মৃত ব্যক্তির দাফন কাফন
আব্দুল্লাহ আল মামুন আল-আযহারী
সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সূচিপত্র
ভূমিকা... 3
১- মৃত্যুর সাথে সাথে উপস্থিত লোকদের করণীয়: 6
২- উপস্থিত লোকদের যেসব কাজ করা জায়েয. 14
৩- মাইয়্যেতের আত্মীয় স্বজনের করণীয়. 17
৪- মাইয়্যেতের আত্মীয় স্বজনের জন্য যেসব কাজ করা হারাম. 25
৫- মাইয়্যেতের উত্তম পরিণতির কিছু আলামত.. 32
৬- মাইয়্যেতের প্রতি মানুষের প্রশংসা.. 44
৭- মাইয়্যেতকে গোসল দেওয়ার পদ্ধতি... 47
৮- কাফন পড়ানো.... 59
৯- জানাযা সালাত আদায় পদ্ধতি... 63
১০- মাইয়্যেতকে বহন করা ও দাফনের হুকুম. 69
১১- দাফন কাজে মজুরী গ্রহণের হুকুম. 70
১২- জানাযা বহনের নিয়ম. 70
১৩- মাইয়্যেত দাফনের নিয়মাবলি.. 76
১৪- কবর খননের হুকুম ও কবরের বৈশিষ্ট্য.. 83
১৫- গর্ভবতী নারী দাফনের বিধিবিধান. 94
১৬- কবর যিয়ারত.. 96
সংক্ষিপ্ত বর্ণনা.............
এ প্রবন্ধে মানুষ মারা গেলে তার দাফন কাফন, উপস্থিত লোকজন ও আত্মীয় স্বজনের করণীয়, মাইয়্যেতের গোসল, কাফন পড়ানো, জানাযার সালাত আদায় ও কবর যিয়ারতসহ আরো অনেক বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
ভূমিকা
আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি মানুষ তথা প্রাণিকে নির্দিষ্ট সময় সীমা দিয়ে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সে সময় সীমা পেরিয়ে গেলে সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। কেউ এ অমোঘ বিধান থেকে পালাতে পারবে না। আল্লাহ বলেছেন,
﴿كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۗ وَنَبۡلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلۡخَيۡرِ فِتۡنَةٗۖ وَإِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ ٣٥﴾ [الانبياء: ٣٥]
“প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে; আর ভালো ও মন্দ দ্বারা আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমার কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ৩৫]
﴿كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۖ ثُمَّ إِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ ٥٧﴾ [العنكبوت: ٥٧]
“প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে, তারপর আমার কাছেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে”। [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৫৭]
“তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর। আর যদি তাদের কাছে কোনো কল্যাণ পৌঁছে তবে বলে, ‘এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে’। আর যদি কোনো অকল্যাণ পৌঁছে, তখন বলে, ‘এটি তোমার পক্ষ থেকে’। বলুন, ‘সব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে’। সুতরাং এই কাওমের কী হলো, তারা কোনো কথা বুঝতে চায় না!” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৭৮]
“কখনই না, যখন প্রাণ কণ্ঠাগত হবে। আর বলা হবে, ‘কে তাকে বাঁচাবে’? আর সে মনে করবে, এটিই বিদায়ক্ষণ। আর পায়ের গোছার সঙ্গে পায়ের গোছা জড়িয়ে যাবে। সেদিন তোমার রবের কাছেই সকলকে হাঁকিয়ে নেওয়া হবে”। [সূরা আল-কিয়ামা, আয়াত: ২৬-৩০]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ يَعْنِي الْمَوْتَ».
