Articles

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান





বাংলায় কুরআনের অর্থানুবাদ ও তাফসীর: প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান





যাবতীয় স্তুতি ও প্রশংসা কেবল সেই মহান রব আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের চলার পথের পাথেয় হিসেবে নাযিল করেছেন মহগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম। আর ইসলামের জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়নকারী রাসূল হিসেবে পাঠিয়েছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তাই আমরা সর্বদাই দরূদ ও সালাম পেশ করি প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি।





মাস কয়েক আগে দৈনিক সমকালের সহসম্পাদক শ্রদ্ধেয় মুফতি এনায়েতুল্লাহ ভাই ফোন দিয়েছিলেন একটি লেখা চেয়ে। এবার অবশ্য তাঁর পত্রিকার জন্য নয়; গাজীপুর থেকে প্রকাশিতব্য তাফসীর বিষয়ক একটি সাময়িকীর জন্য। বিষয় : বাংলাদেশে পবিত্র কুরআনের তাফসীর চর্চায় উলামায়ে কিরাম। তিনি আমাকে এ জন্য সর্বোচ্চ দশদিন সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। কিন্তু দশদিন একশ দিন পেরিয়ে যাবার পরও আমি এ বিষয়ে লেখা তৈরি করতে পারি নি। কারণ, আমার সদিচ্ছা বা আন্তরিকতার ঘাটতি নয়।





ঘটনা হলো, এ বিষয়ে তথ্য খুঁজতে গিয়ে আমাকে হতাশ হতে হয়। ইন্টারনেটে নানা উপায়ে নানা শিরোনামে সার্চ দিয়েও বাংলা ভাষায় কুরআনের তরজমা বা তাফসীর সংক্রান্ত তেমন কোনো তথ্য পেলাম না। নানা পত্র-পত্রিকা এবং বই পুস্তক ঘেঁটেও তেমন কিছু পাওয়া গেল না। বিভিন্ন তরজমা ও তাফসীরের ভূমিকা দেখে বিচ্ছিন্ন কিছু তথ্য পেলাম। যেখানে যা-ই পেলাম তা-ই নোট করে ফেললাম। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের শীর্ষ খবরের কাগজ দৈনিক প্রথম আলোর শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকীতে ‘বাংলায় প্রথম কোরআন শরীফ’ শীর্ষক একটি গবেষণামূলক নিবন্ধ দেখতে পেলাম।





নিবন্ধকার আখতার হুসেন তাতে লিখেন, ‘বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়ের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফ-এর বাংলায় প্রথম অনুবাদের সোয়া শ বছর পেরিয়ে গেছে আজ থেকে এক বছর আগে। একেবারে নীরবে। কাউকে কিছু জানান না দিয়ে। অথচ গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) ছয় বছর দীর্ঘ (১৮৮১-১৮৮৬) কঠোর ও একাগ্র শ্রমে যখন কোরআন শরিফ-এর অনুবাদের কাজ শেষ করেছিলেন, তখন সেটা গোটা বাংলা ভাষাভাষী সমাজে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিক ঘটনা তো বটেই। কোরআন শরিফ-এর সঠিক অনুবাদ সেই প্রথম। অমন পরিশ্রমসাধ্য কাজের দৃষ্টান্ত সত্যিই এক বিরল ঘটনা। অবশ্য মাওলানা মহিউদ্দিন খান নামের একজন বিশিষ্ট আলেম পবিত্র কোরআন শরিফ-এর প্রথম বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বলে যে দাবি করা হয়, তার অনুকূলে তেমন জোরালো কোনো সমর্থন বা তথ্য পাওয়া যায় না।’[1]





কী আশ্চর্য দাবি ভাই গিরিশচন্দ্রই নাকি কুরআনের প্রথম বঙ্গানুবাদকারী! এর চেয়ে বড় বিস্ময়ের ব্যাপার আখতার হুসেনের দাবি এটিই নাকি কুরআন শরীফে প্রথম সঠিক অনুবাদ! যুগপৎ বিস্ময় ও হাস্যকর তথ্য হলো তার পরেরটি। মহিউদ্দিন খান নামের একজন বিশিষ্ট আলেম নাকি প্রথম অনুবাদের দাবি করেছেন? বুঝলাম না একটি শীর্ষ দৈনিকে প্রকাশিত গবেষণার এই নমুনা! মাওলানা মহিউদ্দিন খান কবে এ দাবি করলেন? কোথায় করলেন এ দাবি? তিনি তো এখনো জীবিত আছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় তিনি তো হেসে খুন হবেন। তিনি বরং মাআরেফুল কুরআন নামক উর্দূ তাফসীরের অনুবাদক। গিরিশচন্দ্র সেনের জন্ম ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে আর মদীনা সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন খানের জন্ম ১৯৩৬ সালে। অর্থাৎ ভাই গিরিশের এক শতাব্দী পর। উপরন্তু লোকটি এখনো জীবিত এবং বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত এক চরিত্র। এই লোকটিকে শতাব্দী আগের একটি লোকের সঙ্গে তুলনায় আনেন কী করে? এই সামান্য তথ্যটি যিনি জানেন না, তিনি আবার কেবল গবেষক! এই না হলে অসৎ গবেষণা!





