রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
إِنَّمَا نَهَيْتُكُمْ مِنْ أَجْلِ الدَّافَّةِ الَّتِى دَفَّتْ فَكُلُوا وَادَّخِرُوا وَتَصَدَّقُوا
‘‘মদীনায় আগমনকারী ভ্রমণ কাফেলার কারণেই আমি তোমাদেরকে (কুরবানীর গোশ মজুদ করতে) নিষেধ করেছিলাম। তবে এখন তোমরা তা ভক্ষণ করতে পার, মজুদ করতে পার এবং সদকা প্রদান করতে পার’’[41]।
3. প্রাথমিকভাবে আরোপিত যে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশ কিংবা নিষেধাজ্ঞাঃ
এ থেকে বুঝা যায় যে, নির্দেশটি কার্যে পরিণত করা হোক এবং নিষেধকৃত বস্তু থেকে বিরত থাকা হোক - এটাই শারীয়াহ্ প্রণেতার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য। অতএব কেউ যদি শারীয়াহ্ এর নির্দেশ বাস্তবায়ন না করে কিংবা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়, তাহলে সে শারীয়াহ্-এর মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করল।
4. যে বক্তব্য থেকে সরাসরি মাকাসিদ সম্পর্কে জানা যায়ঃ
এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে রয়েছে শারীয়াহ্ প্রণেতা স্বয়ং তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করা। যেমন আল্লাহর বাণী,
﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘‘আল্লাহ তোমাদের জন্য যা সহজ তা চান এবং যা তোমাদের জন্য ক্লেশকর তা চান না’’[42]।
তিনি আরো বলেন,
﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمۡ وَيَهۡدِيَكُمۡ سُنَنَ ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ وَيَتُوبَ عَلَيۡكُمۡۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ٢٦ وَٱللَّهُ يُرِيدُ أَن يَتُوبَ عَلَيۡكُمۡ وَيُرِيدُ ٱلَّذِينَ يَتَّبِعُونَ ٱلشَّهَوَٰتِ أَن تَمِيلُواْ مَيۡلًا عَظِيمٗا ٢٧ ﴾ [النساء : ٢٦، ٢٧]
‘‘আল্লাহ ইচ্ছা করেন তোমাদের কাছে বিশদভাবে বিবৃত করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করতে চান, আর যারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা ভীষণভাবে পথচ্যুত হও’’[43]।
﴿مَا يُرِيدُ ٱللَّهُ لِيَجۡعَلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ حَرَجٖ وَلَٰكِن يُرِيدُ لِيُطَهِّرَكُمۡ﴾ [المائدة:٦]
‘‘আল্লাহ তোমাদেরকে কষ্ট দিতে চান না, বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান...’’[44]।
এ ধরনের বক্তব্যের মধ্যে আরো রয়েছে - নির্ধারণ করে দেয়া, ফরয করা, হুকুম দেয়া, নির্দেশ প্রদান করা, অনুমতি দেয়া, হারাম করা ইত্যাদি। যেমন আল্লাহ বলেন,
﴿ ۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنًاۚ ﴾ [الاسراء: ٢٣]
‘‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদাত না করতে এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে’’[45]।
﴿ذَٰلِكُمۡ حُكۡمُ ٱللَّهِ يَحۡكُمُ بَيۡنَكُمۡۖ ﴾ [الممتحنة : ١٠]
‘‘এটাই আল্লাহর বিধান। তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে থাকেন’’[46]।
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ ﴾ [البقرة: ١٨٣]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে’’[47]।
﴿ ۞إِنَّ ٱللَّهَ يَأۡمُرُ بِٱلۡعَدۡلِ وَٱلۡإِحۡسَٰنِ ﴾ [النحل: ٩٠]
‘‘আল্লাহ নির্দেশ প্রদান করছেন ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচারণের...’’।[48]
এ সকল বক্তব্যের মধ্যে আরো রয়েছে - কল্যাণকর, অকল্যাণকর কিংবা উপকারী বা ক্ষতিকর অথবা প্রিয় বা অপ্রিয় বলে উল্লেখ করা। যেমন আল্লাহ বলেন,
﴿ وَأَن تَصُومُواْ خَيۡرٞ لَّكُمۡ ﴾ [البقرة: ١٨٤]
‘‘আর সাওম পালন তোমাদের জন্য উত্তম’’[49]।
