ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য : বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব
ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য :
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব
ভূমিকাঃ
আল্লাহ রাববুল আলামীন মানুষ ও এ বিশ্বজগতসহ সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। সুস্থ, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবন-ব্যবস্থা হিসাবে মানুষকে প্রদান করেছেন ইসলামী শরীয়াহ্।
শারীয়াহ্ এর সংজ্ঞাঃ
‘শারীয়াহ্’ একটি আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দীন, ধর্ম, জীবন-পদ্ধতি, নিয়ম-নীতি ইত্যাদি[1]। তবে আরবী ভাষায় শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল - পানির উৎসস্থল বা যে স্থান থেকে পানি উৎসারিত হয়ে গড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ সেখানে এসে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করে[2]।
পরিভাষায় শারীয়াহ্ এর সংজ্ঞায় ইমাম ইবনু তাইমিইয়াহ বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা যে সব আকীদা ও আমল মানুষের জন্য প্রণয়ন করেছেন, তা-ই শারীয়াহ্’[3]। অন্যত্র তিনি বলেছেন, শারীয়াহ্ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উলুল আমর (তথা মুসলিম প্রশাসক ও আমীর) এর আনুগত্য করা’[4]।
ইসলামী শারীয়াহ্ এর সংজ্ঞা আরো সহজভাবে আমরা এভাবে দিতে পারি, ‘‘মহান আল্লাহ তা‘আলা জীবন ও জগত পরিচালনার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে স্বীয় বান্দাদেরকে যে সার্বিক হুকুম ও বিধান প্রদান করেছেন, তা-ই হল ইসলামী শারীয়াহ্’’।
ইসলামী শরীয়াহ্ এর বৈশিষ্ট্যঃ
ইসলামী শরীয়াহ্ এর অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তন্মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যসমূহ নীচে তুলে ধরা হল।
১। এটি রাববানী তথা আল্লাহ প্রদত্তঃ
এ শরীয়াহ্ প্রণয়ন করেছেন সে মহান স্রষ্টা, যিনি মানুষ ও জগত সৃষ্টি করেছেন এবং জগতের স্থান কাল ও পাত্র ভেদে মানুষের জন্য কি কি সবচেয়ে কল্যাণকর তা তিনি জানেন। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَرَبُّكَ يَخۡلُقُ مَا يَشَآءُ وَيَخۡتَارُۗ مَا كَانَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُۚ سُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٦٨ ﴾ [القصص: ٦٨]
‘‘আপনার প্রতিপালক যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং যাকে ইচ্ছা মানোনীত করেন, এতে তাদের কোনো এখতিয়ার নেই। আল্লাহ পবিত্র, মহান এবং তারা যে শরীক করে তা হতে তিনি উর্ধ্বে’’[5]।
﴿ أَلَا يَعۡلَمُ مَنۡ خَلَقَ وَهُوَ ٱللَّطِيفُ ٱلۡخَبِيرُ ١٤ ﴾ [الملك: ١٤]
‘‘যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না? তিনি সুক্ষ্মদর্শী ও সম্যক অবহিত’’[6]।
﴿ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ٧١ ﴾ [الانفال: ٧١]
‘‘আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’’[7]।
অতএব ইসলামী শরীয়াহ সকল প্রকার ত্রুটিমুক্ত ও মানবতার জন্য সবচেয়ে বেশী কল্যাণকর।
২। এটি গোটা বিশ্ব মানবতার জন্যঃ
ইসলামী শরীয়াহ এর সমস্ত আহকাম, বুনিয়াদী নীতিমালা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জাতি, দেশ ও বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧ ﴾ [الانبياء: ١٠٧]
‘‘আর আমি তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমতস্বরূপই পাঠিয়েছি’’[8]।
﴿ قُلۡ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنِّي رَسُولُ ٱللَّهِ إِلَيۡكُمۡ جَمِيعًا ﴾ [الاعراف: ١٥٧]
‘‘বলুন, হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সকলের কাছে প্রেরিত আল্লাহর রাসূল’’[9]।
﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا كَآفَّةٗ لِّلنَّاسِ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗا وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٢٨ ﴾ [سبا: ٢٨]
‘‘আর আমি তো আপনাকে সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি’’[10]।
৩। ব্যাপকতাঃ
