Articles

ইলমে দীন অর্জনের পথ ও পদ্ধতি





সালেহ ইবন আবদুল আযীয আলে শাইখ





অনুবাদক : মুহাম্মাদ নূরুল্লাহ তারীফ





সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া





المنهجية في طلب العلم





(باللغة البنغالية)





الشيخ صالح بن عبد العزيز آل الشيخ





ترجمة: محمد نور الله تعريف





مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا





সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............





দীনী ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি ও পন্থা কোনটি এ বিষয়টি অনেকের কাছেই অস্পষ্ট। ইলম অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন ও পূর্ণ আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকে ইলম অর্জনের কাঙ্ক্ষিত পথে অগ্রসর হতে ব্যর্থ হন সঠিক পথ না জানার কারণে। প্রবন্ধটি এ বিষয়ে একটি নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটাবে বলে আমাদের আশাবাদ।


মূলত প্রবন্ধটি সৌদি আরবের ধর্মমন্ত্রী ও প্রখ্যাত আলেম শাইখ সালেহ ইবন আব্দুল আযীয আলে শাইখের একটি লেকচারের অনুবাদ।





ইলমে দীন অর্জনের পথ ও পদ্ধতি





সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ও তাঁর পরিবার পরিজন ও সঙ্গী-সাথীদের প্রতি। হে আল্লাহ! আপনি যাদেরকে হিদায়াত দিয়েছেন আমাদেরকে তাদের অর্ন্তভুক্ত করে নিন। আপনি যাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করেছেন আমাদেরকে তাদের দলভুক্ত করুন। যাদেরকে আপনার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন আমাদেরকে তাদের তালিকাভুক্ত করে নিন। হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরগুলোকে পরিশুদ্ধ করে দিন। আমাদের আমলসমূহকে উত্তম করে দিন। আমাদেরকে সঠিক কথা বলার তাওফীক দিন। আপনি যা পছন্দ করেন ও ভালবাসেন তা আমাদেরকে পালন করার তাওফীক দিন। আমাদেরকে আপনার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারী বানিয়ে দিন।





আজ রাত্রে আমরা ইলম অর্জনের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপক্রমনিকা পেশ করব। এই বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে- আমরা তরুণসমাজের মধ্যে ইলম অর্জনের ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করছি। আল্লাহ তাদেরকে মোবারকময় করুন। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই জানে না তারা কোন পথে অগ্রসর হবে, কীভাবে ইলম অর্জন করবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইলম অর্জনের পথে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে। এমনকি বছরের পর বছর ব্যয় করে। পরিশেষে দেখে যে, একই সময় ব্যয় করে অন্যেরা যতটুকু ইলম অর্জন করতে পেরেছে সে ততটুকু পারে নি। এর কারণ হচ্ছে, সেই ছাত্র ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে পারে নি। যে পদ্ধতি অনুসরণ করলে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে। আল্লাহ তার তাকদীরে যতটুকু ইলম অর্জন লিখে রেখেছেন ততটুকু হাসিল করতে পারবে। যার মাধ্যমে সে নিজে উপকৃত হবে এবং অন্যদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে। যে পদ্ধতির মাধ্যমে তার ইলম হবে মজবুত ভিত্তিনির্ভর। যার ভিত্তিতে সে অন্যকে শিক্ষা দিতে পারবে। যে ইলমের মধ্যে কোনরূপ সন্দেহ ও সংশয়ের রেশ থাকবে না।





অনেক তরুণ আছে- যারা কিছুক্ষণ হাদীস, কিছুক্ষণ তাফসীর, কিছুক্ষণ ফিকহ এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে পড়াশুনা করে। তারা ইলমের আসরগুলোতে নিয়মিত হাযির হয়। একবছর বা দুইবছর একজন শাইখের ক্লাশ করার পর যখন নিজেকে পর্যালোচনা করে তখন দেখতে পায় যে, এতদিন যে বিষয়ের ক্লাশে সে হাযির হয়েছে আসলে ঐ বিষয়টি সে বুঝে না। অথবা যতটুকু সে অর্জন করেছে তা যৎসামান্য অথবা তার অর্জিত ইলমের ভিত্তিমূল খুব দুর্বল। এর উপর নির্ভর করে তার পক্ষে নতুন কিছু বুঝা বা গবেষণা করা সম্ভবপর নয়। কারণ কী! কারণ হলো, ইলম অর্জনের সঠিক ক্রমধারা অনুসরণ না-করা। তালিবে ইলম বা জ্ঞান অর্জনকারীকে ইলম হাসিলের সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ক্রমধারা অনুসরণ করতে হবে। সঠিক ক্রমধারা অনুসরণ না করলে সে ইলমের পথ থেকে ছিটকে পড়ে যাবে। এ কারণে আমরা অনেক তালিবে ইলমকে ইলম অর্জনের পথ ছেড়ে দিতে দেখি। কয়েক বছর হয়তো ইলম অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যায়। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। মাস চলে যায়, বছর চলে যায় কিন্তু তারা সাধারণ মানুষই থেকে যায় অথবা পাঠক হিসেবেই থেকে যায়, এর গণ্ডি অতিক্রম করতে পারে না। যে ছাত্র ইলমের পথে অগ্রসর হতে চায় আমরা কামনা করি তার মধ্যে দু’টি বৈশিষ্ট্য থাকবে:





এক: আমাদের পূর্বসুরীগণ যে ক্রমধারা অবলম্বন করে ইলম অর্জন করে আলেম হয়েছেন, সেই ক্রমধারা বজায় রেখে ইলম অর্জন করবে।





দুই: নিজের সময়, শ্রম সবকিছু ইলমের জন্য বিলিয়ে দিবে; কোনোক্রমেই হতোদ্দম হবে না।





খতিব আল-বাগদাদী তার আল-জামে‘ লি আখলাকির রা-ওয়ী ও আ-দা-বিস্‌ সা-মি‘ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, একবার এক ছাত্র হাদীস অর্জনে মনোনিবেশ করেন। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে এ পথে আসেন। ব্যক্তিগতভাবে হাদীসের উস্তাদদের নিকট গিয়ে ও সামষ্টিক আসরগুলোতে উপস্থিত হয়ে হাদীস অর্জনে নিমগ্ন হন। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি দেখলেন যে, তিনি বেশি কিছু শিখতে পারেন নি। তার অর্জিত ইলম যৎসামান্য। তখন তিনি এই ভাবনা থেকে ইলম অর্জন ছেড়ে দিলেন যে, এই ইলম অর্জন তার জন্য নয়, তার বোধশক্তিতে দুর্বলতা আছে অথবা তিনি এই ইলমের উপযুক্ত নন। ইলম অর্জন ছেড়ে দেওয়ার বেশ কিছুদিন পর একবার তিনি একটি বড় পাথরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার সময় তিনি খেয়াল করলেন যে, ফোঁটা ফোঁটা পানি এ পাথরের উপর পড়ে পাথরের গায়ে গর্তের সৃষ্টি করেছে। এ দৃশ্যটি তার চিন্তার জগতে রেখাপাত করে। তিনি ভাবতে লাগলেন: পানি এত দুর্বল হওয়ার পরেও এ কঠিন পাথরকে গর্ত করে ফেলেছে। আমার বিবেক-বুদ্ধি বা অন্তর এই পাথরের চেয়ে তো কঠিন নয়। আর ইলম তো এই পানির চেয়ে দুর্বল নয়। এই ঘটনার পর তিনি পুনরায় ইলমের পথে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ফিরে এসে সত্যি সত্যি তিনি ইলমে দীনে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন এবং খ্যাতিমান আলেম হন।





এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি, ইলম অর্জনের জন্য ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। হতোদ্দম হয়ে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। এই কথা বললে চলবে না যে, আমি পড়েছি; বুঝি নি। বরং কারণ খুঁজে বের করতে হবে। অধিকাংশ তরুণের ক্ষেত্রে কারণ এটা নয় যে, তারা বুঝে না। তাদের অনেকে ভালো সমঝদার। কিন্তু তারা ইলম অর্জনের সঠিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে নি। যে শিক্ষাক্রম আমাদের পূর্বসুরী আলেমগণ অনুসরণ করেছেন। পূর্ববর্তী আলেমগণের অনুসৃত শিক্ষাক্রম হচ্ছে সহজ। বরং বর্তমানে যারা নানা পথ ও পদ্ধতি অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছেন সেসব থেকে সহজতর।





আমরা যখন এইটুকু বুঝলাম তখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে যে, (এটি অনেক তরুণেরই প্রশ্ন) ইলম অর্জনের সঠিক ক্রমধারা কোনটি? কীভাবে তালিবে ইলম সঠিক শিক্ষাক্রম অনুসরণ করতে পারবে? যে শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে আল্লাহ চাহেত সে আলেম হতে পারবে। এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ইলমের আসরগুলোতে হাযির হওয়ার উপকার অনেক; সন্দেহ নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় উপকার হচ্ছে, ইলমের আসরে যা পড়ানো হয়েছে তা নিজে বুঝতে পারা এবং অন্যকে বুঝানোর যোগ্যতা হাসিল করা।





প্রথমত: ইলম হাসিল করতে হলে তালিবে ইলমের মধ্যে প্রয়োজনীয় আদব-আখলাক থাকতে হবে:





এক: ইলম অর্জন করতে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য; যেহেতু ইলমে দীন অর্জন একটি ইবাদত। তালিবে ইলমের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহর ফিরিশতারা ডানা বিছিয়ে দেয় মর্মে হাদীস সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহর দরবারে এই ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য এবং আল্লাহ তাকে এই ইবাদত করার তাওফীক দেওয়ার জন্য তালিবে ইলমকে আল্লাহর প্রতি মুখলিস (একনিষ্ঠ) হতে হবে। কোনো দুনিয়াবী পদ বা পদবী পাওয়ার নিয়তে ইলম অর্জন করা যাবে না। অর্থাৎ ইলমে শর‘ঈ তথা কুরআন ও হাদীসের ইলম সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন, শিক্ষক হওয়া, প্রভাষক হওয়া, জনগণের দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া বা আলোচনা পেশ করার সুযোগ পাওয়ার নিমিত্তে অর্জন করা যাবে না। বরং তালিবে ইলমের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর ইবাদত করা, নিজের অজ্ঞতা দূর করা এবং সুস্পষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতে ব্যক্তি নিজে আল্লাহর ইবাদত করতে সমর্থ হওয়া।