﴿ فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ ﴾ [النساء : ١٩]
‘‘তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা কিছু অপছন্দ করছ অথচ আল্লাহ তাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন’’[50]।
৫. নির্দেশ দান বা নিষেধ করার বাস্তব কারণ থাকা সত্ত্বেও তা না করে শারীয়াহ্ প্রণেতার চুপ থাকা। যদি প্রয়োজনীয় কার্যকারণ থাকা সত্বেও শারীয়াহ্-এর নির্দেশ না আসে তাহলে বুঝতে হবে উক্ত কাজে শারীয়াহ্-এর অনুমোদন নেই। আবার নিষেধ করার যথার্থ কারণ ও উপলক্ষ থাকা সত্ত্বেও যদি শারীয়াহ্ কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত না হয়, তাহলে বুঝতে হবে কাজটি শারীয়াহ্-এর দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয়।
মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর প্রকরণসমূহ
আমরা জানি ইসলামী শারীয়াহ্-এর প্রতিটি বিধানেরই রয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য। শারীয়াহ্-এর এ সকল মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যকে তিনটি প্রকরণে ভাগ করা যায়, যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে আলাদা আলাদা প্রকারভেদ[51]।
প্রথম প্রকরণঃ মৌলিকত্বের দিক থেকে মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ দু’ প্রকারঃ
1. মৌলিক মাকাসিদঃ এ দ্বারা শারীয়াহ্-এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ও মাকাসিদ বুঝানো হয়েছে অর্থাৎ শরীয়ত প্রণেতা কোনো নির্দেশ দ্বারা প্রথম যে উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছেন তা বুঝানো হয়েছে। যেমন, সালাত আদায়ের যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তার মৌলিক উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য, স্মরণ এবং অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে মুক্তি।
2. গৌণ ও আনুষাঙ্গিক মাকাসিদঃ যে সব মাকাসিদ মৌলিক মাকাসিদের সাথে কিংবা পরে অর্জিত হয় সেগুলো হচ্ছে গৌণ ও আনুষাঙ্গিক মাকাসিদ। যেমন, সালাত আদায়ের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক প্রশান্তি লাভ, অযুর মাধ্যমে পরিচ্ছন্নতা অর্জন ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রকরণঃ ব্যাপকতার দিক থেকে মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ তিন প্রকারঃ
1. ব্যাপক মাকাসিদঃ ইসলামী শারীয়াহ্-এর সকল ক্ষেত্রে ও সকল অধ্যায়ে যে সকল মাকাসিদ ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ব্যাপক মাকাসিদ। যেমন,
(ক) মাসালিহ তথা কল্যাণ সাধন এবং মাফাসিদ তথা অকল্যাণ ও ক্ষতি প্রতিহতকরণ।
(খ) সহজীকরণ ও কঠোরতা বিলোপ ইত্যাদি।
2. নির্দিষ্ট মাকাসিদঃ শারীয়াহ্ এর নির্দিষ্ট অধ্যায় ও বিষয়ভিত্তিক যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে, সেগুলোকে বলা হয় নির্দিষ্ট বা খাস মাকাসিদ। যেমন, সালাতের উদ্দেশ্য, সাওম ও হাজ্জের বিশেষ উদ্দেশ্য ইত্যাদি।
3. ক্ষুদ্র মাকাসিদঃ শারীয়াহ্-এর যে সকল মাকাসিদ শুধুমাত্র কোন একটি নির্দিষ্ট মাসআলার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় ক্ষুদ্র মাকাসিদ। যেমন, অযুর সময় নাকে পানি দেয়ার উদ্দেশ্য কিংবা সালাতে রুকু আদায়ের উদ্দেশ্য ইত্যাদি।
তৃতীয় প্রকরণঃ মাসালিহ বা মানব কল্যাণ সাধনের যে উদ্দেশ্যে শারীয়াহ্ প্রণীত হয়েছে সে দিক থেকে মাকাসিদ তিন প্রকার :
1. মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ (আদ্-দারুরিয়্যাত)
2. মানব জীবনের প্রয়োজনসমূহ (আল-হাজিয়্যাত)
3. মানব জীবনের শোভাবর্ধনকারী বিষয়সমূহ (আত-তাহসীনীয়্যাত)
মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর দৃষ্টিতে মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ (আদ্-দারুরিয়্যাত)
মহান রাববুল আ’লামীন মানব জাতির সার্বিক কল্যাণ সাধনের জন্যই ইসলামী শারীয়াহ্ এর সকল বিধান প্রণয়ন করেছেন। মানব জীবনের সর্বাধিক জরুরী বিষয়সমূহের সংরক্ষণ ও হেফাযত সে বিধানেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসলামী শারীয়াহ্ এর পরিভাষায় এ বিষয়সমূহের নাম দেয়া হয়েছে ‘আদ-দারুরিয়্যাত’।
‘আদ-দারুরিয়্যাত’ এর সংজ্ঞাঃ
ইমাম শাতিবী রহ্. এর সংজ্ঞায় বলেন, ‘‘আদ-দারুরিয়্যাত হচ্ছে দীন ও দুনিয়ার সে সকল অত্যাবশকীয় বিষয়সমূহ যার অনুপস্থিতিতে দুনিয়ার কল্যাণের সঠিক গতিধারা ব্যাহত হয়, বরং এ ক্ষেত্রে দেখা দেয় বিপর্যয়, সীমাহীন ক্ষতি ও প্রাণ হারানোর ঘটনা। আর আখিরাতে নাজাত ও নেয়ামত লাভ হয় সুদূর পরাহত এবং সুস্পষ্ট ক্ষতিতে লিপ্ত হওয়া হয়ে ওঠে অবধারিত’’[52]।
প্রখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আল-মুহাল্লী বলেন, ‘‘যে সব বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা জরুরী পর্যায়ে পড়ে, সেগুলোই হচ্ছে আদ-দারুরিয়্যাত’’[53]।
‘আদ-দারুরিয়্যাত’এর বিষয়সমূহঃ
‘আদ-দারুরিয়্যাত’ পাঁচটি[54]। সেগুলো হল :
দীনের হেফাযত
জীবনের হেফাযত
আকল বা বিবেকের হেফাযত
বংশধারা ও ইজ্জতের হেফাযত
সম্পদের হেফাযত
এ পাঁচটি বিষয়কে বলা হয় আল-মাকাসিদ আল-খামসাহ্ বা শারীয়াহ্-এর পাঁচটি উদ্দেশ্য। এগুলো ছাড়া পৃথিবীতে মানব জীবন কোনোভাবেই চলতে পারে না। আর এ জন্যই দীন, জীবন, আকল, সম্পদ এবং বংশধারা ও ইজ্জতের হেফাযত ইসলামী শারীয়াহ এর একটি মৌলিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। এ পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দীন, তারপর মানুষের জীবন, আকল, বংশধারা ও ইজ্জত এবং সর্বশেষে সম্পদ।
নিচে দলীলসহ এ পাঁচটি বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হলঃ
প্রথম বিষয়ঃ দীনের হেফাযত
দীনকে সচরাচর আমরা ধর্ম বলে থাকি। যদিও আল-কুরআনে ‘দীন’ বলতে নিছক ধর্ম বুঝানো হয় নি। আল-কুরআনের ‘দীন’ মানব জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সমাধান প্রদান করে থাকে। সেখানে মানুষের সামগ্রিক জীবনই থাকে দীনের গণ্ডিভূত। ধর্মীয় জীবন সেখানে মানুষের পুরো জীবন থেকে বিচ্ছন্ন কোনো অংশ নয়।
মানুষ স্বভাবতই কোন না কোন ধর্মের অনুসারী হয়ে থাকে, চাই সে ধর্ম সত্য হোক বা বাতিল হোক। এর বাইরে অবস্থান রয়েছে খুবই কম মানুষের। এখানে দীন বলতে যে কোনো ধর্মকে বুঝানো হয় নি, বরং সে সত্য দীনকে বুঝানো হয়েছে যা মহান রাববুল ‘আলামীনের কাছ থেকে অবতীর্ণ তথা ইসলাম। কেননা মানব রচিত কোন ধর্ম আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, আবার অন্যান্য আসমানী দীনসমূহ সর্বশেষ দীন ইসলাম দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّ ٱلدِّينَ عِندَ ٱللَّهِ ٱلۡإِسۡلَٰمُۗ ﴾ [ال عمران: ١٩]
‘‘নিশ্চয় আল্লাহর নিকট একমাত্র দীন হচ্ছে ইসলাম’’[55]।
﴿ وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥ ﴾ [ال عمران: ٨٥]
‘‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন অনুসন্ধান করে, আল্লাহ কখনোই তার কাছ থেকে তা কবুল করবেন না। সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’’[56]।
দীনের হেফাযতের উপায় ও পন্থাঃ
মহান আল্লাহ নিজেই এ দীনকে হেফাযতের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]
‘‘নিশ্চয়ই আমি এ যিক্র নাযিল করেছি এবং আমিই তার হেফাযতকারী’’[57]। যিক্র বলতে এ আয়াতে কুরআন, সুন্নাহ এবং দীন সবকিছুকেই বুঝানো হয়েছে। দীনকে হেফাযতের জন্য আল্লাহ যে সকল পন্থা ও উপায় অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন তা হচ্ছেঃ
