসলাম বর্ণনা করেন, একদা আমরা আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুমার সঙ্গে বের হয়েছিলাম। তাঁর কাছে এক গ্রাম্য লোক ওপরের আয়াতটি উল্লেখ করে জানত চাইল এর ব্যাখ্যা কী? তিনি বললেন,
مَنْ كَنَزَهَا فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهَا فَوَيْلٌ لَهُ إِنَّمَا كَانَ هَذَا قَبْلَ أَنْ تُنْزَلَ الزَّكَاةُ فَلَمَّا أُنْزِلَتْ جَعَلَهَا اللَّهُ طُهْرًا لِلأَمْوَالِ.
‘যে ব্যক্তি যাকাত আদায় না করে সম্পদ সঞ্চিত রাখবে তার ধ্বংস অনিবার্য। সম্পদ সঞ্চয় করলে এই শাস্তির বিধান ছিল যাকাত সংক্রান্ত আয়াত নাযিলের আগে। পরে যখন আল্লাহ তা‘আলা যাকাত ফরয ঘোষণা করে আয়াত নাযিল করেন, তখন তিনি যাকাতকে ধন-মালের পরিশুদ্ধকারী করে দিয়েছেন’।[13]
আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেন,
كُلُّ مَالٍ أَدَّيْتَ زَكَاتَهُ وَإِنْ كَانَ تَحْتَ سَبْعِ أَرْضِيْنَ فَلَيْسَ بِكَنْزٍ وَكُلُّ مَالٍ لَا تُوَدِّى زَكَاتَهُ فَهُوَ كَنْزٌ وَإِنْ كَانَ ظَاهِرًا عَلَى وَجْهِ الْأَرْضِ .
‘যে মালের যাকাত আদায় করা হয়, তা যদি যমীনের সাত স্তর নীচেও থাকে, তাহলেও ‘কানয’ তথা সঞ্চিত ধন-রত্নের মধ্যে গণ্য নয়। আর যে সম্পদের যাকাত আদায় করা হয় না, তা যদি যমীনের পিঠে খোলা থাকলেও ‘কানয’ তথা সঞ্চিত ধন-রত্নের অন্তর্ভুক্ত।’[14]
এ থেকে বুঝা গেল, যাকাত আদায়ের পর যা অবশিষ্ট থাকে তা জমা রাখা গোনাহ নয়।
ঙ. আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ وَلَقَدۡ ءَاتَيۡنَٰكَ سَبۡعٗا مِّنَ ٱلۡمَثَانِي وَٱلۡقُرۡءَانَ ٱلۡعَظِيمَ ٨٧ ﴾ [الحجر: ٨٧]
‘আর আমি তো তোমাকে দিয়েছি পুনঃপুনঃ পঠিত সাতটি আয়াত ও মহান কুরআন।’ {সূরা আল-হিজর, আয়াত : ৮৭}
এই আয়াতে ‘সাবয়ে মাছানী’ অর্থ যে সূরা ফাতেহা, তা আমরা একমাত্র হাদীস[15] থেকেই জানতে পারি। এমনিভাবে কুরআন মাজীদের আরো অনেক আয়াত ও শব্দের অর্থ শুধুমাত্র হাদীস থেকেই জানা যায়। হাদীস ছাড়া তা জানার অন্য কোনো উপায় নেই।
কুরআনী বিধান বাস্তবায়নে হাদীসের ভূমিকা বিকল্পহীন :
যদিও কুরআন মাজীদে শরীয়তের মৌলিক বিধানাবলির বর্ণনা আছে। কিন্তু তা এত সংক্ষিপ্ত যে, শুধু কুরআনের ওপর ভিত্তি করে সেগুলির বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। এরূপ অনেক বিধি-বিধান রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ দু’একটি উল্লেখ করা যায় :
ক. ‘সালাত’ তথা নামায সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে,
﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣ ﴾ [البقرة: ٤٣]
‘আর তোমরা সালাত কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রুকূকারীদের সাথে রুকূ কর।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ৪৩}
কিন্তু সালাতের ওয়াক্তসমূহ রাকাতের সংখ্যা, কেরা’তের তাফসীল, শর্তাদি, সালাত ভঙ্গের কারণসমূহ এবং সালাতের সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি ইত্যাদির বিস্তারিত বর্ণনা জানতে হাদীসই ভরসা।
খ. কুরআন মাজীদে যাকাতের ব্যাপারে বলা হয়েছে,
﴿ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ ﴾ [البقرة: ٤٣]
‘এবং তোমরা যাকাত আদায় কর’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ৪৩} কিন্তু যাকাত কী? এর নেছাব কত? কখন তা আদায় করতে হবে? কতটুকু আদায় করা জরুরী? ইত্যাদি শুধু হাদীস থেকেই আমরা জানি। হাদীস ছাড়া এসব জানার কোনো উপায় নেই।
গ. কুরআন মাজীদে সাওম বা রোযা সম্পর্কে বলা হয়েছে,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ ﴾ [البقرة: ١٨٣]
‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর, যেন তোমরা পরহেযগার হতে পার’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৮৩}
কিন্তু সিয়াম ফরয হওয়ার জন্য শর্তাদি কী? সিয়াম ভঙ্গের কারণসমূহ কী? সিয়ামাবস্থায় কী কী বৈধ? ইত্যাদি আরো অনেক বিধি-বিধানের বিস্তারিত বর্ণনা শুধু হাদীস থেকেই পাওয়া যায়।
ঘ. কুরআন মাজীদে হজ সম্পর্কে বলা হয়েছে,
﴿ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧ ﴾ [ال عمران: ٩٧]
‘আর সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী। আর এ ঘরের হজ করা হ’ল মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য, যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার’। {সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৯৭}
কিন্তু জীবনে হজ কত বার ফরয? হজ্জের রুকুন কী? হজ আদায়ের সঠিক নিয়ম কী? ইত্যাদি হজ ও উমরা সম্পর্কীয় আরো অনেক বিধানের বিস্তারিত বর্ণনা শুধু হাদীসেই রয়েছে।
ঙ. পানাহারের বস্তু সামগ্রীর কিছুকে হালাল ও অন্য কিছুকে হারাম ঘোষণা করে অবশিষ্ট বস্তুনিচয় সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে,
‘তোমাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল করা হয়েছে’। অন্য স্থানে আছে ‘অপবিত্র বস্তুসমূহ হারাম করা হয়েছে’। কিন্তু কোন বস্তু হালাল ও পবিত্র, আর কোনটি অপবিত্র ও হারাম, এসবের বিস্তারিত বর্ণনা আমরা জানতে পাই শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা ও কাজ থেকেই।
চ. কুরআন মাজীদে চুরি করার শাস্তি বলা হয়েছে ‘হাত কেটে ফেলা। কিন্তু কী পরিমাণ মাল চুরি করলে? এবং কতটুকু হাত কাটা হবে? ইত্যাদি বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা শুধু হাদীসেই আমরা পেয়ে থাকি।
ছ. কুরআন মাজীদে মদপান হারাম বলা হয়েছে। কিন্তু সকল মাদকদ্রব্যের বিধান কী হবে? নেশাযুক্ত বস্তু পরিমাণে কমবেশি হলে কী বিধান হবে? ইত্যাদি মদ সংক্রান্ত অনেক বিধানের বিস্তারিত বর্ণনা শুধু হাদীসে পাওয়া যায়।
জ. কুরআন মাজীদে মহিলাদের মীরাছ সম্পর্কে বলা হয়েছে, একজন হলে সে অর্ধেক সম্পত্তি পাবে, আর যদি দুয়ের অধিক হয়, তখন দুই তৃতীয়াংশ পাবে। কিন্তু দুজন হলে কতটুকু পাবে তা আর কুরআনে নেই, তা শুধু হাদীসেই পাওয়া যায়। এছাড়া মীরাছ সম্পর্কিত আরো অনেক বিধান আমরা শুধু হাদীস থেকেই নিই।
ঝ. কুরআন মাজীদে সুদকে কঠোরভাবে নিষেধ করে একে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোন ধরনের লেনদেন সুদের অন্তর্ভুক্ত আর কোনটি নয়- এসব ব্যাপারে হাদীসেই বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।[16]
এমনিভাবে শরীয়তের আরো অনেক বিধি-বিধান রয়েছে যেগুলি সম্পর্কে কুরআন মাজীদে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হয়েছে। অথচ হাদীসেই পাওয়া যায় তার বিস্তারিত বিবরণ। এমতাবস্থায় যে বা যারাই হাদীসকে বাদ দিয়ে কুরআন বুঝার বা কুরআনী বিধানাবলি বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে, তারা যে স্পষ্ট গোমরাহ ও পথভ্রষ্ট, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কেন নয়, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেসব দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন তার অন্যতম ছিল মানুষকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেওয়া এবং তার বক্তব্য তাদের কাছে সুস্পষ্ট করে দেওয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