লেখাটির নিচে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সে সুযোগ পাই নি। এদিকে উল্লেখিত অনুরোধের পর বলতে গেলে এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়েই এই লেখার সূত্রপাত। আর বাংলাভাষায় অসংখ্য তরজমা ও তাফসীর প্রকাশ হলেও প্রসিদ্ধ কিছু তরজমা ও তাফসীর ছাড়া অধিকাংশই রয়ে গেছে আড়ালে। ইন্টারনেটের যুগে ইন্টারনেটে প্রসিদ্ধ অনেক তাফসীরই এখনো রয়ে গেছে অনুপস্থিত। সেসবের ওপর আলো বিক্ষেপণও এই নিবন্ধের অন্যতম উদ্দেশ্য। চলুন মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।





ইসলাম কোনো আচারসর্বস্ব ধর্ম নয়। এর প্রকৃতি হলো প্রচারধর্মী। এর আবেদন শ্বাশত এবং বিশ্বজনীন। অতএব কুরআনের বাণীও গোটা বিশ্বমানবতার জন্য। এক গতিশীল, প্রাণোচ্ছল, ঋব্ধ ও সমৃদ্ধ ভাষা আরবী। এ ভাষাকেই বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ আল-কুরআনের জন্য নির্বাচিত করেছেন। অনাগত কালের মানুষ যাতে মূল আরবী ভাষা থেকেই কুরআনের পথনির্দেশ লাভ করতে পারে। সেহেতু মহান রব আল্লাহ কুরআন নাযিল করে তাকে কিয়ামত অবধি সংরক্ষণ ও অবিকৃত রাখার দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন,





﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [سورة الحجر: ٩]





‘আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক।’ {সূরা আল-হিজর, আয়াত : ৯}





আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হলেও কুরআনের আবেদন বিশ্বজনীন হওয়ায় বিশ্বমানবতার সামনে এর বাণী পৌঁছে দেয়া মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম অবশ্য কর্তব্য ছিল। সেহেতু তিনি তাঁর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শাসনকর্তাদের নামে পত্রাদির মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত পাঠান। এ ব্যাপারে ভাষার বিভিন্নতাকে অন্তরায় সৃষ্টি করতে দেন নি। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরবী না জানা মানুষের কাছে কুরআনের বাণী পৌঁছে দেবার তাগিদে অনারবী ভাষায় কুরআনের অনুবাদের ধারা মহানবীর জীবদ্দশায় সূচিত হয়ে আজো অব্যাহত আছে।





তবে এ কথা মুসলমানরা ভালোভাবে জানেন, অনুবাদ কোনো অবস্থাতেই মূল কুরআনের বিকল্প হতে পারে না। তাই কুরআনের অনুবাদকে কোনো অবস্থায় ‘বাংলা কুরআন’ বলার অবকাশ নাই। কেননা কুরআন হলো জিবরাঈল মারফত প্রেরিত ভাষা ও অর্থের সমন্বয়ে আল্লাহর বাণী। সুতরাং মূল আরবী ভাষায় কুরআন পাঠ করতে এবং কুরআনের মূল বাণী বুঝতে সক্ষম হওয়া পর্যন্ত কুরআনের অনুবাদের মাধ্যমে উপকৃত হওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়। এমন চেতনা মাথায় রেখেই নানাভাষী মুসলিম মনীষী ও পণ্ডিতবর্গ স্বতস্ফূর্তভাবে পবিত্র কুরআন অনুবাদে এগিয়ে এসেছেন। পাশাপাশি অনেক অমুসলিম পণ্ডিতও ধর্ম প্রচারের অভিপ্রায়ে এ মহাগ্রন্থ অনুবাদে হাত দেন। সাম্প্রতিক এক জরিপে জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৭০টি প্রধান ভাষায় আল কুরআন অনূদিত হয়েছে। অমুসলিমদের ভাষাতেও পর্যাপ্ত অনুবাদ হয়েছে।[2]