1. দীনের নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করাঃ
আল্লাহ এ দীন প্রণয়ন করেছেন সে অনুযায়ী আমল করার জন্য, দীনের কিছু বচন ও উক্তি হেফাযত করার জন্য শুধু নয়। কেননা দীন হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস ও আমলের সমন্বয়। আকীদা হচ্ছে দীনের মূল, আর আমল ছাড়া দীনের সুফল কোনো মতেই পাওয়া যাবে না। প্রত্যেক মুসলিম বাস্তব জীবনে দীনকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলে অচিরেই তার সুফল দেখতে পাবে। অতএব দীনের সুরক্ষার জন্য সে অনুযায়ী আমল করা অত্যন্ত জরুরী। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপর সালাত, সাওম, হজ্জ ও যাকাতসহ আরো অনেক আমল ফরয করেছেন।
দীন অনুযায়ী আমলের একটা সর্বনিম্ন সীমা রয়েছে যা অতিক্রম করার অনুমতি কাউকে দেয়া হয় নি। তা হচ্ছে ফরয-ওয়াজিব মেনে চলা এবং হারাম পরিত্যাগ করা। ড. আবদুল্লাহ আহমাদ আল-কাদরী বলেন, ‘‘এ থেকেই আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের প্রত্যেক ব্যক্তির উপর একটি সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন যদ্বারা দীনের সুরক্ষা হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে ফরযে আ’ইন যা পালন থেকে কেউই অব্যাহতি পায় না যতক্ষণ পর্যন্ত শারীয়াহ্-এর অর্পিত দায়িত্ব পালনের বুদ্ধিগত সামর্থ ও কার্যে পরিণত করার বাস্তব সক্ষমতা তার থাকে। এর উদাহরণ হচ্ছে, ঈমান ও ইসলামের মূলভিত্তিসমূহ। আল্লাহ প্রত্যেককেই ঈমান ও ইসলাম অনুযায়ী আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন...’’[58]।
দীনের আমল মানুষের জীবনে সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ ও প্রভাবশালী করার জন্য প্রয়োজন এগুলোকে আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পন্থায় পালন করা। এভাবে আমল করতে পারলেই তা হবে প্রকৃত দীন। কিন্তু যখনই বাস্তবায়নে ত্রুটি দেখা দেবে এবং প্রকৃত দীন ও আমলে পার্থক্য সূচিত হবে তখন এ আমলকারীকে প্রকৃত দীনের অনুসারী আমলদার হিসাবে গণ্য করা হবে না। এখান থেকেই আমরা মুসলিম ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্য উপলদ্ধি করতে পারি। কেননা মুসলিমদের কাজ কখনো ঠিক হতে পারে কখনো ভুল হতে পারে, কখনো হক ও কখনো বাতিল হতে পারে, কিন্তু ইসলাম শুধুই হক ও সত্যাশ্রয়ী, এতে বাতিল থাকার কোনই সম্ভাবনা নেই। ফলে আজকের মুসলিমদের কাজকর্ম দীনের বিরুদ্ধে কোনো দলীল হতে পারে না বরং প্রকৃত দীনের আলোকেই সকলের কর্মধারা যাচাই করা হবে।
2. দীনের নির্দেশনা অনুযায়ী যাবতীয় হুকুম পরিচালনাঃ
দীনের নির্দেশনা অনুযায়ী যাবতীয় হুকুম পরিচালনা দীনের হেফাযতের একটি অন্যতম জরুরী পন্থা। কেননা দীনই যদি হুকুম পরিচালনার মূল অথরিটি না হয় তাহলে সে দীন কিভাবে হেফাযত করা সম্ভব? দীনের হেফাযতের অর্থ শুধু কাগজে-কলমে কিংবা কিতাবে একে সংরক্ষণ করা নয়। বরং মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে দীনের নির্দেশ মেনে চলাই হচ্ছে দীনের সবচেয়ে বড় হেফাযত[59]।
এদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, দীনকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে আল্লাহর অবতারিত নির্দেশ ও গ্রন্থ ছাড়া অন্য আইন দ্বারা হুকুম পরিচালনা করার মানে দাঁড়ায় আল্লাহর দীন ও হুকুমের স্থলে মানব প্রবৃত্তি ও মতবাদকে সেখানে স্থলাভিষিক্ত করা। দীনকে ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে আর বড় কোনো পন্থা আছে কি?? এবং দীনের বিরুদ্ধে কৃত এর চেয়েও বড় কোনো অপরাধ আছে কি??