﴿ كَمَآ أَرۡسَلۡنَا فِيكُمۡ رَسُولٗا مِّنكُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡكُمۡ ءَايَٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمۡ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمۡ تَكُونُواْ تَعۡلَمُونَ ١٥١ ﴾ [البقرة: ١٥١]
‘যেভাবে আমি তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি তোমাদের মধ্য থেকে, যে তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করে, তোমাদেরকে পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। আর তোমাদের শিক্ষা দেয় এমন কিছু যা তোমরা জানতে না।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৫১}
শায়খ ইবন তাইমিয়া রহ. বলেন, এটা জানা দরকার যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের কাছে কুরআনের অর্থ বলে দিয়েছেন যেমন তিনি তাঁদের কাছে এর শব্দসমূহ বর্ণনা করেছেন। কেননা আল্লাহর বাণী,
﴿ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤ ﴾ [النحل: ٤٤]
‘এবং তোমার প্রতি নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষের জন্য স্পষ্ট করে দিতে পার যা তাদের প্রতি নাযিল হয়েছে। আর যাতে তারা চিন্তা করে।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত : ৪৪} এই আয়াতটি কুরআনের শব্দ এবং তার ব্যাখ্যা উভয়টাকেই শামিল করে।[17]
নিম্নে বাংলায় রচিত ও অনূদিত আল-কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীরগ্রন্থসমূহের একটি তালিকা প্রদান করা হলো :
(পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ও তফসীর)
গিরিশচন্দ্র সেন, ১৮৩৪-১৯১০। পাঁচদোনা, নরসিংদী।
- কোরান শরীফের অনুবাদ। ৩ খণ্ড। কলিঃ নববিধান ব্রাহ্মণ সমাজ, ১৮৮১-৮৬। ২য় মুদ্রণঃ ১৮৮৯-৯২। ৩য় মুদ্রণঃ ১৯০৭-০৮। ৪+১০+৭২০ পৃ। ৪র্থ মুদ্রণঃ ১৯৩৬। ৭২০ পৃ। নতুন মুদ্রণঃ কলিঃ হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৯। ৬৮৩ পৃ। (প্রথমে ১৮৮১ থেকে খণ্ড হিসাবে বের হয় এবং ১৮৮৫তে ৩০তম খণ্ডের কাজ শেষ হয়। ১ম খণ্ড শেরপুর (ময়মন) অনুবাদক, ১৮৮১। ২৮+৭২৯ পৃ। অন্য সংস্করণ, খোশরোজ, ১৯৯৬। ৭৬৬ পৃ। নতুন মুদ্রণঃ কলিঃ হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৯। ৬৮৩ পৃ। (প্রথমে ১৮৮১ থেকে খণ্ড হিসাবে বের হয় এবং ১৮৮৫তে ৩০ তম খণ্ডের কাজ শেষ হয়। ১ম খণ্ড। শেরপুর (ময়মন) অনুবাদক, ১৮৮১। ২৮ পৃ। অন্য সংস্করণ : ঝিনুক পুস্তিকা, ১৯৭৭। ২৮+৭৯২ পৃ। আরেক সংস্করণ : খোশরোজ, ১৯৯৬। ৭৬৬ পৃ।
শাহ আব্দুর রহীম, ১৮৫৯-১৯১০।
- কোরান। কলিঃ গ্রন্থকার, ১৮৯২।
খান বাহাদুর তসলিমুদ্দীন আহমদ, ১৮৫২-১৯২৭। রংপুর। আইনজীবী।
- কোরানের বঙ্গানুবাদ। ৩ খণ্ড। কলিঃ ওরিয়েন্টেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স, ১৯২২-২৫। ১ম খণ্ড ১৯২২। ৮+৪৫৮ পৃ। সংসদ। ২য় খণ্ড ১৯২৪। ৪৫৮ পৃ। ৩য় খণ্ড ১৯২৫। ৫২১। (প্রথমে পারা হিসাবে বের হয়। অমুসলিমগণও যাতে পড়তে পারে তাই মূল আরবী বাদ দেয়া হয়। রচনাকাল-১৮৯১-১৯১৩)
ডা. সূফী ময়েজ উদ্দীন আহম্মদ (মধুমিয়া), ১৮৫৫-১৯৩০।
- বঙ্গানুবাদ তাফসীরে হক্কানী। ১ম খণ্ড কলিঃ অনুবাদক, ১৯০১। ৬০ পৃ। (প্রথমে ইাসলাম প্রচারকে ধারাবাহিকভাকে প্রকাশিত হয়। স্যার সৈয়দ আহমদ খান, ১৮১৭-৯৮ কৃত উর্দু অনুবাদ থেকে বাংলায় অনূদিত হয়।)
এই তফসীরের অন্য অনুবাদ।
মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, ১৮৯৫-১৯৬৯।
- হক্কানী তফসীর। (১৬৫০ পৃষ্ঠা ৬ খণ্ড প্রকাশ হয়েছে) পুরো কুরআন করেছেন। খাদেমুল ইসলাম পাবলিকেশান্স, ১৯৮২। ৩০০ পৃ।
মুহম্মদ আব্দুল মজিদ।
- কোরান শরীফ। কলিঃ গ্রন্থকার, ১৯০৭। পুর্ণ। আ!