আমাদের বাংলাভাষী মানুষদের আরবী ভাষাজ্ঞান কম থাকায় আমরা আল্লাহ তা‘আলার কালাম কুরআন মাজীদ বুঝতে পারি না। এ কারণেই বাংলাভাষী মুসলিমদের মধ্যে কুরআনের জ্ঞান প্রায় নেই বললেই চলে। অনুবাদ পড়ে কুরআনে বর্ণিত আলোচনা সম্পর্কে জানার প্রবণতাও আমাদের মধ্যে খুবই কম। আর এ কারণে শিরক, বিদ‘আত ও অন্যান্য পাপে লিপ্ত হয়েছে বাংলার মুসলিম সমাজ।





শুধু অনুবাদ পড়ে এর মর্ম বুঝা খুবই কঠিন। তবে আল্লাহ তা‘আলার বাণীর তরজমার সঙ্গে তাফসীর পাঠ করলে সে সম্পর্কে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি। এ পবিত্র গ্রন্থ আমরা যত বেশি পড়ব এবং বুঝতে চেষ্টা করব, দীন ইসলাম সম্পর্কে আমাদের ধারণা ততই পরিষ্কার হবে। আমরা হিদায়াতের সন্ধান পাব। আমাদের পক্ষে সহজতর হবে আল্লাহ তা‘আলার দেয়া সরল ও সঠিক পথে চলা।





বলাবাহুল্য, আল্লাহ তা‘আলার পবিত্র কালামকে আমরা মাতৃভাষার মাধ্যমে যেভাবে বুঝতে পারব, অন্য কোনো ভাষায় তা সম্ভব নয়। কারণ মানুষ তার মনের ইচ্ছা একমাত্র আপন মাতৃভাষায়ই পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ করতে পারে। যে কোনো বিষয় বুঝতে সহজ হয় এ মাতৃভাষায়। এ কারণেই তো আল্লাহ প্রতিটি নবীকে নিজ ভাষায় দাওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে,





﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوۡمِهِۦ لِيُبَيِّنَ لَهُمۡۖ فَيُضِلُّ ٱللَّهُ مَن يَشَآءُ وَيَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٤ ﴾ [ابراهيم: ٤]





‘আর আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার কওমের ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়, সুতরাং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ দেখান। আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ {সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ০৪}





বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের যে হতাশা, অস্থিরতা ও নৈতিক অধঃপতন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে কুরআনের অনুসরণ ছাড়া এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কবি ইকবালের একটি উর্দূ কবিতার কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য। তাঁর কবিতার চরণের অনুবাদ করেছিলাম আমি এভাবে :





‘কুরআন ছেড়ে মুসলমানে ছেড়ে তো আল্লাহকে,





তাই অপমান হচ্ছে নিজে করছে হেয় ধর্মকে।’[3]





কুরআনই আমাদের সত্যের পথে এবং শান্তির রথে পরিচালিত করতে পারে। এজন্য আমাদের কুরআন পড়তে হবে, বুঝতে হবে এবং কুরআনের নির্দেশিত পথে চলতে হবে। অথচ দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা কুরআনকে বুঝতে চেষ্টা করি না, তাই আমাদের ছেলে-মেয়েরা শুধু কুরআন তিলাওয়াত করে আনন্দ পায় না। কারণ, তারা তা বুঝে না। তার মর্ম তার স্পর্শ করে না। এ জন্যই প্রয়োজন সহজবোধ্য কুরআনের অনুবাদ এবং তাফসীর।





আল-কুরআন আরবী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম অবদান। আর কিছুর সঙ্গে এর তুলনা চলে না। আর এটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ। মানব রচিত কোনো উক্তি, গদ্য বা কাব্য নয়। তাই তো উমর রাদিআল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের আগে খোলা তরবারি নিয়ে আপন ভগ্নি ও ভগ্নিপতিকে হত্যা করতে গিয়ে সূরা ত্বহার আয়াত তিলাওয়াত শুনে অবাক হয়ে বলে উঠেছিলেন, কোথায় মুহাম্মাদ ? আমাকে নিয়ে চল তাঁর কাছে। অতপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কালিমা শাহাদাহ পাঠ করে ইসলাম কবূল করেছিলেন। তাই কুরআনের সে অনুপম ভাষার সৌন্দর্য কোনো মানুষ অনুবাদে আনবে কী করে ? সে সাধ্য কোনো মানুষেরই নেই। তাই অনুবাদকগণ চেষ্টা করেছেন কেবল কুরআনের অনুবাদকে সহজবোধ্য করার।