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء : ٦٥]
‘‘কখনোই নয়, আপনার রবের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের মধ্যকার বিবাদ-বিসম্বাদে আপনাকে হুকুমদাতা হিসাবে স্থির করে, অতপর আপনি যে ফয়সালা করে দেন তাতে নিজেদের মনে কোনরূপ দ্বিধা না রেখে পুরোপুরি মেনে নেয়’’[60]।
﴿ وَمَن لَّمۡ يَحۡكُم بِمَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٤٤ ﴾ [المائدة: ٤٤]
‘‘যারা আল্লাহর অবতারিত বিধান অনুযায়ী হুকুম প্রদান করে না তারা কাফির’’[61]।
3. দীনের প্রতি মানুষকে আহ্বান করাঃ
দীনের প্রতি আহবান মূলত নবী ও রাসূলগণেরই সুমহান কাজ। এ দায়িত্ব পালনের জন্যই তারা জীবনভর সংগ্রাম করেছেন, কষ্ট করেছেন এবং সকল বিপদে-আপদে চরম ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে দাওয়াত ও আহবানের এ মহান দায়িত্ব পালন ব্যতীত কোনো দীনকে প্রতিষ্ঠিত করা ও প্রসারিত করা সম্ভব নয়।
দেখা যায়, অনেকে তাদের নিজ নিজ মতবাদ বাতিল হওয়া সত্বেও অন্যদের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য বিভিন্ন পন্থায় তা প্রচার ও বর্ণনার কাজে লিপ্ত হয়। ইসলামের শত্রুরাও আজ ইসলামকে বিকৃতভাবে প্রচারের জন্য উঠে পড়ে লেগে গেছে। তাহলে মহান আল্লাহর দেয়া সত্যকে প্রচারের জন্য এবং বিশেষ করে একে শত্রুদের বিকৃতি থেকে রক্ষা করার জন্য দাওয়াতী পন্থার আশ্রয় নেয়া মুসলিমদের উপর অত্যন্ত জরুরী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤ ﴾ [ال عمران: ١٠٤]
‘‘তোমাদের মধ্যে এমন একদল লোক থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎ কাজের নির্দেশ দেবে ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে। তারাই হবে সফলকাম’’[62]।
﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ﴾ [ال عمران: ١١٠]
‘‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মাত মানব জাতির জন্য যাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ প্রদান করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে’’[63]।
﴿ وَٱدۡعُ إِلَىٰ رَبِّكَۖ وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ ٨٧ ﴾ [القصص: ٨٧]
‘‘আর আপনার প্রভুর প্রতি আহবান করুন এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না’’[64]। ‘‘আপনার প্রভূর পথের দিকে হিকমাত ও উত্তম উপদেশ সহকারে আহবান করুন’’[65]।
﴿ قُلۡ هَٰذِهِۦ سَبِيلِيٓ أَدۡعُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِۚ عَلَىٰ بَصِيرَةٍ أَنَا۠ وَمَنِ ٱتَّبَعَنِيۖ ﴾ [يوسف: 108]
‘‘বলুন, এটাই আমার পথ। আল্লাহর প্রতি মানুষকে আমি আহবান করি জেনেশুনে - আমি ও আমার অনুসারীগণ..’’[66]।
4. জিহাদ ফি সাবীলিল্লাহঃ
দীনকে হেফাযতের একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে আল্লাহর পথে জিহাদ। জিহাদ একটি ব্যাপকার্থক শব্দ। ব্যাপকার্থে জিহাদ আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সাথে সম্পর্কিত সকল কর্মকাণ্ডকেই বুঝায়। এ হিসাবে আল্লাহর দীনের প্রতি দাওয়াত ও আহবান জিহাদের প্রাথমিক অধ্যায়। আর বিশেষ অর্থে আল্লাহর বাণীকে সমুন্নত করার জন্য, ইসলাম ও মুসলিমদেরকে ইসলামের শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ও ইসলামকে আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য উলীল আমরের নেতৃত্বে যে যুদ্ধ হয়ে থাকে তাকে জিহাদ বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ ٱشۡتَرَىٰ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ أَنفُسَهُمۡ وَأَمۡوَٰلَهُم بِأَنَّ لَهُمُ ٱلۡجَنَّةَۚ يُقَٰتِلُونَ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيَقۡتُلُونَ وَيُقۡتَلُونَۖ ﴾ [ال عمران: ١٤٢]
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের নিকট হতে তাদের জীবন ও সম্পদ ক্রয় করে নিয়েছেন, বিনিময়ে তাদের জন্য আছে জান্নাত। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, নিধন করে ও নিহত হয়’’[67]।