মাওলানা আবুল হাসান মোঃ, আব্বাস আলী, ১৮৫৯-১৯৩২। চন্ডীপুর।
বাদুড়িয়া, ২৪ পরগনা।
- কুরআনের বঙ্গানুবাদ। ১-৭ খণ্ড, কলিঃ আলতাফী প্রেস, ১৯০৮। ৫+২২২ পৃ। খণ্ড ৮-৩০ (একত্রে) : ১৯০৯। ৭৫৪ পৃ। ১২-৩০ পারা একত্রে কলিঃ আলতাফী প্রেস, ১৯০৯। ৯৬০ পৃ। ৫ম সংস্করণ ১৯৮৩। (মূল আরবীর নীচে শাহ রফি উদ্দিন, ১৭৪৯-১৮৩৩ কৃত উর্দু তরজমা ও এর নীচে বাংলা অনুবাদ। পাশে মাওলানা বাবর আলী, ১৮৭৪-১৯৪৬, সাহেবের বিস্তৃত টিকা রয়েছে)।
রেভারেন্ড উইলিয়াম গোল্ডস্যাক, ১৮৬১-১৯৫০।
- কোরআন। কলিঃ খৃষ্টান সাহিত্য সমিতি, ১৯০৮-২০। (পারা হিসাবে) অন্য মুদ্রণঃ কলিঃ খৃষ্টান সাহিত্য সমিতি,....। ২ খণ্ড। ১১৯৩ পৃ।
খোন্দকার আবুল ফজল আব্দুল করীম, ১৮৭৫-১৯৪৭। সেহড়াতৈল, টাঙ্গাইল।
- কুরআন শরীফ। ১ম খণ্ড : টাঙ্গাইল, অনুবাদক, ১৯১৪। ২১৭ পৃ। পারা : ১-৪, টাঙ্গাইল : গ্রন্থাকার, ১৯১৪-২০। (আরবী ছাড়া) অন্য সং : পারা ১-৪ : কলিঃ গ্রন্থকার, ১৯২৯। (আরবীসহ) পঞ্চবিধ সংস্করণঃ সমগ্র কুরআন শরীফ।
১। আরবী-বাংলা সং। ২। আরবী-উর্দু সং। ৩। আরবী সং। ৪। বাংলা সং। ৫। উর্দু সং।
মাও আব্দুল হাকিম, ১৮৮৭-১৯৫৭। ফরিদপুর।
Ñ আল-কুরআনুল হাকিম : মূল আরবীসহ বিশুদ্ধ ও বিস্তারিত তফসীর। ৩ খণ্ড।
- কোরান মঞ্জিল, ১৯৫৮। (সুদীর্ঘ ১৫ বছরের সাধনার ফর। প্রথমে পারা হিসাবে (১৯২২-৩৮) প্রকাশিত হয়। ১ম পারা : কলিঃ ফাজেল এন্ড সন্স, ১৯২২। ৫৮ পৃ। অন্য মুদ্রণ : কলিঃ ওসমানিয়া লাইব্রেরি, ১৯৭৯-৮০। ৩ খণ্ড। (যুগ্ম-অনুবাদক : মাওলানা মোঃ আলী হাসান।)
ফজলুর রহিম চৌধুরী, ১৮৯০-১৯৩০। উলানিয়া, বরিশাল।
Ñ কুরআন শরীফের বাংলা তরজমা। ২ খণ্ড। কলিঃ ফজলুল করিম চৌধুরী, ১৯৩০। ৪৫২+৫০০ পৃ। (আরবী ছাড়া)
- কোরান শরীফ : বাঙ্গালা অনুবাদ।
নকীব উদ্দীন খান, ১৮৮৪-১৯৭৮। বাদপুর, বসিরহাট।
- কোরান শরীফের বঙ্গানুবাদ। পারা হিসাবে ১৯৩৮-৪৬। ১৫৪৪ পৃ।
(মাওলানা মুসা ও মাওলানা রফিকুল ইসলাম লেখককে সাহায্য করেন)
মৌলভী মুহাম্মদ গোলাম আকবর, ১৮৯৩-১৯৫৬। কটি, শালিখা, যশোর।
- সমগ্র কোরআনের অনুবাদ। অপ্রকাশিত।
মাওলানা আনিসুর রহমান মুর্শিদাবাদ, ১৯০২। সুজানগর, মুর্শিদাবাদ।
- কোরানের অনুবাদ। অপ্রকাশিত।
মাওলানা ওসমান গনি, ১৮৯০। সালদা, বর্দ্বমান।
- কোরান শরীফ : বাংলা হরফে মূল আরবীসহ। ঢাকা। ১৩০০ পৃ।
- কুরআনের বঙ্গানুবাদ। কলিঃ এলায়েন প্রেস, ১৯৪৭। ১২৭৪ পৃ। (পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ)
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ১৮৮৫-১৯৬৯।