আল-কুরআন মানব জাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ আসমানী কিতাব। এ কিতাব কিয়ামত পর্যন্ত মানব জাতির একমাত্র হিদায়াত তথা পথনির্দেশক গ্রন্থ। মানুষকে সত্য ও সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য এ কিতাব আল্লাহ তা‘আলার এক অশেষ অবিনশ্বর নি‘আমানত। তাই সকল মুসলিমেরই উচিত পবিত্র কুরআনে তিলাওয়াত এবং এর অর্থ উপলব্ধির চেষ্টা করা। পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং তদনুযায়ী জীবন গঠন করতে হলে সকলকেই নিজ নিজ মাতৃভাষায় আল-কুরআন বুঝতে হবে। সে চিন্তায়ই বাংলা ভাষায় স্বার্থক ও নির্ভরযোগ্য অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা অমলিন থাকবে।





বাংলায় কুরআন অনুবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস





অনুবাদ বা ভাষান্তর এমনিতেই একটি দুরূহ কাজ। আল-কুরআনের মতো একটি আসমানী গ্রন্থের ব্যাপারে জটিলতার সঙ্গে স্পর্শকাতরতার বিষয়ও জড়িত। মানব রচিত গ্রন্থের বেলায় বক্তার কথার হুবহু ভাষান্তর না হলে তেমন কি-ই বা আসে যায়। বড় জোর বলা যায় অনুবাদক মূল লেখকের কথাটার সঙ্গে যথাযথ ইনসাফ করতে পারেন নি। কিন্তু আল-কুরআনের ক্ষেত্রে বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে অনুবাদের একটু হেরফের হলে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার কথাই বিতর্কিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এসব কারণেই মুসলমানদের মাঝে কেউই এক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আল-কুরআনের অনুবাদের ঝুঁকি নিতে চায় নি।





এমনকি বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মধ্য এশিয়ার আলেমরা ফতোয়ার মাধ্যমে তাতারি ভাষায় আল-কুরআনের যাবতীয় অনুবাদ প্রচেষ্টাকে বন্ধ করে রাখেন। আফ্রিকা মহাদেশে বিশষ করে নাইজেরিয়া ও নাইজারে হাউসা হচ্ছে আরবীর পর সর্বাধিক সমৃদ্ধ ভাষা। এই ভাষায় আলেমরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদের ভাষায় আল-কুরআনের অনুবাদকে এই বলে বন্ধ করে রাখেন যে, এতে আল-কুরআনের মর্যাদাহানী হতে পারে। এই মহাদেশের ক্যামেরুন রাজ্যের সুলতান সাঈদ নিজেও আলেমদের প্রবল বিরোধিতার কারণে বামুম ভাষায় কুরআনের অনুবাদ কাজ থেকে ফিরে আসেন। মুসলিম দুনিয়ার অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া বোর্ডও তো এই সেদিন পর্যন্ত আল-কুরআনের যাবতীয় অনুবাদকর্মের বিরোধিতা করে আসছিলো।





তারা ১৯২৬ সালে তুরস্কে উসমানী খেলাফত বিলুপ্তির পর তুর্কী ভাষায় আল-কুরআনের অনুবাদ প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেন। কুরআনের ইংরেজি অনুবাদক নওমুসলিম মার্মডিউক পিকথল যখন কুরআনের অনুবাদ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখন হায়দারাবাদের শাসক নিযাম তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিলেও আল আযহার কর্তৃপক্ষ এ উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করেন। অবশ্য দীর্ঘদিন পর হলেও মক্কাভিত্তিক মুসলিম সংস্থা রাবেতা আলামে ইসলামী আয়োজিত বিশ্বের সর্বমতের উলামা কুরআন অনুবাদের একটি ঘোষণাপত্রে সই করে এ পথের যাবতীয় বাধা অপসারণ করেন। কিন্তু এটা তো ১৯১৮ সালের কথা, মাত্র সেদিনের ঘটনা। অবশ্য এরও বহু আগে ইংরেজ লেখক জর্জ সেল কুরআনের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। ১৭৩৪ সালে এই অনুবাদ কর্মটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়। ১৭৬৪ সালে তার পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ মুদ্রিত হয়। ১৮২৫ সালে এটি পুনর্মুদ্রিত হয়।