তাহলে বুঝা গেল যে, ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে ইখলাস বা একনিষ্ঠতার অর্থ হলো- আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করা; দুনিয়াবী কোনো কিছু প্রত্যাশা না করা। তার নিয়ত হবে নিজের অজ্ঞতা দূর করা। ইমাম আহমাদ রহ.-কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো: ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে ইখলাস বলতে কী বুঝায়? তিনি বললেন: ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে ইখলাস হলো, নিজের অজ্ঞতা দূর করার নিয়ত করা। যেহেতু একজন আলেম আর একজন সাধারণ মানুষ সমমর্যাদার অধিকারী নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,





﴿أَمَّنۡ هُوَ قَٰنِتٌ ءَانَآءَ ٱلَّيۡلِ سَاجِدٗا وَقَآئِمٗا يَحۡذَرُ ٱلۡأٓخِرَةَ وَيَرۡجُواْ رَحۡمَةَ رَبِّهِۦۗ قُلۡ هَلۡ يَسۡتَوِي ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُونَ وَٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَۗ﴾ [الزمر: ٩]





“যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সাজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, আখেরাতের আশংকা রাখে এবং তার রবের রহমত প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান যে এরূপ করে না? বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না উভয় কি সমান হতে পারে?” [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৯]





আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:





﴿يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ﴾ [المجادلة: ١١]





“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত আল্লাহ তাদের মর্যাদা উচ্চ করে দিবেন”। [সূরা আল-মুজাদালাহ, আয়াত : ১০] আয়াত থেকে বুঝা গেল যে, আল্লাহ তা‘আলা আহলে ইলমকে (ইলমধারীকে) সাধারণ বান্দাদের ওপর মর্যাদা দান করেছেন। যে ব্যক্তি ইলমের ভিত্তিতে আল্লাহর ইবাদত করার নিয়ত করে, নিজেকে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বাঁচাতে চায় এবং বাস্তব জীবনে শরী‘আতের অনুসারী হওয়ার নিয়ত করে সে ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে ইখলাস হাসিল করেছে। যেহেতু সে এই ইলমের মাধ্যমে আল্লাহ সন্তুষ্টি প্রত্যাশা করেছে এবং নিজের প্রবৃত্তি-খেয়ালখুশির অন্ধ-অনুসরণ ও মূর্খতা থেকে নিজেকে বাঁচানোর ইচ্ছা করেছে।





বস্তুত ইখলাস হচ্ছে তালিবে ইলমের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তালিবে ইলমের আরো অনেক গুণাবলী রয়েছে। এ বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচিত ও সংকলিত হয়েছে। এর কোনটির কলেবর ছোট, কোনটির কলেবর বড়। তবে এখানে স্থান অনুযায়ী এর মধ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমরা উল্লেখ করব।





দুই: ইলম অর্জনে নিজেকে কোমল হতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাধারণভাবে বলেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা সর্ব ক্ষেত্রে কোমলতা পছন্দ করেন।” এই হাদীসটির বিধান সাধারণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, “যা কিছুতে কোমলতা থাকে, কোমলতা সেটাকে সৌন্দয্যমণ্ডিত করে।” ইলমে দীন ও তা হাসিলেও এ কোমলতা অবলম্বন একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ।





ইলম অর্জনে কীভাবে কোমলতা অবলম্বন করা যাবে- সেটাই প্রশ্ন। অর্থাৎ সব ইলম একসাথে হাসিলে নিমগ্ন হওয়া যাবে না। ঠিক যেমনটি বলেছেন প্রসিদ্ধ তাবেঈ ইবন শিহাব যুহরী রহ.। তিনি বলেন, “যে তালিবে ইলম সব ইলম একত্রে অর্জনের ইচ্ছা করে তার সব ইলম একসাথে বিলুপ্ত হয়ে যায়। বরং ইলম অর্জন করতে হবে রাতদিন ব্যয় করে ধীরে ধীরে।” জনৈক কবি এই অর্থ বুঝাতে গিয়ে বলেছেন





اَلْيَوْمَ عِلْمٌ وَغَدًا مِثْلُــهُ مِنْ نُخَبِ الْعِلْم الَّتِيْ تُلْتُقَطُ





يَحْصُلُ الْمَرْءُ بِهَا حِكْمَةً وَإِنَّمَا السَّيْلُ اِجْتِمَاعُ النُّقَطِ





“আজ কিছু ইলম, কালকে আরো কিছু; এভাবেই কুড়াতে হয় পছন্দনীয় ইলমগুলো





ক্রমধারায় অর্জিত হলে তা হয় প্রজ্ঞাময়; জেনে রাখ, ফোটা ফোটা জল জমাট হয়েই তৈরি হয় বন্যা।”