ইসলামী শরীয়াহ্-এ রয়েছে মানব জীবনের প্রতিটি দিকের সাথে সম্পর্কিত নীতিমালা, আহকাম ও আইন-কানুন, চাই তা মানুষের আকীদা, ইবাদাত ও চরিত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক কিংবা ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিচার পদ্ধতি সংক্রান্ত হোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩ ﴾ [النحل: ٨٩]
‘‘আমি প্রত্যেক বিষয়ে ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং মুসলিমদের জন্য হিদায়াত, রহমাত ও সুসংবাদস্বরূপ আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছি’’[11]।
৪। মৌলিকত্ব ও চিরস্থায়ীত্ব:
ইসলামী শরীয়াহ্ এর নীতিমালা মৌলিক এবং এর উৎস সংরক্ষণের দায়িত্ব আল্লাহ নিজে নিয়েছেন বলে তা কিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী। আল্লাহ বলেন,
﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا ٱلذِّكۡرَ وَإِنَّا لَهُۥ لَحَٰفِظُونَ ٩ ﴾ [الحجر: ٩]
“নিশ্চয়ই আমিই কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষক’’[12]।
৫। পালনে সহজতা ও কঠোরতা বিলোপঃ
মানুষ যাতে ইসলামী শারীয়াহ্ এর আহকাম অত্যন্ত সহজে পালন করতে পারে মহান আল্লাহ তা‘আলা সেভাবেই শারয়ী নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। তদুপরি পালন করতে গিয়ে যখনই কেউ কোন যুক্তিগ্রাহ্য সমস্যার মুখোমুখি হয়, তখনই তার উপর থেকে হুকুমের ভার হালকা করে দেয়া হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥]
‘‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজতা চান এবং তোমাদের জন্য কঠোরতা তিনি চান না’’[13]।
﴿ وَمَا جَعَلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلدِّينِ مِنۡ حَرَجٖۚ ﴾ [الحج : ٧٨]
‘‘আল্লাহ দীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেন নি’’[14]।
﴿ لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفۡسًا إِلَّا وُسۡعَهَاۚ ﴾ [البقرة: ٢٨٦]
‘‘আল্লাহ কারো উপর এমন কোন দায়িত্ব অর্পণ করেন না যা তার সাধ্যাতীত’’[15]।
৬। বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক ব্যাপারে চমৎকার সমন্বয়ঃ
ইসলামী শরীয়াহ্ একদিকে যেমন ইবাদাত পালনের মাধ্যমে মানুষকে আখিরাতমুখী হবার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে, অন্যদিকে দুনিয়ার বাস্তব জীবনের প্রয়োজন ও দাবী পূরণের নির্দেশও তাকে দিয়েছে। দুনিয়ার কাজ ও ব্যস্ততার মধ্যেও যাতে মানুষ আল্লাহর ইবাদাত পালন করে সেদিকে ইঙ্গিত করে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ رِجَالٞ لَّا تُلۡهِيهِمۡ تِجَٰرَةٞ وَلَا بَيۡعٌ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَإِقَامِ ٱلصَّلَوٰةِ وَإِيتَآءِ ٱلزَّكَوٰةِ يَخَافُونَ يَوۡمٗا تَتَقَلَّبُ فِيهِ ٱلۡقُلُوبُ وَٱلۡأَبۡصَٰرُ ٣٧ ﴾ [النور : ٣٧]
‘‘সে সব লোক যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেদিনকে যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে’’[16]।
আবার ইবাদাত পালনের পাশাপাশি তাদেরকে জীবিকা অর্জনের নির্দেশও প্রদান করা হচ্ছে।
﴿ فَإِذَا قُضِيَتِ ٱلصَّلَوٰةُ فَٱنتَشِرُواْ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَٱبۡتَغُواْ مِن فَضۡلِ ٱللَّهِ ﴾ [الجمعة: ١٠]
‘‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) সন্ধান কর’’[17]।
৭। ব্যক্তি ও সমষ্টির যথার্থ মূল্যায়নঃ
ইসলামী শরীয়াহ্ ব্যক্তি ও সমষ্টির কারো স্বার্থহানি না করে সকলের স্বার্থের প্রতি সমান দৃষ্টি রেখেছে। ইসলামে ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তিস্বার্থকে কখনো অবজ্ঞা করা হয় না, তবে ব্যক্তি ও সামষ্টিক স্বার্থের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তখন সামষ্টিক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়।
৮। যুগোপযোগিতাঃ
ইসলামী শরীয়াহ্ প্রগতিশীল। কেননা কালের আবর্তনে উদ্ভূত সকল সমস্যার সমাধানের জন্য কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক চিন্তা-গবেষণার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এতে রয়েছে। সুতরাং যাবতীয় নতুন অবস্থার সাথে তা সামঞ্জস্যশীল হতে সক্ষম। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেমন এর সফল কার্যকারিতা রয়েছে, তেমনি কিয়ামত পর্যন্ত এর কার্যকারিতা অক্ষুন্ন থাকবে। কেননা কিয়ামত পর্যন্ত এটিই আল্লাহর দেয়া সর্বশেষ ও একমাত্র জীবন ব্যবস্থা।