যেমনটি আমি একটু আগেও বলে এসেছি যে, কুরআনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো, কুরআন অনুবাদের এই মোবারক ধারাটি স্বয়ং তাঁর হাতেই সূচিত হয়েছে যার ওপর এই কুরআন নাযিল হয়েছে। আমরা জানি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দাওয়াতী আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে দূত পাঠাতেন। তাঁর পাঠানো এসব চিঠিতে অবশ্যই একাধিক কুরআনের আয়াত লেখা থাকতো। যেসব দেশের রাজা বাদশাহরা আরবী বুঝতেন না রাসূলের দূত তাদের কাছে গোটা চিঠির সঙ্গে সেসব আয়াতের তরজমাও পেশ করতেন। এ কারণেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দূতকে যে দেশে পাঠাতেন তাকে আগেই সে দেশের ভাষা শিখতে বলতেন। অধিকাংশ নতুন এলাকায় তিনি পারদর্শী দোভাষীও পাঠাতেন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে সা‘দ বলেন, যে প্রিয়নবী তার ব্যক্তিগত সহকারী ওহী লেখক যায়েদ ইবন ছাবিত রাদিআল্লাহু আনহুকে সিরিয়ান ও হিব্রু ভাষা শেখার আদেশ দিয়েছিলেন। তাছাড়া আমীর ইবন উমাইয়া যে আবিসিনিয়ার সম্রাট নাজ্জাসীর কাছে লেখা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরবী চিঠিকে আমহারিক ভাষায় অনুবাদ করেছেন তারও একাধিক প্রমাণ ইতিহাস গ্রন্থে মজুদ রয়েছে।





রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় কুরআনের এসব আংশিক অনুবাদ ছিলো অনেকটা মুখে মুখে। কোথায়ও লিখিত আকারে এগুলোকে কুরআনের আয়াতের অনুবাদ হিসেবে কেউ সংরক্ষণ করেন নি। পরবর্তী সময়ে যখন কুরআনের বাণী নিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উৎসর্গিতপ্রাণ সাহাবীরা দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়লেন তখন এর প্রয়োজনীয়তা তীব্র হয়ে দেখা দিলো। কুরআনের বিষয়বস্তু ও ভাষাশৈলীর স্পর্শকাতরতার কারণে কুরআনের গবেষকরা প্রথম দিকে নানা আপত্তি উত্থাপন করলেও শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষায় কুরআন অনূদিত হতে শুরু করলো। এভাবেই কুরআনের আবেদন মূল আরবী ভাষার পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে বিভিন্ন ভাষায় ছড়িয়ে পড়লো।





বাইরের পরিমণ্ডলে এসে সম্ভবত ফার্সী ভাষায়ই সর্বপ্রথম কুরআন অনূদিত হয়েছে। প্রিয় নবীর ইনতিকালের প্রায় ৩৫০ বছর পর ইরানের সাসানী বাদশা আবু সালেহ মানসুর ইবন নূহ কুরআনের পূর্ণাঙ্গ ফার্সী অনুবাদ করেন। কুরআনের ফার্সী অনুবাদের এই বিরল কাজের পাশাপাশি তিনি মুসলিম ইতিহাসের প্রথম পূর্ণাঙ্গ তাফসীর গ্রন্থ ইমাম মুহাম্মদ ইবন জারীর আত-তাবারীর ৪০ খণ্ডে সমাপ্ত বিশাল আরবী ‘তাফসীর জামেউল বয়ান আত-তাওয়ীলূল কুরআন’-এর ফার্সী অনুবাদ করেন। আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী কুরআনের যে ফার্সী ভাষান্তর করেছিলেন তা ছিলো আরো ৮০০ বছর পরের ঘটনা। প্রায় একই সময়ে অর্থাৎ ১৭৭৬ সালে শাহ রফিউদ্দীন ও ১৭৮০ সালে শাহ আবদুল কাদের কুরআনের উর্দূ অনুবাদ করেন।





বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের কাজটি আসলেই অনেক দেরীতে শুরু হয়েছে। এর পেছনে কারণও ছিলো অনেক। প্রথমত আমাদের এই ভূখণ্ডে যারা কুরআনের ইলমের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন সেসব কুরআন সাধকদের অনেকেরই কুরআন শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র ছিলো ভারতের উর্দূ প্রধান এলাকার ঐতিহ্যবাহী দীনী প্রতিষ্ঠান দেওবন্দ, সাহারানপুর, নদওয়া, জামেয়াতুল ইসলাহ, জামেয়াতুল ফালাহসহ উর্দূ ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এর সব কয়টির ভাষাই ছিলো উর্দূ কিংবা ফার্সী, তাই স্বাভাবিকভাবেই এসব দীনি প্রতিষ্ঠান থেকে যারা উচ্চতর সনদ নিয়ে বের হন তাদের কুরআন গবেষণার পরিমণ্ডলও সে ভাষার বাইরে ছড়াতে পারে নি।





দ্বিতীয়ত পলাশীর ট্রাজেডির ফলে আমাদের এ অঞ্চলে কুরআন গবেষণার কাজটি নানারকম পঙ্গুত্বের কারণে এক রকম দেউলিয়া হয়ে পড়েছিলো। ফলে বাংলা আসামে কুরআনের আশানুরূপ কোনো অনুবাদই হয় নি। তৃতীয় কারণ হিসেবে বাংলা মুদ্রণ যন্ত্রের কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৭৭৭ সালে মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার হলেও এ অঞ্চলের মুসলমানরা ১৮১৫ সালের আগে বাংলা মুদ্রণযন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত হবার কোনো সুযোগই পান নি।[4]





কে প্রথম বাংলায় পবিত্র কুরআন অনুবাদ করেছেন ?