5. দীন বিরোধী সকল কথা ও কাজ প্রতিরোধ করাঃ
এটিও মূলত জিহাদের ব্যাপকার্থের অন্তর্গত। দীনের হেফাযতের জন্য এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিধায় একে আলাদাভাবে উল্লেখ করা হল। কেননা যদি দীন বিরোধী বাতিল কথা, বিভ্রান্ত আকীদা, ভ্রষ্ট চিন্তাধারা এবং ক্ষতিকর মতবাদসমূহকে কোনো প্রকার বাদ-প্রতিবাদ ছাড়াই মুসলিমদের চিন্তাজগতে আঘাত হানার সুযোগ করে দেয়া হয়, তাহলে দীনের মৌলিক ধারণা লোপ পেতে থাকবে, সত্যকে বাতিল ও মিথ্যার সাথে গুলিয়ে ফেলা হবে। ফলশ্রুতিতে ধীরে ধীরে দীন হতে মানুষ সরে যেতে থাকবে। তা যেন না হয় সেজন্য অতীতে যেমন বহু আলেম দীন সম্পর্কে সকল বিভ্রান্তি ও সংশয় অপনোদনের জন্য কলম ধরেছিলেন এবং সত্যের পক্ষে বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, বর্তমানেও তেমনি মুসলিম স্কলারগণ বিভিন্ন ভাবে কাজ করছেন।
দ্বিতীয় বিষয়ঃ জীবনের হেফাযত
মানব জীবনের হেফাযতের জন্য ইসলাম খুব বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছে। জীবনের সুরক্ষার জন্য এবং জীবনকে সকল ক্ষতি ও বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য ইসলামে প্রণীত হয়েছে বহু হুকুম-আহকাম ও দেয়া হয়েছে অনেক বিধান। জীবনের হেফাযতের উপায় হিসাবে বিবেচিত এ বিধানের মধ্যে রয়েছেঃ
মানুষের জীবনের উপর চড়াও হওয়া হারাম।
হত্যার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী সকল উপায়-উপকরণ নিষিদ্ধ।
কিসাস (হত্যার শাস্তি) নির্দ্ধারণ।
কোনো ব্যক্তি নিহত হলে হত্যাকারীর বিরুদ্ধে শাস্তি কার্যকর করার জন্য তার অপরাধ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা, যাতে নিরপরাধ কোনো ব্যক্তি হত্যার শাস্তি না পায়।
আক্রান্ত হওয়ার কারণে জীবনের যে সকল ক্ষতি হয়ে থাকে তার ক্ষতিপূরণ দিতে আক্রমণকারীর বাধ্য থাকা।
কিসাসের শাস্তি ক্ষমা করার বিধান।
জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে জরুরী অবস্থায় নিষিদ্ধ বস্তু ভক্ষণের অনুমতি।
তৃতীয় বিষয়ঃ আকল বা বিবেকের হেফাযত
আকল বা বিবেক মানুষকে দেয়া আল্লাহর একটি বিশাল নেয়ামত। মূলত আকলের মাধ্যমেই মানুষকে আর সব প্রাণীর উপর প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এবং এর কারণেই মানুষকে তিনি শারীয়াহ্ অনুসরণের গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। আকল বা বিবেককে সকল বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার গুরুত্ব সকল যুগে সকল শারীয়াহ্ এর মধ্যেই ছিল। আল-কুরআনে মহান আল্লাহ বার বার বিবেক সম্পন্ন লোকদের সম্বোধন করেছেন এবং বিবেকবান লোকেদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইসলামে দু’ভাবে আকলকে হেফাযত করার দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছেঃ
1. আকল নষ্টকারী বাহ্যিক উপকরণসমূহ থেকে একে হেফাযতে রাখা। এ সব উপকরণের মধ্যে রয়েছে মদ, ড্রাগ, হিরোইন ও নেশাগ্রস্তকারী অন্যান্য মাদকদ্রব্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠ إِنَّمَا يُرِيدُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَن يُوقِعَ بَيۡنَكُمُ ٱلۡعَدَٰوَةَ وَٱلۡبَغۡضَآءَ فِي ٱلۡخَمۡرِ وَٱلۡمَيۡسِرِ وَيَصُدَّكُمۡ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَعَنِ ٱلصَّلَوٰةِۖ فَهَلۡ أَنتُم مُّنتَهُونَ ٩١ ﴾ [المائدة: ٩٠، ٩١]
‘‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর যাতে তোমরা সফল হতে পার। শয়তান তো মদ জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?’’[68]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ، وَكُلُّ خَمْرٍ حَرَامٌ»
‘‘নেশা সৃষ্টিকারী সকল বস্তুই মদ এবং সকল মদই হারাম’’[69]। তিনি আরো বলেন,
وَلَا يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ
‘‘কোন ব্যক্তি ঈমানদার অবস্থায় মদ পান করতে পারে না’’[70]।