৯। উদারতাঃ
ইসলামী শারীয়াহ্ উদারতা সম্পন্ন। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
بُعِثْتُ بِالْحَنِيفِيَّةِ السَّمْحَةِ
‘‘আমাকে উদারতাসম্পন্ন দীন সহকারে প্রেরণ করা হয়েছে’’[18]। এর ফলে এমন কি অমুসলিমগণ ইসলামী রাষ্ট্রে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করে থাকেন।
১০। সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাঃ
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য ন্যায়পরয়ণতার ভিত্তিতে ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ইসলামী শরীয়াহ্ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
ইসলামী শারীয়াহ্ এর গুরুত্বঃ
শারীয়াহ্ ও সমাজের মধ্যে একটি নিবীড় বন্ধন রয়েছে। বহু ব্যক্তির সমন্বয়ে সমাজ গড়ে উঠে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রয়োজনের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টিলগ্ন থেকেই সমাজের প্রত্যেকের রয়েছে নানাবিধ চাহিদা। ব্যক্তি একাই নিজের সে সব চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সমাজের অন্যদের সহযোগিতার প্রতি তাকে মুখাপেক্ষী হতে হয়। ফলে স্বভাবতই মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সমাজবদ্ধ। সমাজের সকলের অধিকারকে সুশৃংখলভাবে সংরক্ষণ করার জন্য প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ আইনী ব্যবস্থা ও বিধানের, যা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করবে, অধিকারের সীমা নির্দিষ্ট করে দেবে ও প্রত্যেকের স্বেচ্ছাচারিতাকে আইনের দ্বারা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত করবে। এ ব্যবস্থা না হলে মানুষের সামষ্টিক জীবন হয়ে পড়বে খুবই দুষ্কর। কেননা মানুষের একটা প্রবণতা হচ্ছে নিজের সুবিধা ও স্বার্থকে বড় করে দেখা। এ প্রবণতা যদি আইন দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত না হয়, তাহলে পারস্পরিক যুলুম-নির্যাতন বেড়ে যাবে, অধিকার ক্ষুন্ন হবে এবং সমাজে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। আর প্রতাপশালী ও কূটজাল বিস্তারকারীদের দৌরাত্ম প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং মানুষ সবসময়ই সুশৃংখল আইন-কানুন সম্বলিত এমন এক ব্যবস্থা মেনে চলার তীব্র প্রয়োজন অনুভব করেছে, যাতে সমাজের সকলের অধিকার নিশ্চিত হয়, কেউ কারো অধিকার হরণ করতে না পারে এবং কেউ-ই তার নিজের সীমা লংঘন করে অন্যের সীমায় অনুপ্রবেশ করতে না পারে। বস্তুত একটা সুষম, কল্যাণমুখী ও সর্বাত্মক ব্যবস্থা ছাড়া মানুষের পক্ষে সুস্থ স্বাভাবিক সমাজ জীবন যাপন করা কোনমতেই সম্ভবপর নয়। এজন্যই আল্লাহর অবতারিত শরীয়ত তাঁর অগণিত অন্য সব নিয়ামতের মতই বিশ্বমানবতার প্রতি এক বিরাট রহমাত হয়ে দেখা দিয়েছে। এর ভিত্তিতেই হতে পারে মানুষের যাবতীয় সমস্যার সার্থক সমাধান ও তাদের পারস্পরিক বিবাদ-বিসম্বাদের সুষ্ঠু মীমাংসা ও নিষ্পত্তি।
বস্তুত আল্লাহর শারীয়াহ্ই হচ্ছে তাঁর বান্দাদের মধ্যে পারস্পরিক ন্যায়পরায়নতা স্থাপনের যথার্থ বিধান। নিঃসন্দেহে সমগ্র মানবতার প্রতি এটা তাঁর অনুগ্রহ ও করূণা। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে নিজ নিজ জীবন, সংগঠন ও সমাজের উৎকর্ষ সাধনের ব্যাপারে কেবলমাত্র তাদের নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী করে ছেড়ে দেন নি। বরং তাদেরকে প্রবৃত্তির স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্ত করেছেন ইসলামী শারীয়াহ্ এর বিধান উপস্থাপন করে। মানব রচিত কোনো বিধানই প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা ও স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্ত ও পবিত্র নয়। তা থেকে মুক্ত ও পবিত্র হচ্ছে আল্লাহর শারীয়াহ্ এর বিধান।
ইসলামী শরীয়াহ্ ও প্রচলিত আইনের মধ্যে পার্থক্যঃ