হাফেজ মুনির উদ্দীন আহমদ লিখেন, ‘কে প্রথম কুরআনের বাংলা অনুবাদের সৌভাগ্যজনক এ কাজটি শুরু করেন তা নিয়ে আমাদের মাঝে বিভ্রান্তির অন্ত নাই। কে বা কারা আমাদের সমাজে এ কথাটা চালু করে দিয়েছে যে, ব্রাহ্মণ ধর্মের নব বিধান মণ্ডলীর নিষ্ঠাবান ধর্মপ্রচারক গিরিশ চন্দ্র সেন সর্ব প্রথম কুরআনের বাংলা অনুবাদ করেছেন। আসলে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরে যাদের সর্বময় আধিপত্য বিরাজমান তারাই যে কথাটা ছড়িয়ে তাতে সন্দেহ নেই। দুঃখ লাগে যখন দেখি আমাদের এ অঞ্চলের দু’একজন কুরআনের মুদ্রাকর ও প্রকাশকও তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ঐতিহাসিকভাবে অসমর্থিত এমনি একটি কথা অবাধে প্রচার করে চলেছেন। অথচ কুরআন ও কুরআনের শিক্ষার প্রতিটি ছাত্রই জানেন যে তার অনুবাদের পাতায় কুরআনের শিক্ষা সৌন্দর্য বাকধারার সঙ্গে ব্রাহ্মবাদের প্রচারনীতিতে কুরআনের প্রতি ক্ষমাহীন বিদ্বেষ ছড়ানো রয়েছে।





গিরিশচন্দ্র সেনের ৬ বছর আগে অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে আরেকজন অমুসলিম রাজেন্দ্রলাল মিত্র কুরআনের প্রথম পারার অনুবাদ করেন। কলকাতার আয়ুর্বেদ প্রেস নামক একটি ছাপাখানা থেকে এক ফর্মার (১৬ পৃষ্ঠা) এই অনুবাদটি ৫০০ কপি ছাপা হয়েছিলো।





১৮৮৫ সালে গিরিশচন্দ্র সেনের এই অনুবাদের প্রায় ৮০ বছর আগে অর্থাৎ ১৮০৮ সালে পূর্ব বাংলার রংপুর নিবাসী একজন সাধারণ কুরআনপ্রেমী মাওলানা আমিরুদ্দীন বসুনিয়া কুরআনের প্রথম বাংলা অনুবাদের কাজে হাত দেন। তিনি সে সময় কুরআনের আমপারার অনুবাদ সম্পন্ন করেন। এই ঐতিহাসিক তথ্যের সমর্থন রয়েছে ঢাকা ও কলকাতার প্রায় সব ক’জন কুরআন গবেষকের লেখায়। উভয় বাংলার প্রায় সব ক’টি কুরআন গবেষণা সংস্থা, প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানই এ ব্যাপারে একমত যে, মওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়াই সে সৌভাগ্যবান মানুষ যিনি বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের এই মহান কাজটির শুভ সূচনা করেন।





গত এক দশকে আমাদের দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের ইতিহাসের ওপর যেসব পিএইচডি থিসিস লেখা হয়েছে তাতেও এ তথ্য সমভাবে সমর্থিত হয়েছে। ১৮১৫ সালে বাংলা মূদ্রণ যন্ত্রের ব্যবহারের পরপর কলকাতার মীর্জাপুরের পাঠোয়ার বাগানের অধিবাসী আকবর আলী এ কাজে এগিয়ে আসেন। তিনিও মাওলানা আমীরুদ্দীন বসুনিয়ার মতো শুধু আমপারা ও সূরা ফাতেহার বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন তার অনূদিত অংশটি ছিলো পুথির মতো। তার এ অনুবাদটি কুরআনের কোনো মৌলিক অনুবাদও ছিলো না। তিনি যেটা করেছেন তা ছিলো ১৭৮০ সালে অনূদিত শাহ আবদুল কাদেরের উর্দূ অনুবাদের বাংলা। সরাসরি কুরআনের অনুবাদ নয় বলে সুধী মহলে এটা তেমন একটা স্বীকৃতি লাভ করে নি। আসলে ব্যক্তি যতো গুরুত্বপূর্ণ হোন না কেন তিনি যদি কুরআনকে কুরআন থেকে অনুবাদ না করেন তাহলে তাকে কখনো কুরআনের অনুবাদ বলে চালিয়ে দেয়া উচিত নয়।’[5]