এজন্য কোমলতা একান্ত কাম্য। কীভাবে কোমলতা অবলম্বন করা হবে? অর্থাৎ সব ইলম একবারে পেয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষী হলে চলবে না। যেমন ধরুন, একজন ছাত্র তাফসীরবিদ্যা হাসিল করতে চাচ্ছেন। তিনি তাফসীরে তাবারী দিয়ে অধ্যয়ন শুরু করলেন। তাফসীরে তাবারী হচ্ছে বহুমুখী তাফসীরের সুতিকাগার। এই ছাত্রের ক্ষেত্রে বলা হবে, তিনি তাফসীরের সব ইলম একবারে অর্জনে নিমগ্ন হয়েছেন। এই ছাত্র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাফসীরে তাবারী পড়া শেষ করবে বটে, তবে তার তাফসীরের ইলম হাসিল হবে না। আপনি যদি তাকে কোনো একটি আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করেন, তাহলে দেখবেন যে, সে ছাত্র খুব বেশি কিছু মনে করতে পারছে না। তার কাছে শুধু ধাঁধা লাগবে। মনে হবে সে এমন এমন পড়েছেন। কিন্তু সে পরিস্কারভাবে একটি আয়াতের তাফসীরও পেশ করতে পারবে না। তাহলে কি পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে? ক্রমধারা অবলম্বন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। ক্রমধারা হচ্ছে- পূর্ববর্তী আলেমগণের অনুসৃত পথ ও পদ্ধতি।





অনুরূপভাবে এক ব্যক্তি হাদীসের ইলম অর্জন করতে চাচ্ছেন। তিনি গিয়ে নাইলুল আওতার থেকে পড়া শুরু করলেন অথবা ফাতহুল বারী পড়া শুরু করলেন। তিনি বলে বেড়ান: আমি ফাতহুল বারীর অমুক খণ্ড শেষ করেছি। জেনে রাখুন, এই ব্যক্তি ইলম হাসিল করতে পারবে না। যে ইলম আলেমগণ হাসিল করেছেন। ইনি সর্বোচ্চ ইসলামী সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী (সাংস্কৃতিবান!) হতে পারবেন; যার কাছে বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য থাকবে। কিন্তু এটি ইলম নয়; যে ইলম সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। যে ইলম অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহ তাওফীক দিলে আলেমে দীন হওয়া যাবে।





অনুরূপভাবে এমন ছাত্র পাওয়া যায় তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনি ফিকহ শাস্ত্রের ওপর কি কি গ্রন্থ পড়েছেন। তিনি উত্তর দেন আমি ইবন কুদামার মুগনী পড়ি; আমি ইমাম নববীর মাজমু‘ পড়ি। এ ছাত্র ইলম হাছিলের ক্ষেত্রে কোমলতা অবলম্বনকারী নয়। বরং সে সব ইলম একবারে হাসিল করতে চেয়েছে। মুগনী, মাজমু‘ ইত্যাদি বড় বড় গ্রন্থগুলোর আলোচনা হজম করতে পারবেন বড় বড় আলেমগণ। প্রাথমিক পর্যায়ের তালিবে ইলমের এসব গ্রন্থ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটানা পড়ে লাভ নেই। হ্যাঁ, বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ কোনো মাসআলা অনুসন্ধানের জন্য তালিবে ইলম এ ধরনের বড় বড় গ্রন্থের আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানা পড়বে না।





কোমলতা প্রসঙ্গে আমরা আরো বলতে চাই- তালিবে ইলম কোনো বিষয়ের বিস্তারিত, খুঁটিনাটি আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিবে না। কারণ, প্রাথমিক পর্যায়ের তালিবে ইলম যদি সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম মাসআলা ও বিস্তারিত আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে মূল মাসআলাটিই ভুলে যাবে। এভাবে সে ইলম হাসিল করতে পারবে না। কারণ, যে মূলনীতিগুলো জানলে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণগুলো বুঝা যাবে সে তো সেসব মূলনীতি জানে না। আমাদের আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের আসরগুলোতে অতি বিস্তারিত আলোচনায় অনুপ্রবেশ করেন। একটি মতন বা পাঠ্যপুস্তিকার ব্যাখ্যায় তারা বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন অথবা একটি পরিচ্ছেদের ব্যাখ্যায় তারা কয়েক মাস কাটিয়ে দেন। তাদের ধারনায় এভাবে ইলম হাসিল হবে। আসলে তা ঠিক নয়; এটি ধারাবাহিক পদ্ধতি নয়। কারণ, এই আলেম তাঁর ক্লাশ উপস্থাপনায় কোমলতা অবলম্বন করেন নি। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:





﴿وَلَٰكِن كُونُواْ رَبَّٰنِيِّ‍ۧنَ بِمَا كُنتُمۡ تُعَلِّمُونَ ٱلۡكِتَٰبَ وَبِمَا كُنتُمۡ تَدۡرُسُونَ ٧٩ ﴾ [ال عمران: ٧٩]