অন্যত্র তিনি বলেন,
«مَا أَسْكَرَ كَثِيرُهُ فَقَلِيلُهُ حَرَامٌ»
‘‘যা বেশী পরিমাণে পান করলে নেশাগ্রস্ত হয়, তা কম পরিমাণে পান করাও হারাম’’[71]।
2. আকল নষ্টকারী আভ্যন্তরীন উপকরণসমূহ থেকে একে হেফাযতে রাখা। এ সবের মধ্যে রয়েছে দীন, সমাজ, রাজনীতি প্রভৃতি ব্যাপারে ভ্রান্ত ধারণা যা আকলকে বিভ্রান্ত করে এবং শরীয়তের আলোকে সঠিক চিন্তাধারা থেকে আকলকে অকার্যকর করে রাখে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা আল-কুরআনে কাফিরদের নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। কারণ তারা কুরআনের আয়াতসমূহ ও আল্লাহর অন্যান্য নিদর্শন সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার ব্যাপারে নিজেদের আকলকে কোন কাজে লাগায় নি। ফলে তারা সত্যপথের দিশা লাভ করে নি। আল্লাহ বলেন,
﴿ أَمۡ تَحۡسَبُ أَنَّ أَكۡثَرَهُمۡ يَسۡمَعُونَ أَوۡ يَعۡقِلُونَۚ إِنۡ هُمۡ إِلَّا كَٱلۡأَنۡعَٰمِ بَلۡ هُمۡ أَضَلُّ سَبِيلًا ٤٤ ﴾ [الفرقان: ٤٤]
‘‘তুমি কি মনে কর যে, তাদের অধিকাংশ শোনে ও বোঝে? তারা তো পশুর মতই; বরং তারা অধিক পথভ্রষ্ট’’[72]।
﴿ وَجَعَلۡنَا لَهُمۡ سَمۡعٗا وَأَبۡصَٰرٗا وَأَفِۡٔدَةٗ فَمَآ أَغۡنَىٰ عَنۡهُمۡ سَمۡعُهُمۡ وَلَآ أَبۡصَٰرُهُمۡ وَلَآ أَفِۡٔدَتُهُم مِّن شَيۡءٍ إِذۡ كَانُواْ يَجۡحَدُونَ بَِٔايَٰتِ ٱللَّهِ ﴾ [الاحقاف: ٢٦]
‘‘আমি তাদেরকে দিয়েছিলাম কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর, কিন্তু তাদের কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর তাদের কোনো কাজে আসে নি। কেননা তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছিল’’[73]।
অতএব আকলকে সত্যের পথে পৌঁছার জন্য কাজে লাগানো উচিত এবং আকল বিনষ্টকারী সকল বিষয় থেকে একে হেফাযতের ব্যবস্থা করা উচিত।
চতুর্থ বিষয়ঃ বংশধারার হেফাযত
বংশধারার হেফাযত জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। এর মাধ্যমেই পৃথিবীতে মানুষ বহুকাল ধরে বেঁচে আছে এবং থাকবে। এতেই নিহিত রয়েছে জাতির শক্তি, মান ও মর্যাদা। ইসলাম বংশধারা রক্ষার প্রতি সর্বাত্মক গুরুত্ব আরোপ করেছে। আর এজন্য নিম্নলিখিত উপায় ও পন্থা অবলম্বন করেছেঃ
1. বংশবৃদ্ধির বৈধ পন্থা হিসাবে বিবাহের প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ।
2. জন্মদানে সক্ষম নারীকে বিবাহ করার প্রতি উৎসাহ প্রদান।
পঞ্চম বিষয়ঃ সম্পদের হেফাযত
সম্পদ বলতে এখানে মানুষের জীবনে যে সকল বস্তু ও টাকা পয়সার প্রয়োজন সে সবকেই বুঝানো হয়েছে[74]। সম্পদ ছাড়া মানুষের পার্থিব জীবন কোন মতেই চলতে পারে না। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও উম্মাহ্ (জাতি) - সকলেরই প্রয়োজন সম্পদের। ব্যক্তি পর্যায়ে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান, যা ছাড়া একদিনও গুজরান করা সম্ভব নয়। জনগোষ্ঠী ও উম্মাহর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ব্যক্তির দারিদ্রের প্রভাব সমগ্র উম্মাহর উপর পড়ে। এভাবে বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র দেখা দিলে উম্মাহও সংকটাপন্ন হয় এবং মান মর্যাদা হারায়। তদুপরি শত্রুর হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়ের জন্য প্রয়োজন অর্থ ও সম্পদের। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم مِّن قُوَّةٖ وَمِن رِّبَاطِ ٱلۡخَيۡلِ تُرۡهِبُونَ بِهِۦ عَدُوَّ ٱللَّهِ وَعَدُوَّكُمۡ ﴾ [الانفال: ٦٠]
‘‘তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে, যদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে ও তোমাদের শত্রুকে...’’[75]।