এ ব্যাপারে মাসিক আল-হুদা নামক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত নিবন্ধে এক নিবন্ধকার লিখেন, ‘অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাওলানা আমীর উদ্দীন বসুনিয়া ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ বাংলা ১২১৫ অব্দে তিনি প্রথম আমপারার তরজমা প্রকাশ করেন। যার আকার ছিল ডিমাই ১২ পেইজ ১৬৮ পৃষ্ঠা। অথচ আমাদের দেশে এই তথ্য আবিষ্কারের অভাবে গিরিশচন্দ্র সেনকে (১৮৩৫-১৯১০) কুরআনের প্রথম অনুবাদক বলা হয়। কিন্তু গিরিশচন্দ্র সেনের আগে রাজেন্দ্রনাথ মিত্র কুরআনের অনুবাদ করেন ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৯ মার্চ। গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে এবং সমাপ্ত হয় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে। রাজেন্দ্রনাথ মিত্রের অনুবাদ পূর্ণাঙ্গ ছিল না। তার অনুবাদ ছিল কয়েক খণ্ড।





১৮৮৩ সালে টাঙ্গাইলের করটিয়া থেকে মৌলভি নঈমুদ্দিন (১৮৩২-১৯০৮) আকবারে ইসলামিয়া নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন, আর এই পত্রিকার মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার দূর ও আল-কুরআনের অনুবাদ প্রকাশ করতে থাকেন। তার অনূদিত কুরআন শরীফের ১০ পারা পর্যন্ত অনুবাদ সমাপ্ত করে তিনি ইন্তেকাল করেন ১৯০৮ সালের ২৩ নভেম্বর। আকবারে ইসলামিয়া ১৮৮৩ সাল থেকে ১৮৯৩ পর্যন্ত চলছিল। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সম্পাদক শেখ আবদুর রহীম (১৮৫৯-১৮৩১) তৎকালে টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত আকবারে ইসলামিয়া ও মৌলভি নঈমুদ্দিনের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।





কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) তার সুশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতি গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম মৌলভি নঈমুদ্দিন কুরআন মাজীদের বঙ্গানুবাদ করেন। তিনি ১০ পারা পর্যন্ত অনুবাদ করেন এবং মুদ্রণ শেষ হওয়ার আগেই ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ নভেম্বর লোকান্তরিত হন। কবি আবদুল কাদির তার গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায়ে লিখেন ‘সমগ্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ করেন মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম মাওলানা মোহাম্মদ আব্বাস আলী (১৮৫৯-১৯৩২) কলকাতা ৩৩ নম্বর বেনেপুকুর রোড, আলতাফি প্রেসে মুন্সি করিম বকসের দ্বারা মুদ্রিত ১৩১৬ বাংলা সন। আমপারা পর্যন্ত ৩০ পারার অনুবাদ। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯৭৬। মূল আরবি পাঠের নিচে উর্দু তরজমা এবং তার নিচে বাংলা অনুবাদ।





বর্ডারের দুই পাশে উর্দু তাফসীর ও বাংলা টীকা দেয়া হয়েছে। অতপর ওই তাফসিরের শেষে অনুবাদক যা বলেছেন তার উদ্ধৃতি, ‘ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ অমৃতময় কুরআন… আলেমরা ফার্সি, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। কিন্তু বাংলার মুসলমানদের বোধগম্য সরল বাংলা ভাষায় কোনো অনুবাদ অদ্যাবধি পরিদৃষ্ট হয় নি। তাদের শ্রুতিমধুর কুরআনের বাক্য সুধাপানে বঞ্চিত ছিল। তাদের সেই অভাব বিমোচনের জন্য এই অনুবাদ প্রকাশিত হলো।’