“কিন্তু তোমরা আল্লাহর কিতাব শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে ও নিজেরা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে রব্বানী হও।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৭৯]





ইমাম বুখারী তার সহীহ হাদীসের গ্রন্থে “তোমরা রব্বানী হও” এর ব্যাখ্যায় বলেন, “রব্বানী হচ্ছেন তিনি, যিনি মানুষকে বড় বড় ইলম শিক্ষাদানের পূর্বে ছোট ছোট ইলম শিক্ষা দেন।” অর্থাৎ ইলম অর্জন ও বিতরণের ক্ষেত্রে রব্বানী হচ্ছেন তিনি, যিনি মানুষকে বড় বড় ইলমের পূর্বে ছোট ছোট ইলম শিক্ষা দেন।





হ্যাঁ, ছাত্র ও শিক্ষকের জন্য এটা সম্মানজনক যে, কোনো একটি মাসআলা নিয়ে উনি যা কিছু পড়েছেন সবকিছু উল্লেখ করতে পারা। পাঠদানের প্রস্তুতিকালে তিনি যা কিছু পড়েছেন বা জেনেছেন সবকিছু পাঠদানের সময় উল্লেখ করতে পারা সম্মানের বিষয় বটে; কিন্তু এটি ছাত্রের জন্য কল্যাণকর নয়। কারণ, তিনি যা কিছু জানেন সবকিছু ঢেলে দিয়েছেন। অথচ আলেমের উচিৎ হচ্ছে ছাত্রের প্রয়োজন অনুপাতে তাকে জ্ঞান দেওয়া। ছাত্রের ধারণক্ষমতার উর্ধ্বে জ্ঞান না দেওয়া। অতএব, ইলম অর্জনে কোমলতা ও ধীরস্থিরতা অবলম্বন করতে হতে হবে। কীভাবে কোমলতা ও ধীরস্থিরতা অবলম্বন করতে হবে? ইলম হাছিলের সঠিক ক্রমধারা অবলম্বনের আলোচনায় এর জবাব আসবে।