ইসলামী শারীয়াহ্-এর মতই প্রচলিত মানব রচিত আইনসমূহ যদিও জনস্বার্থের কল্যাণ সাধনের অঙ্গীকার করে এবং সমাজের আইন, শৃংখলা, নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করার আশাবাদ ব্যক্ত করে, কিন্তু এর সাথে ইসলামী শারীয়াহ্-এর রয়েছে অনেক পার্থক্য, যাতে ইসলামী শরীয়াহ্-এর শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব ও মর্যাদা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে সকল মানব রচিত মতবাদ ও আইনের উপর, যা মানুষ তার সীমাবদ্ধ বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে রচনা করেছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য তুলে ধরা হলঃ
১। ইসলামী শরীয়াহ্ আল্লাহ প্রদত্তঃ
মানব রচিত নয় বলে শারীয়াহ্ সব ধরনের ত্রুটিমুক্ত। পক্ষান্তরে মানুষ যেহেতু তার সকল কাজে পদে পদে ভুল-ত্রুটি, অজ্ঞতা ও অক্ষমতার মুখোমুখি হয়, ফলে তাদের তৈরী আইন ও মতবাদ হয়ে থাকে নানাপ্রকার ভুল-ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতায় পরিপূর্ণ। তদুপরি পরিবেশ, প্রবৃত্তি ও ভাবাবেগের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া থেকে তা মোটেই মুক্ত নয়। অথচ শারীয়াহ্ প্রণয়ন করেছেন সর্বজ্ঞানী মহাবিজ্ঞানময় এমন এক ইলাহ, আসমান ও যমীনের অনু পরিমাণ কোনো বস্তুও যার থেকে অদৃশ্য ও অজ্ঞাত থাকে না, যিনি মানুষকে সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছেন। ফলে স্বভাবতই তিনি তাদের সার্বিক কল্যাণের উপযোগী বিধান সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন। ‘মাআ’লিম ফিত-তরীক’ গ্রন্থকার বলেন, ‘‘যে শারীয়াহ্ আল্লাহ মানব জীবনকে সুসংবদ্ধ করার জন্য প্রণয়ন করেছেন তা এমনই এক বিধান যা জগতের সাধারণ নিয়মের সাথে সম্পর্কিত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। ............সুতরাং মানবজীবন ও যে জগতে সে মানব বাস করে তার মধ্যে একটা সুসামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজনেই এ শারীয়াহ্ মেনে চলার আবশ্যকতা সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, বরং যে আইন মানুষের ভেতরের স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে ও যে আইন মানুষের বাহ্যিক জীবনকে পরিচালনা করে এতদুভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়োজনে এবং মানব ব্যক্তিত্বের ভেতর ও বাহিরের দুটি দিকের মধ্যে একটা সঙ্গতি বিধানের তাড়নায়ও এ শারীয়াহ্ মেনে চলা উচিত। মানুষ যখন জগতের সকল নিয়ম নীতি জানার সামর্থ রাখে না এবং সাধারণ জাগতিক নিয়মের সকল দিক আয়ত্বও করতে পারে না, এমন কি যে সত্ত্বা তাদের ফিতরাত ও প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেন ও তাদেরকে নিজের অধীনস্ত করে রাখেন, তারা চাক বা না চাক - সে সত্ত্বাকেও তারা আয়ত্ব করার সামর্থ রাখে না, তাহলে মানব জীবনের জন্য এমন বিধান রচনার অধিকার তাদের নেই, যদ্বারা মানুষের জীবন ও জগতের সঞ্চালনে এবং তাদের সুপ্ত স্বভাব ও বাহ্যিক জীবনে একটা ব্যাপক সামঞ্জস্য সাধিত হতে পারে।.....এ কাজের অধিকার রাখেন জগতের স্রষ্টা, মানুষের স্রষ্টা, যিনি নিজের ইচ্ছামত একটি নিয়মের অধীনে জগত ও মানবকে পরিচালিত করেন...’’[19]।
নিয়ম-কানুন ও আইন প্রণয়নে মানুষের মধ্যে বিস্ময়কর বিরোধিতার উপস্থিতি উপরোক্ত বক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে সত্যায়ন করছে। কেননা পুঁজিবাদে মানুষ অসীম সম্পত্তির মালিক হতে পারে। পক্ষান্তরে কম্যুনিজম ও সমাজতন্ত্র এর পুরোপুরি বিপরীত। সেখানে ব্যক্তি সম্পদের মালিক হতে পারে না। সুতরাং প্রকৃত সত্য কথা হল, মানুষ যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন, সে আসলে অক্ষম এবং তার জ্ঞান যতই বিস্তৃত হোক না কেন, তা সীমিত। অতএব মানুষের পক্ষে এমন বিধান রচনা অসম্ভব যা পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, সকল মানুষের জন্য কল্যাণকর ও উপযোগী এবং সকল জাতির সুখ-শান্তির নিশ্চয়তাদানকারী।
২। ইসলামী শরীয়াহ্ চারিত্রিক তারবিয়াতের উপর গুরুত্ব আরোপ করেঃ
ইসলামী শরীয়াহ্ এর দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিচালনা, ব্যক্তি ও সমষ্টির সার্বিক কল্যাণ এবং জান, মাল, ইজ্জত-আব্রুর হেফাযতের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আখলাক। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إِنَّمَا بُعِثْتُ لِأُتَمِّمَ صَالِحَ الْأَخْلَاقِ
‘‘আমাকে উত্তম ও সৎ চরিত্রের পরিপূর্ণতা সাধনের জন্যই প্রেরণ করা হয়েছে’’[20]।