অতপর পঞ্চম অধ্যায়ে এনেছেন খান বাহাদুর মৌলভি তসলীমউদ্দিন আহমদের (১৮৫২-১৯২৭) অনূদিত তাফসিরের কথা। তার অনূদিত কুরআনের প্রথম খণ্ড (প্রথম ১০ পারা) প্রকাশিত হয় ১৩২৯ বঙ্গাব্দে তথা ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে এবং দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৩৩০ বঙ্গাব্দে বা ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে (দ্বিতীয় ১০ পারা) এবং তৃতীয় খণ্ড বা শেষ খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম খণ্ড ছিল ৪৫৮ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় খণ্ড ৪৫৮ পৃষ্ঠা এবং তৃতীয় খণ্ড ৫২১ পৃষ্ঠা। এই অনুবাদে মূল আরবি দেয়া ছিল না, কিন্তু আয়াত ও রুকু নম্বর দেয়া ছিল। ষষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি তাদের সবার নামোল্লেখ করেছেন যারা আল-কুরআনের পরবর্তী অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন। মৌলভি আবদুল হাকিম ও আলী হাছান ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণাঙ্গ কুরআনের অনুবাদ করেন। মৌলভি নকীবুদ্দিন খাঁর (১৮৯০-১৯৭৮) অনুবাদ ৩০ পারা ৩০ খণ্ডে ছিল। মাওলানা মো: রুহুল আমীন, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মৌলভি এয়ার আহমদ, মৌলভি মো: তৈমুর, ফজলুর রহিম চৌধুরী, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর কুদরত-এ-খুদা, অধ্যাপক আবুল ফজল প্রমুখ কুরআনের অংশ বিশেষের অনুবাদ করেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে কবি নজরুল কাব্যে আমপারা প্রণয়ন করেন।





কুরআনের বহুবিধ অনুবাদ ও তাফসির সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা-পর্যালোচনা ও গবেষণা সাহিত্য যিনি প্রকাশ করেন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক ডিন ড. মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান। তার অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষায় কুরআন চর্চা’ এই গ্রন্থে তার গবেষণালব্ধ তথ্যে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের পথিকৃৎ বসুনিয়া’ বাক্যটি থেকেই অনুমিত হয় যে তিনিও তার প্রাপ্ত তথ্যে মাওলানা আমীরউদ্দিন বসুনিয়ার প্রথম বঙ্গানুবাদের তথ্য পেয়েছেন।’[6]





কুরআনের প্রথম অনুবাদক মওলানা আমীরুদ্দিন বসুনিয়া কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করে যেতে পারেন নি। পরবর্তী সময়ে গিরিশচন্ত্র সেনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদকর্ম যা তখন বাজারে প্রচারিত ছিলো তাও ছিলো নানা দোষে দুষ্ট, তাই তার অনুবাদের মাত্র ২ বছরের মাথায়ই কুরআনের বিশ্বস্ত ও পূর্ণাঙ্গ অনুবাদকর্ম নিয়ে হাযির হয়েছেন বিখ্যাত কুরআন গবেষক মাওলানা নায়ীমুদ্দীন। এর আগে কলকাতার একজন ইংরেজ পাদ্রীও কুরআনের অনুবাদ করেছিলেন। শোনা যায় মাওলানা আমিরুদ্দীন বসুনিয়া থেকে গিরিশচন্দ্র সেন পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮০৮ থেকে ১৮৮৫ সালের মধ্যে আরো ৯ জন ব্যক্তি কুরআন অনুবাদ করেছেন। তা ছাড়া ২০১১ সালকে বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের ২০০ বছর পূর্তি বছর হিসেবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় এ বিষয়ে আরো অনেক অজানা তথ্য জনসমক্ষে আসতে শুরু করেছে।[7]





সঠিকভাবে কুরআন বুঝতে যা জানা দরকার





কুরআন মাজীদের সঠিক মর্ম ও উদ্দেশ্য জানার জন্য অথবা শুদ্ধভাবে তার অর্থ ও তাফসীর বুঝার জন্য শুধু আরবী ভাষা জ্ঞান ও সাহিত্যে পারদর্শিতা যথেষ্ট নয়। বরং এর জন্য চাই, আরবীর বেশ কিছু শাস্ত্রে সিদ্ধহস্ত হওয়া। কুরআন বিজ্ঞানের মহাজ্ঞানী আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘সঠিকভাবে কুরআন মাজীদের অর্থ ও তাফসীর বুঝার জন্য পনের রকমের জ্ঞানে পারদর্শী হতে হয়। যথা, আরবী ভাষা, ব্যাকরণ, ইলমে ছারফ, ইলমে ইশতিকাক, ইলমুল বায়ান, ইলমে বাদী‘, ইলমুল কির‘আত, ইলমু উসূলিদ্দীন, ইলমু উসূলিল ফিকহ, আসবাবে নুযূল, কাসাস বা ঘটনাবলী, নাসেখ ও মানসূখ, ইলমে ফিকহ, ইলমুল হাদীস এবং ইলমে লাদুনী। এসব জ্ঞান হলো তাফসীরে কুরআনের অপরিহার্য মাধ্যম। এসব জ্ঞানে যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন ব্যতিরেকে কেউ কুরআনের তাফসীর করলে তা হবে ‘তাফসীর বির রায়’ তথা মনগড়া তাফসীর বা ব্যাখ্যা, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।’[8]



Recent Posts

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 3

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 2

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 1