তিন: ইলম অর্জনে নিয়মানুবর্তী হতে হবে। তালিবে ইলম তার সবচেয়ে উত্তম সময় ইলম অর্জনে ব্যয় করবে। মরা সময় ইলম অর্জনের জন্য নির্ধারণ করবে না। যে সময়ে মস্তিষ্ক নিস্তেজ থাকে, বোধশক্তি দুর্বল থাকে সে সময় ইলম অর্জনের জন্য উপযুক্ত নয়। এই সময়কে ইলম অর্জনের জন্য নির্ধারণ মানে নিজের সাথে প্রবঞ্চনা করা। অতএব, ইলমের জন্য সবচেয়ে উত্তম সময় ব্যয় করতে হবে। যে সময় মস্তিষ্ক সতেজ থাকে, পরিচ্ছন্ন থাকে, ঝঞ্ঝাট মুক্ত থাকে। এটি তখনই সম্ভব হয়, যখন তালিবে ইলম ইলম অর্জনের প্রতি তীব্র আগ্রহী হয়। সকাল-সন্ধ্যা তার মস্তিষ্ক শুধু ইলম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তার লক্ষ্য শুধু ইলম। ঘুমাতে গেলে তার পাশে কিতাব থাকে। হয়তবা ঘুম আসার আগে কোনো মাসআলা জানার জন্য কিতাবের প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য জনৈক আলেম বলেন, যদি তুমি দেখতে পাও তালিবে ইলমের বইপুস্তক সাজানো গুছানো তাহলে জেনে রাখ সে কিতাব পুস্তক অধ্যয়ন করে না। তুমি যদি আকস্মিকভাবে কারো পাঠাগারে ঢুকে পড় আর দেখতে পাও তার কিতাবপুস্তক সাজানো গুছানো, কিতাবগুলো স্ব স্ব স্থানে শোভা পাচ্ছে এর মানে হলো- তিনি অধ্যয়ন করেন না। মেজেতে কোনো কিতাব পড়ে নেই, তার পাশেও কোনো কিতাব নেই, টেবিলের উপরও কোনো কিতাব নেই। এর মানে হচ্ছে- সে কর্মব্যস্ত কিছু সংস্কৃতিমনা মানুষের অন্তর্ভুক্ত যারা তাদের কিছু সময়কে তাদের পড়ার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখেন। তালিবে ইলমের নিকট পড়ার সময় বলে কিছু নেই। তালিবে ইলমের সবটুকু সময় ইলম হাসিলের জন্য। সকাল-সন্ধ্যা সারাক্ষণ তার মনমস্তিষ্ক ইলম নিয়ে মশগুল। তার জীবনের প্রধান সময় যৌবনকাল। এই সময়ে তিনি ইলমের প্রতি প্রচণ্ড আসক্ত থাকেন। তিনি তার সময়গুলোকে ইলমের জন্য ভাগ করে নেন। দিনের সবচেয়ে উত্তম সময়, যে সময় মস্তিষ্ক সবল থাকে সে সময়ে তিনি ফিকহ (ইসলামি আইন) ও উসূলুল ফিকহ (ফিকহের মূলনীতি) ইত্যাদি বিষয় অধ্যয়ন করেন। কারণ, এ জাতীয় বিষয়গুলো বুঝতে মস্তিষ্কের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হয়। মধ্যম মানের সময়ে তিনি তাফসীর, হাদীস, হাদীসের পরিভাষা ইত্যাদি বিষয় অধ্যয়ন করেন। যে বিষয়গুলো বুঝতে মস্তিষ্কের উপর অতবেশী চাপ পড়ে না। আর যে সময়ে মস্তিষ্ক দুর্বল থাকে সে সময়ে তিনি সাহিত্য, জীবনচরিত, ইতিহাস, সাধারণ জ্ঞানের বইগুলো অধ্যয়ন করেন। অর্থাৎ তালিবে ইলম সারাক্ষণ ইলম নিয়ে ব্যস্ত। যেখানেই থাকুক না কেন তার কর্মব্যস্ততা হলো ইলম নিয়ে। কোন বিনোদন বা খোশ আলাপ তাকে ইলম অর্জন থেকে বিরত রাখে না। এ কারণে আমরা দেখতে পাই, আজকাল যাদেরকে তালিবে ইলম বলা হয় তাদের সবচেয়ে বড় দোষ হলো- তারা ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটায় অনর্থক কথাবার্তায়, গালগপ্পে। যেগুলোর সাথে ইলমের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। এই যার অবস্থা সে তালিবে ইলম নয়; বরং অন্যকিছু। যে কাজ নিয়ে সে ব্যস্ত সেটাই তার পরিচয় হওয়া উচিৎ। পক্ষান্তরে তালিবে ইলম তার আত্মপ্রশান্তি, তার শখ, তার আকাঙ্ক্ষা সবকিছু হচ্ছে ইলমকে নিয়ে। যে মজলিসে ইলম নিয়ে আলোচনা হয় অথবা আল্লাহর অবতীর্ণ কালাম নিয়ে আলোচনা হয় অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী নিয়ে আলোচনা হয় সে মজলিসে গেলে তালিবে ইলমের আত্মা সুপ্রসন্ন হয়, মনে তৃপ্তি আসে। সুতরাং তালিবে ইলমের বৈশিষ্ট হবে- নিরবিচ্ছিন্ন অধ্যবসায়। তালিবে ইলম ইলম হাছিলের জন্য তার যৌবনকালের কিছু সময় নয়; সবটুকু সময় ব্যয় করবে অথবা অধিকাংশ সময় ব্যয় করবে। যেহেতু যৌবনকাল ইলম হাছিলের উপযুক্ত সময়। এ কারণে পূর্ববর্তী কোনো এক আলেম বলেছেন: “তোমার সবটুকু তুমি ইলমকে দান করো; তাহলে ইলম তোমাকে সামান্য কিছু দান করবে।” কারণ ইলম অনেক বিস্তৃত, অনেক প্রশস্ত। তাইতো জনৈক মুহাদ্দিস মৃত্যু শয্যায় থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন এবং তার কোনো লেখককে নির্দেশ দেন: লিখে রাখ। মৃত্যুর এই কঠিন মূহূর্তেও তিনি ইলম বিতরনে আগ্রহী ছিলেন। এর থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইলম বিতরণে তিনি কত বেশি মুখলিস (একনিষ্ঠ) ছিলেন। তার গোটা অন্তর ইলমের মহব্বতে ভরপুর ছিল। ইমাম আহমাদ রহ. যখন মৃত্যু শয্যায় ছিলেন তখন ব্যথায় কাতর হয়ে তিনি কিছুটা কাতরাচ্ছিলেন। তখন তাঁর জনৈক ছাত্র মুহাম্মদ ইবন সীরিনের সনদে আনাস ইবন মালিক থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি কাতরানোকে অপছন্দ করতেন। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইমাম আহমাদকে আর কাতরাতে শুনা যায় নি। এই মনমানসিকতা যদি তালিবে ইলমের মধ্যে থাকে তাহলে সে তালিবে ইলম ভবিষতে উম্মতের কল্যাণকামী আলেমে দীন হতে পারবে- ইনশাআল্লাহ্‌। রাতদিন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে শুধু ইলমকে ঘিরে। ছোটবড় সবার কাছ থেকে সে শিখবে। কোনো ইলমকে সে তুচ্ছ মনে করবে না। কিছু মানুষ আছে এমন যখন তার চেয়ে কম মর্যাদার কেউ একজন কোনো একটি উপকারী বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চায় তখন সে আত্মম্ভরিতা করে এবং তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে না। এটি এ কারণে যে, সে ব্যক্তি নিজেকে ইলমের চেয়ে বড় মনে করে। যে ব্যক্তি ইলমের চেয়ে নিজেকে বড় মনে করে সে ইলম হাসিল করতে পারবে না। হতে পারে কম মর্যাদার কারো কাছে এমন একটি ইলম আছে বড় মর্যাদার কারো নিকট সে ইলমটি নেই। হতে পারে কোনো একটি ইলম ছোট্ট একজন তালিবে ইলম বুঝতে পেরেছে; অথচ বড় কোনো আলেম সে ইলমটি বুঝতে পারেনি। ছোট্ট ছাত্রটি যখন সে জ্ঞানটি বুঝিয়ে বলে তখন বড় আলেমেরও বুঝে আসে। এ প্রসঙ্গে আলেমগণ সুলাইমান আলাইহিস সালামের সাথে হুদহুদ পাখির ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে পেশ করেন। হুদহুদ পাখির মর্যাদাগত ও সৃষ্টিগত অবস্থান নিম্ন পর্যায়ের হওয়া সত্ত্বেও এবং নবী সুলাইমান আলাইহিস সালামের মর্যাদা অনেক উন্নত হওয়া সত্ত্বেও সুলাইমান আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে হুদহুদ পাখি বলে:





﴿فَقَالَ أَحَطتُ بِمَا لَمۡ تُحِطۡ بِهِۦ وَجِئۡتُكَ مِن سَبَإِۢ بِنَبَإٖ يَقِينٍ ٢٢ ﴾ [النمل: ٢٢]





“অতঃপর হুদহুদ এসে বলল: আপনি যা অবগত নন, আমি তা অবগত হয়েছি। আমি আপনার কাছে সাবা থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ২২] হুদহুদ পাখি যা জেনেছে সুলাইমান আলাইহিস সালাম তা জানতেন না। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আলেমগণ বলেন, ছোট হোক, বড় হোক যে ব্যক্তি তোমার নিকট কোনো জ্ঞান নিয়ে আসবে তার সাথে আত্মম্ভরিতা করবে না। যে ব্যক্তি জ্ঞান নিয়ে এসেছে তুমি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুন। কারণ হতে পারে সে তোমার জন্য নতুন কোন জ্ঞানের ফটক উন্মুক্ত করে দিবে।





এই তিনটি তালিবে ইলমের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এ রকম আরো অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ইতোপূর্বে আমরা বলেছি আপনি সেগুলো এ বিষয়ে রচিত গ্রন্থাবলী থেকে জেনে নিতে পারবেন।





এখন আসি এই প্রশ্নের জবাবে ইলম কীভাবে কোমলতা ও ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করার মাধ্যমে অর্জন সম্ভব? ইলম অর্জনের ক্রমধারা কি? অথবা ইলম অর্জনের সঠিক পদ্ধতি কি হওয়া উচিৎ?





জবাব: ইলমে দীন বা দীনের জ্ঞান নানা প্রকার। এর মধ্যে কিছু হচ্ছে- মৌলিক ইলম (উলুম আসলিয়্যাহ্‌)। আর কিছু হচ্ছে সহায়ক ইলম (উলুম মুসায়িদা)। কেউ কেউ সহায়ক ইলমগুলোকে মাধ্যম ইলম (উলুমুল আলা) বলেন। আবার কেউ কেউ শাস্ত্রিক ইলম (উলুম সিনাইয়্যা) বলেন।





মৌলিক ইলম হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ’র ইলম তথা ইলমুত তাফসীর (তাফসীরবিদ্যা), ইলমুল হাদীস (হাদীসবিদ্যা), ইলমুল ফিক্‌হ (ইসলামি আইনশাস্ত্র)। এর পর ইলমুত্‌ তাওহীদ (আল্লাহর একত্বের বিদ্যা); যাকে আমরা কুরআন ও সুন্নাহর ইলম থেকে আলাদাভাবে উল্লেখ করে থাকি এই ইলমের মহান মর্যাদার কারণে। যদিও সবগুলো ইলমই কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উৎসারিত।





সুতরাং আমাদের নিকট মৌলিক ইলম হচ্ছে তাফসীর, তাওহীদ, হাদীস, ফিকহ। আর সহায়ক ইলম হচ্ছে- উসুলুত্‌ তাফসীর (তাফসীর তত্ত্ব) বা কারো কারো পরিভাষা অনুযায়ী উলুমুল কুরআন (Quranic Sciences), উসূলুল্‌ হাদীস (হাদীস তত্ত্ব) বা কারো কারো মতানুযায়ী মুস্‌ত্বালাহুল হাদীস (হাদিসের পরিভাষা), উসূলুল্‌ ফিক্‌হ (ইসলামি আইনের মূলনীতি), নাহু (আরবী ব্যাকরণ) ও আরবী ভাষাজ্ঞানসমূহ।





এই ইলমগুলোকে অন্যভাবেও বিভাজন করা হয়। মৌলিক ইলম (উসুল) ও বিনোদনমূলক ইলম (মুলাহ)। মৌলিক ইলমের মধ্যে রয়েছে ইতোপূর্বে উল্লিখিত মৌলিক ইলম ও সহায়ক ইলমের সবগুলো। আর বিনোদনমূলক ইলম হচ্ছে সংবাদমূলক জ্ঞান, জীবনচরিত, বিরল ঘটনাবলী, কিস্‌সা-কাহিনী, ইতিহাস ইত্যাদি।