আর তাই ইসলামী শারীয়াহ্-এর যাবতীয় হুকুম আহকাম চারিত্রিক মূলনীতি ও নৈতিকতার সঙ্গে সর্বতোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ। যারা তাদের আচারে ব্যবহারে, কর্মে ও জীবনের পথ পরিক্রমায় চারিত্রিক সততার দাবী অনুযায়ী চলে, ইসলামী শারীয়াহ্ তাদের সাওয়াব ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করে। আর যারা এর বিপরীত পথে চলে ইসলামী শারীয়াহ্ দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের জন্য ব্যবস্থা করেছে যথার্থ শাস্তির। অন্যদিকে মানবরচিত আইনে এদিকের প্রতি কোন গুরুত্ব নেই। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চারিত্রিক অধঃপতন হিসেবে বিবেচিত হওয়া সত্বেও মানবরচিত আইনে যিনা বা ব্যভিচারের শাস্তি মাত্র দু’টো অবস্থাতেই দেয়া হয়।
(ক) যখন জবরদস্তিমূলক ব্যভিচারে বাধ্য করা হয়।
(খ) যখন একপক্ষের সম্মতি ও অপর পক্ষের অসম্মতি থাকে।
এছাড়া অন্য সকল অবস্থায় ব্যভিচারের শাস্তির কোনো ব্যবস্থা মানবরচিত আইনে নেই। মদ্যপান, সমকামিতা ইত্যাদি আরো অনেক ক্ষেত্রের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। অথচ ইসলামী শারীয়ায় এ সব কিছুই পুরোপুরি নিষিদ্ধ ও আইনত দন্ডনীয়।
৩। ইসলামী শরীয়াহ্-এর দৃষ্টিতে আল্লাহ ও তাঁর দেয়া বিধানের প্রতি সঠিক আকীদা পোষণ হচ্ছে সমাজে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় উপকরণ এবং ব্যক্তি ও ব্যষ্টির কল্যাণ সাধনের মৌল ভিত্তি। কেননা তাকওয়াই শুধু সমাজের সকল মানুষকে সততা ও সত্যের পথে পরিচালিত করতে পারে এবং অন্যায়-অবিচার ও যুলুম থেকে রক্ষা করতে পারে। পক্ষান্তরে মানব রচিত কোনো আইনেই মানুষের স্রষ্টার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনের কোন গুরুত্ব নেই। ফলে সে আইন সমাজ থেকে সকল অন্যায় ও অবিচার দূর করতে অক্ষম।
ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যঃ
সংজ্ঞা, উদাহরণ ও প্রমাণ
ইসলামী শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কথাটিকে আরবীতে নাম দেয়া হয়েছে ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’। শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য গভীরভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য এর আরবী পরিভাষাটির কিছুটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ শিরোনামটিতে দু’টি শব্দ রয়েছে। একটি হচ্ছে মাকাসিদ, যা ‘মাকসাদ’ শব্দের বহুবচন। আরবীতে ‘মাকসাদ’ শব্দটির একাধিক আভিধানিক অর্থ রয়েছে, তন্মধ্যে প্রধানতম অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য[21]। বাংলায় বলা হয় ‘মনযিলে মাকসূদ’ অর্থাৎ গন্তব্যস্থল, যার উদ্দেশ্যে মানুষ যাত্রা করে থাকে। এদিক থেকে ‘মাকসাদ’ ও মাকসূদ শব্দদ্বয়ের অর্থ প্রায় একই।
আরেকটি শব্দ হচ্ছে শারীয়াহ্। ইতোপূর্বে ‘শারীয়াহ্’ এর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ ইসলামী আইন বিষয়ক জ্ঞনের একটি সমৃদ্ধ শাখা, যা স্বয়ং সম্পূর্ণ একটি শাস্ত্র হিসাবে আজ মুসলিম বিশ্বেও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে পঠিত হচ্ছে। সেজন্য ‘ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ কথাটির বদলে এ প্রবন্ধে আমরা ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ কথাটিই বেশী ব্যবহার করব।
‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর পারিভাষিক সংজ্ঞাঃ
পূর্ববর্তী মুসলিম পন্ডিতগণ ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর কোন সুক্ষ্ম পারিভাষিক সংজ্ঞা প্রদান করেন নি, যদিও বিষয়টি তাদের অনেকেরই জানা ছিল। তারা ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর নানা বিষয় যেমন হিকমাত বা প্রজ্ঞা, ইল্লাত বা কার্যকারণ, মাসালিহ বা কল্যাণ এবং মাফাসিদ বা অকল্যাণ প্রভৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। শারীয়াহ্ এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তারা ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন[22]। পরবর্তী সময়ে মুসলিম পন্ডিতগণ ইসলামী জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখার সংজ্ঞা প্রদানে ব্রতী হন। তারই অংশ হিসেবে ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর একাধিক সংজ্ঞা তারা দিয়েছেন। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা দেয়া হলঃ