এভাবে প্রয়োজনীয় সম্পত্তির ব্যবস্থা হলেই শুধু উম্মাহ্ তার শত্রুদের মুখাপেক্ষিতা কাটিয়ে উঠতে পারবে। কেননা আজকের বিশ্ব-ব্যবস্থায় এটা স্পষ্ট যে, দরিদ্র জাতি ও দরিদ্র রাষ্ট্র শত্রুদের নানামুখী ষড়যন্ত্রের শিকার হয় এবং এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে শত্রুরা সে জাতি ও রাষ্ট্রের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা যেমন চালায়, তেমনি তাদের মধ্যে নিজেদের সংস্কৃতি, মতবাদ ও ধ্বংসাত্মক চিন্তাধারার প্রসার ঘটায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি জলজ্যান্ত ও বাস্তব।
সুতরাং ইসলামে সম্পত্তির হেফাযতের গুরুত্ব অত্যন্ত প্রকট। ইসলামী শারীয়াহ্-এর দৃষ্টিতে সম্পদ অর্জন ও তা সঠিকভাবে হেফাযতের জন্য নিম্নবর্ণিত উপায় ও পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছেঃ
1. হালাল পন্থায় সম্পদ অর্জনে উদ্বুদ্ধকরণ।
2. কারো সম্পদের উপর চড়াও হওয়া হারাম ঘোষণা।
3. সম্পদ বিনষ্ট করা কিংবা অপচয় করা হারাম ঘোষণা।
4. সম্পদের সুরক্ষার জন্য শারীয়াহ্ কর্তৃক চুরি ও ডাকাতির শাস্তি নির্ধারণ।
5. বিনষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত সম্পত্তির জামানাত ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান।
6. সম্পদ রক্ষার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার বৈধতা।
7. ঋণ প্রদানের সময় সাক্ষী রাখা ও এর লিখিত কাগজপত্র করা।
কুড়ানো সম্পদ মালিকের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা।
মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর দৃষ্টিতে মানব জীবনের প্রয়োজনসমূহ (আল-হাজিয়্যাত) ও শোভাবর্ধনকারী বিষয়সমূহ (তাহ্-সিনিয়্যাত)
মানব জীবনের প্রয়োজনসমূহ (আল-হাজিয়্যাত):
জরুরী বিষয়গুলো দিয়ে মানব জীবনের সকল চাহিদা মেটে না। জীবনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করার জন্য তার প্রয়োজন আরো অনেক কিছু। এগুলো হল আল-হাজিয়্যাত। ইমাম শাতিবী রহ্ এর সংজ্ঞায় বলেন, ‘তা হল সে সকল বিষয়, মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ আনয়নের জন্য এবং কঠোরতা, সমস্যা ও অসুবিধা দূরীভূত করার জন্য যা প্রয়োজন। এ বিষয়গুলোর প্রতি যদি বিশেষ নজর দেয়া না হয় তাহলে সাধারণভাবে বান্দার উপর সমস্যা ও অসুবিধা আরোপিত হয়, তবে তা জনকল্যাণের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক বিপর্যয় সৃষ্টির পর্যায়ে পড়ে না’[76]।
আল-হাজিয়্যাত এর হেফাযতের জন্য ইসলামী শারীয়াহ্ নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করেছেঃ
1. ইবাদাতের ক্ষেত্রে উদ্ভূত অসুবিধাসমূহ উঠিয়ে নিয়েছে, যা সচরাচর মানুষের পক্ষে মানিয়ে নেয়া কষ্টকর। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَمَا جَعَلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلدِّينِ مِنۡ حَرَجٖۚ ﴾ [الحج : ٧٨]
‘‘আর তিনি দীনের মধ্যে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেন নি’’[77]।
﴿ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘‘আল্লাহ তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করতে চান না...’’[78]।
এ দৃষ্টিকোণ থেকেই ইবাদাতে রুখসাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেমন অসুস্থ ও মুসাফির ব্যক্তির জন্য রমযানে সাওম ভঙ্গের রুখসাত ও অনুমতি রয়েছে। এছাড়াও মুসাফির ব্যক্তির জন্য সফরে কসর সালাত আদায়ের বিধান রাখা হয়েছে। এ রকম রুখসাত শারীয়ায় আরো অনেক রয়েছে।
2. মানুষ যাতে স্বাচ্ছন্দের সাথে জীবন যাপন করতে পারে সেজন্য অন্ন, বস্ত্র ও সংস্থান হিসাবে নানা প্রকার অসংখ্য পবিত্র বস্তুও ব্যবহার তাদের জন্য বৈধ করে দেয়া হয়েছে।
3. মুয়ামিলাতের ক্ষেত্রে ইজারাহ, বাই’ সালাম, মুদারাবাহ প্রভৃতি ব্যবসায় পদ্ধতি জায়েয করা হয়েছে।
জীবনের শোভাবর্ধনকারী বিষয়সমূহ (তাহ্-সিনিয়্যাত) :
তাহ-সিনিয়্যাত হচ্ছে যা জরুরত ও প্রয়োজনীয়তার পর্যায়ে পড়ে না। বরং তা শোভাবর্ধনকারী সৌন্দর্যের পর্যায়ে পড়ে। এর সংজ্ঞায় বলেন ইমাম শাতিবী রহ, ‘যা উত্তম বলে বিবেচিত তা গ্রহণ করা এবং সুস্থ সবল বিবেক ঘৃণা করে এমন সব নিকৃষ্ট জিনিস পরিহার করা..’’[79]।