প্রথম: ইলমুত্‌ তাফসীর





ইলমুত্‌ তাফসীর এর ক্ষেত্রে ক্রমধারা অবলম্বন হলো- প্রথমে সংক্ষিপ্ত একটি তাফসীরগ্রন্থ দিয়ে আপনার অধ্যয়ন শুরু হবে। এই গ্রন্থের মাধ্যমে আপনি শুধুমাত্র আল্লাহর কালামের অর্থ জানার চেষ্টা করবেন। বিশেষতঃ আপনি যদি হাফেযে কুরআন হন তাহলে সংক্ষিপ্ত একটি তাফসীর পড়া আপনার জন্য সবচেয়ে উপকারী। এ পর্যায়ের ছাত্রদের জন্য আলেমগণ তাফসীরে জালালাইনকে বেশ গুরুত্ব দিতেন। নিঃসন্দেহে তাফসীরে জালালাইন খুব উপদায়ক। কিন্তু এ কিতাব পড়ার সময় আপনাকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ, এর মধ্যে বেশ কিছু অপব্যাখ্যা রয়েছে। এই কিতাবটি রচনা করেছেন জালালুদ্দিন মাহাল্লি ও জালালুদ্দিন সুয়ুতি। মুফাস্‌সাল শ্রেণির সূরাগুলো (সূরা ক্বাফ-সূরা নাস) থেকে আপনি পড়া শুরু করবেন। যেহেতু এই সূরাগুলো প্রায়শঃ সালাতে শুনে থাকেন। সূরার অর্থ সংক্ষেপে বুঝে নিবেন। পুরো গ্রন্থটি মাত্র ছোট্ট দু’টি খণ্ড। আপনি পঞ্চাশ পৃষ্ঠা শেষ করার পর আপনার গোটা মুফাস্‌সাল শ্রেণির সূরাগুলোর অর্থ জানা হয়ে গেল। তখন সালাতে তিলাওয়াত শুনলে আপনি অর্থ বুঝতে পারবেন। এর মাধ্যমে সুস্পষ্ট ইলম আপনার হাসিল হয়ে গেলো।





প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কীভাবে বুঝবেন যে আপনি তাফসীর বুঝেছেন যাতে করে অন্য বিদ্যার দিকে মনোনিবেশ করতে পারেন?





জবাব: আপনি নিজে নিজে তাফসীর করতে পারেন কিনা সেটা যাচাই করবেন। উদাহরণতঃ আপনি সূরা ‘ওয়াস শামসি ওয়া দুহাহা’ পড়েছেন। তাফসীরে জালালাইনে সূরাটির তাফসীর পড়েছেন এবং বুঝেছেন। কিন্তু কীভাবে বুঝবেন আপনি এই সূরার তাফসীর আয়ত্ব করতে পেরেছেন কিনা? জালালাইন কিতাবটি বন্ধ করে নিজে নিজে তাফসীর করা শুরু করুন। যদি আপনি নির্দ্বিধায় সঠিকভাবে সূরাটির তাফসীর করতে সক্ষম হন তাহলে আপনি ক্রমধারা অনুসরণ করেছেন এবং আপনার তাফসীর শেখা হয়েছে। এরপর আপনি নতুন পড়া শুরু করতে পারেন। এই পদ্ধতির আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা অন্য ইলমের আলোচনাতেও আসবে। তাহলে আপনি শুরু করবেন তাফসীরে জালালাইন দিয়ে। পরবর্তী ধাপে আপনি জালালাইনের চেয়ে বড় কোনো তাফসীরের কিতাব পড়বেন। যেমন, শাইখ আব্দুর রহমান সা‘দীর তাফসীর অথবা তাফসীরে বাগাভি অথবা ইবন কাসীর অথবা ইবন কাসীরের কোনো একটি সংক্ষিপ্তসার (যদি বিপরীতমূখিতা ব্যতিরেকে কোনো সংক্ষিপ্তসার পাওয়া যায়)। আপনি এ কিতাবটি কিছুটা দ্রুত পড়বেন। আপনি এই কিতাবটি পড়ে আল্লাহর কালামের মর্মার্থ জানবেন। এই গ্রন্থটিতে তথ্যের সমাহার জালালাইনের চেয়ে বেশি ঘটবে। জালালাইনে যে তথ্যগুলো আপনি অনুধাবন করতে পেরেছেন সেগুলো পুনরায় যখন আপনি পড়বেন তখন এ অতিরিক্ত তথ্যের সাথে পূর্বের পড়া তথ্যগুলো আপনার নিকট আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেহেতু আপনি নিজ থেকেই ‘ওয়াস শামসি ওয়াদুহাহা’ সূরাটি তাফসীর করতে পেরেছেন। যখন আপনি তাফসীরে ইবন কাসীর পড়বেন অথবা তাফসীরে বাগাভি পড়বেন অথবা এ পর্যায়ের অন্য কোনো কিতাব পড়বেন তখন আপনি অনুভব করবেন যে, আপনি নতুন কিছু শিখতে পারছেন। এভাবে সময়ের সাথে সাথে আপনি অনুভব করবেন যে, আল্লাহর কালাম অনুধাবন করার জ্ঞান আপনার অনেকটুকু বৃদ্ধি পেয়েছে।



Recent Posts

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 3

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 2

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 1