1. তিউনিসিয়ার প্রখ্যাত মুসলিম পন্ডিত মুহাম্মাদ তাহির ইবনু ‘আশূর বলেন, ‘‘ব্যাপকার্থে মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ হচ্ছে সে সব উদ্দেশ্য ও হিকমাত, শরীয়াহ্ এর সকল কিংবা অধিকাংশ হুকুমের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ যেগুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখেছেন’’[23]।
2. প্রফেসর ড. আহমাদ রাইসূনী বলেন, ‘‘সকল বান্দার কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যে যে সব লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য শরীয়াহ্ প্রণয়ন করা হয়েছে তা-ই হল মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’’[24]।
3. ড. মুহাম্মাদ সা‘দ আল-ইয়ূবী মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর সংজ্ঞায় বলেন, ‘‘মাকাসিদ হচ্ছে সে সকল উদ্দেশ্য, তাৎপর্য ও হিকমাত, শরীয়াহ্ প্রণয়নের সময় সকল বান্দার কল্যাণ সাধনের জন্য সাধারণভাবে ও বিশেষভাবে যেগুলোর প্রতি আল্লাহ লক্ষ্য রেখেছেন’’[25]।
এ সংজ্ঞাগুলো খুবই কাছাকাছি। এগুলোর আলোকে সংক্ষেপে বলা যায় যে, মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ হচ্ছে সে সকল মাসালিহ ও কল্যাণমুখী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সমষ্টি, শরয়ী হুকুম মেনে চলার মাধ্যমে বান্দাদের জন্য যা অর্জিত হওয়ার ইচ্ছা আল্লাহ করে থাকেন।
উদাহরণঃ
মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ এর উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শারীয়াহ্ এর বিভিন্ন হুকুম-আহকাম ও বিষয়সমূহে। ইবাদাত, মুয়া’মালাত, বিবাহ-শাদী, অপরাধ আইন ও কাফফারা প্রভৃতি সকল অধ্যায়েই শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য ও মাকাসিদ বর্ণিত আছে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে, শারীয়াহ্ এর প্রতিটি হুকুম ও শিক্ষা প্রণীত হয়েছে বিশেষ কিছু হিকমাত, উদ্দেশ্য ও এমন সব কল্যাণকে সামনে রেখে যার সুফল বান্দা দুনিয়া ও আখিরাতে লাভ করে থাকে। এ সকল হিকমাত, উদ্দেশ্য ও কল্যাণের অনেকগুলো আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, আবার বেশ কিছু উল্লেখ করা হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহে এবং কিছু কুরআন ও সুন্নাহের মূলনীতির আলোকে উদ্ভাবন করেছেন আলেম, তাফসীরকারক ও মুজতাহিদগণ[26]। সেসবের কিছু উদাহরণ আমরা নিচে উল্লেখ করছি।
অযু ও গোসলের বিধান দেয়া হয়েছে সালাত ও তাওয়াফের কার্য সম্পাদনের জন্য এবং প্রত্যেক মুসলিমের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য, যাতে একটি পরিচ্ছন্ন সভ্য মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সকল জাতির মধ্যে ফুলের মতই সৌন্দর্যের আধার হয়ে বিরাজ করবে।
জামায়াতবদ্ধ সালাত ও জুমুয়া’হ্ এর সালাতের বিধান এসেছে মহান আল্লাহর স্মরণকে জাগরূক করার জন্য, মুসলিমদেরকে সত্য, সততা ও পারস্পরিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য এবং ঈমান-আকীদাকে নবায়ন করা, সহীহ জ্ঞানার্জন করা ও ইবাদাতকে বিশুদ্ধ পন্থায় আদায় করার জন্য।
সালাতের উদ্দেশ্যে আযানের বিধান দেয়া হয়েছে ইবাদাতের সময় হওয়ার ঘোষণা দেয়ার জন্য এবং মানুষকে আল্লাহর ইবাদাতের উদ্দেশ্যে একত্রিত করার জন্য। বস্তুতঃ আযান হচ্ছে মানুষের বাস্তব জীবনে ইসলামের নীতি ও আদর্শ প্রচারের একটি শক্তিশালী মাধ্যম এবং আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও সার্বভৌম ক্ষমতা প্রকাশের একটি উত্তম পন্থা।।
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের বিধান দেয়া হয়েছে আল্লাহর ইবাদাত পালনের জন্য, দিনে পাঁচবার তাঁর সাথে সম্পর্ক নবায়ন করে স্থির আদর্শ ও আনুগত্যের উপর নিজেকে অভ্যস্ত করার জন্য, অলসতা ঝেড়ে ফেলে সময়ানুবর্তিতা ও শৃংখলার অনুসারী হওয়ার জন্য এবং সালাত আদায়কারীকে দুনিয়ার সকল কষ্ট, জীবনের নানাবিধ সমস্যা ও শয়তানের কুপ্ররোচনা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য।
শুকর, মৃতদেহ ও রক্তের ন্যায় অপবিত্র ও নিকৃষ্ট বস্তুসমূহ মুসলিমদের উপর হারাম করার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্য ও আদেশ পালন এবং শারীরিক, মনস্তাত্বিক ও সামাজিক বিপর্যয় ও ক্ষতি পরিহার। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে এ সকল হারাম ও নিকৃষ্ট বস্তু মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
সমাজের সবার মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার নির্দেশ এজন্যই দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যেন নিজ নিজ অধিকার লাভ করে এবং সমাজের ফিতনা, ফাসাদ ও বিবাদ-বিসম্বাদ দূরীভূত হয়। আর মানুষ যেন আইন ও শৃংখলার পথে অধিকার অর্জনের পথে অগ্রসর হয়।
বিবাহ-শাদী, নানাবিধ ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অনেক মু‘য়ামালাত ইসলামী শারীয়াহ্-এর মধ্যে বৈধ করা হয়েছে মানুষের জীবন-ধারণকে সহজতর করার জন্য এবং মানুষের জরুরী ও প্রয়োজনীয় লেনদেনকে সহজ করে মানুষের জীবনযাত্রাকে সমৃদ্ধ ও সুন্দর করার জন্য।
এভাবে ইসলামী শারীয়াহ্ এর সকল বিধানেই নিহিত রয়েছে বিশেষ উদ্দেশ্য, হিকমাত ও কারণ।
‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ এর দলীল ও প্রমাণঃ
আল-কুরআনে ‘মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্’ তথা ইসলামী শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিভিন্ন পদ্ধতি ও পন্থায় পেশ করা হয়েছে্। নিম্নে তার কিছু উদ্ধৃত করা হলঃ
1. আল্লাহ কুরআনের বহু জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি হাকীম ও প্রজ্ঞাবান। আল্লাহ বলেন,
﴿ تَنزِيلٞ مِّنۡ حَكِيمٍ حَمِيدٖ ٤٢ ﴾ [فصلت: ٤٢]
‘‘এটি প্রজ্ঞাবান প্রশংসিত আল্লাহর নিকট হতে অবতারিত’’[27]। তিনি অন্যত্র বলেন,
﴿ تَنزِيلُ ٱلۡكِتَٰبِ مِنَ ٱللَّهِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَكِيمِ ١ ﴾ [الزمر: ١]
‘‘এটি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ প্রন্থ’’[28]।
আয়াতসমূহের এ কথাগুলোর অনিবার্য দাবী হল, তাঁর প্রণীত প্রতিটি বিধানের অবশ্যই একটি হিকমাত ও উদ্দেশ্য রয়েছে এবং কোনো কিছুই তিনি অনর্থক উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রচলন করেন নি।
2. আল্লাহ কুরআনের একাধিক স্থানে তিনি নিজেকে সবচেয়ে দয়ালু ও করুণাময় বলে উল্লেখ করেন।
﴿ وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ ﴾ [الاعراف: ١٥6]
‘‘আর আমার দয়া প্রতিটি বস্তুতে ব্যপ্ত হয়েছে’’[29]।
একটি দোয়ায় তিনি এভাবে বলা শিখিয়ে দিয়েছেন যে,
﴿ رَبَّنَآ ءَامَنَّا فَٱغۡفِرۡ لَنَا وَٱرۡحَمۡنَا وَأَنتَ خَيۡرُ ٱلرَّٰحِمِينَ ١٠٩ ﴾ [المؤمنون : ١٠٩]
‘‘হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, অতএব আমাদের ক্ষমা করুন এবং আমাদেরকে রহম করুন। আর আপনিই তো সর্বোত্তম দয়ালু’’[30]।
আর মানুষের প্রতি তাঁর করুণা হচ্ছে, তাদের জন্য এমন সকল বিধান প্রণয়ন যা তাদের জন্য কল্যাণকর। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল কাইয়েম শিফাউল ‘আলীল গ্রন্থে বলেন, ‘‘তাঁর হিকমাত ও তাঁর উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করার অর্থই হল প্রকৃতপক্ষে তাঁর রহমাত ও দয়াকে অস্বীকার করা’’[31]।
3. কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি এই এই কাজ এই এই উদ্দেশ্যে করেছেন। যেমন তিনি বলেন,
﴿ وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ وَيَكُونَ ٱلرَّسُولُ عَلَيۡكُمۡ شَهِيدٗاۗ ﴾ [البقرة: ١٤٣]
‘‘আর অনুরূপভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যমপন্থাবলম্বী জাতি করে দিয়েছি, যাতে তোমরা সকল মানুষের উপর সাক্ষী হয়ে যাও এবং রাসূল তোমাদের উপর সাক্ষী হয়ে যান...’’[32]।
তিনি আরো বলেন,
﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ بِٱلۡحَقِّ لِتَحۡكُمَ بَيۡنَ ٱلنَّاسِ بِمَآ أَرَىٰكَ ٱللَّهُۚ ﴾ [النساء : ١٠٥]
‘‘নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য সহকারে গ্রন্থ নাযিল করেছি যাতে আপনি মানুষের মধ্যে সে বিষয় দিয়ে মীমাংসা করেন যা আল্লাহ আপনাকে দেখিয়েছেন’’[33]।
4. কুরআনের অনেক স্থানে শারীয়াহ্ এর কতিপয় ব্যাপক মাকাসিদ ও উদ্দেশ্যের কথা বর্ণিত হয়েছে আবার কোথাও সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে।
ব্যাপক মাকাসিদের উদাহরণঃ যেমন দীনের সকল ক্ষেত্রে কঠোরতা বিলোপ ও অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশ্য। আল্লাহ বলেন,
﴿ وَمَا جَعَلَ عَلَيۡكُمۡ فِي ٱلدِّينِ مِنۡ حَرَجٖۚ ﴾ [الحج : ٧٨]
‘‘তিনি দীনের মধ্যে তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেন নি’’[34]।
আর কুরআনে সুনির্দিষ্টভাবে জিহাদ, সালাত, সিয়াম, যাকাত ও হাজ্জ প্রভৃতি ইবাদাতসমূহের উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন সালাত সম্পর্কে বলা হয়েছে,
﴿ وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَ لِذِكۡرِيٓ ١٤ ﴾ [طه: ١٤]
‘‘এবং আমাকে স্মরণ করার জন্য সালাত কায়েম কর’’[35]। আর সিয়াম সম্পর্কে বলা হয়েছে,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُتِبَ عَلَيۡكُمُ ٱلصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ١٨٣ ﴾ [البقرة: ١٨٣]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার’’[36]।
মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ চেনার পন্থাসমূহ
ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, শারীয়াহ্ এর প্রতিটি হুকুমের পশ্চাতেই রয়েছে একটি বিশেষ মাকসাদ ও উদ্দেশ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে সে উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটি শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে কোন একটি বিষয়কে শারীয়াহ্ প্রণেতার উদ্দেশ্য বলে দাবী করা কিংবা উদ্দেশ্য নয় বলে ঘোষণা করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার, এর জন্য প্রয়োজন ধীরস্থিরভাবে গভীর চিন্তা-ভাবনা, বিশুদ্ধ নিয়ম-প্রণালীর অনুসরণ এবং সেসব সুস্পষ্ট উপায় ও পন্থাসমূহ সুনির্দিষ্ট করা যদ্বারা সেগুলোকে সহজেই চেনা যাবে।
মাকাসিদ আশ্-শারীয়াহ্ সম্পর্কে জানার এ ধরনের উপায় হচ্ছে মোট পাঁচটি[37]
1. আল-ইস্তেকরা তথা গবেষণাভিত্তিক অনুসন্ধানঃ
ইস্তেকরা হচ্ছে শরীয়াহ্-এর সকল দলীল ও হুকুম-আহকাম পূর্ণ অনুসন্ধান করে শারীয়াহ্ এর উদ্দেশ্য ও মাকাসিদ এর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া। যেমন, শরীয়াহ্-এর সকল দলীল ও হুকুম-আহকাম অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, মানব জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ (আদ্-দারুরিয়্যাত) সর্বমোট পাঁচটিঃ দীন, প্রাণ বা জীবন, বিবেক-বুদ্ধি, সম্পদ ও বংশধারার হেফাযত। অতএব সহজেই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, এ পাঁচটি বিষয়ের হেফাযত ও সংরক্ষণ শারীয়াহ্ প্রণেতার অন্যতম উদ্দেশ্য।
2. শার‘য়ী নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞাসমূহের কারণ জানাঃ
ইসলামী শারীয়াহ্-তে যে সকল নির্দেশাবলী কিংবা নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যে কারণ দর্শানো হয়েছে তদ্বারা শারীয়াহ্-এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ﴾ [البقرة: ٢١]
‘‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা তোমাদের সে প্রতিপালকের ইবাদাত কর যিনি তোমাদেরকে ও তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার’’[38]।
﴿ وَنَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡكِتَٰبَ تِبۡيَٰنٗا لِّكُلِّ شَيۡءٖ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٗ وَبُشۡرَىٰ لِلۡمُسۡلِمِينَ ٨٩ ﴾ [النحل: ٨٩]
‘‘আর আমি আপনার উপর গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি সকল কিছুর স্পষ্ট ব্যাখ্যা করার জন্য এবং মুসলিমদের উদ্দেশ্যে হেদায়াত ও রহমাত এবং সুসংবাদ প্রদানের জন্য...’’[39]।
﴿ مَّآ أَفَآءَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡقُرَىٰ فَلِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ كَيۡ لَا يَكُونَ دُولَةَۢ بَيۡنَ ٱلۡأَغۡنِيَآءِ مِنكُمۡۚ ﴾ [الحشر: ٧]
‘‘আল্লাহ জনপদবাসীদের নিকট হতে তাঁর রাসূলকে যা কিছু দিয়েছেন তা আল্লাহর, তাঁর রাসূলের, রাসূলের স্বজনগণের, ইয়াতীমদের, অভাবগ্রস্ত ও পথচারীদের, যাতে তোমাদের মধ্যে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মধ্যেই সম্পদ আবর্তন না করে’’[40]।