“তোমরা বেশি করে স্বাদ হরণকারী বিষয় অর্থাৎ মৃত্যুর আলোচনা করবে”।[1]
মানুষ মারা গেলে তাকে দাফন কাফন করা ও সসম্মানে দুনিয়া থেকে বিদায় দেওয়া অন্য মুসলিমের ওপর ফরযে কিফায়া। কিছু সংখ্যক লোক তা আদায় করলে অন্যদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু কেউ আদায় না করলে সবাই গুনাহগার হবে। কোনো মুসলিম মারা গেলে অন্যদের ওপর নিম্নোক্ত কাজগুলো করা অত্যাবশ্যকীয়:
১- মৃত্যুর সাথে সাথে উপস্থিত লোকদের করণীয়:
ক- মৃত্যু ব্যক্তির চোখ বন্ধ করে দেওয়া। তার জন্য কল্যাণকর দো‘আ করা। কেননা আবূ সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন মারা যান, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর চোখ বন্ধ করে দিয়েছেন।
উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে গেলেন। তখন তার চোখগুলো উল্টো ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চোখগুলো বন্ধ করে দিলেন এবং বললেন, রূহ যখন নিয়ে যাওয়া হয়, তখন চোখ তৎপ্রতি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এ কথা শুনে তার পরিবারের লোকেরা উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলেন। তিনি বললেন, তোমরা নিজেদের জন্য অমঙ্গলজনক কোনো দো‘আ করো না। কেননা ফিরিশতাগণ তোমাদের কথার ওপর আমীন বলে থাকেন। তিনি তারপর বললেন হে আল্লাহ! তুমি আবূ সালামাকে মাফ করে দাও, হিদায়াতপ্রাপ্তদের মধ্যে তার দরজাকে বুলন্দ করে দাও এবং তার উত্তরাধিকারীদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিযুক্ত কর। হে রাব্বুল আলামীন! আমাদেরকে ও তাকে মাফ করে দাও, তার জন্য কবরকে প্রশস্ত করে দাও এবং তার কবরকে আলোকময় করে দাও”।[2]
খ- মৃত ব্যক্তিকে চাদর দিয়ে সমস্ত শরীর ঢেকে দেওয়া। আবূ সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা আমাকে বলেছেন, (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের খবর পেয়ে) আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘সুন্হ’-এ অবস্থিত তার বাড়ি থেকে ঘোড়ায় চড়ে চলে এলেন এবং নেমে মসজিদে প্রবেশ করলেন। সেখানে লোকদের সাথে কোনো কথা না বলে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার ঘরে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে অগ্রসর হলেন। তখন তিনি একখানি ‘হিবারাহ’ ইয়ামানী চাদর দ্বারা আবৃত ছিলেন। আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করে তাঁর ওপর ঝুকে পড়লেন এবং চুমু খেলেন, তারপর কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন, ইয়া নবীয়্যাল্লাহ! আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আল্লাহ আপনার জন্য দুই মৃত্যু একত্রিত করবেন না। তবে যে মৃত্যু আপনার জন্য নির্ধারিত ছিল তা তো আপনি কবুল করেছেন”।[3]
গ- তবে মুহরিম হলে তাকে ঢাকা হবে না। কেননা মুহরিমের চেহারা ও মাথা ঢাকা হয় না। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“এক ব্যক্তি আরাফাতে ওয়াকূফ অবস্থায় হঠাৎ তার উটনী থেকে পড়ে যায়। এতে তার ঘাড় মটকে গেল অথবা বর্ণনাকারী বলেছেন, তাঁর ঘাড় মটকিয়ে দিল। (এতে সে মারা যায়)। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে বরই পাতাসহ পানি দিয়ে গোসল করাও এবং দু’ কাপড়ে তাকে কাফন দাও। তাকে সুগন্ধি লাগাবে না এবং তার মাথা ঢাকবে না। কেননা কিয়ামতের দিন সে তালবিয়া পাঠ করতে করতে উত্থিত হবে”।[4]
ঘ- মৃত ব্যক্তিকে গোসল, জানাযার সালাত এবং দাফনের ক্ষেত্রে দ্রুততা অবলম্বন করা। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَسْرِعُوا بِالْجِنَازَةِ، فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُونَهَا، وَإِنْ يَكُ سِوَى ذَلِكَ، فَشَرٌّ تَضَعُونَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ»
“তোমরা জানাযা নিয়ে দ্রুতগতিতে চলবে। কেননা, সে যদি সৎলোক হয়, তবে এটা উত্তম, যার দিকে তোমরা তাকে এগিয়ে দিচ্ছ আর যদি সে অন্য কিছু হয়, তবে সে একটি অকল্যাণ, যাকে তোমরা তোমাদের ঘাড় থেকে দ্রুত নামিয়ে ফেলছ”।[5]
ঙ- মৃত ব্যক্তি যে এলাকায় মারা যাবে তাকে সেখানেই দাফন করা। কেননা উহুদ যুদ্ধের শহীদদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানেই দাফন করেছিলেন। জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«لَمَّا كَانَ يَوْمُ أُحُدٍ جَاءَتْ عَمَّتِي بِأَبِي لِتَدْفِنَهُ فِي مَقَابِرِنَا، فَنَادَى مُنَادِي رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «رُدُّوا القَتْلَى إِلَى مَضَاجِعِهِمْ»
“উহুদের দিন আমার ফুফু আমার (শহীদ) পিতাকে আমাদের কবরস্থানে দাফনের জন্য নিয়ে এলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘোষক ঘোষণা দিলেন, নিহতদের শাহাদাতের স্থানে ফিরিয়ে নিয়ে এসো”।[6]
চ- মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধের ব্যবস্থা করা। মৃত ব্যক্তির পরিবার যদি তা আদায়ে অক্ষম হয় তবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আদায় করে দিতে হবে। অন্য কোনো দানশীল ব্যক্তি তার পক্ষ থেকে আদায় করে দিলেও আদায় হয়ে যাবে। সা‘দ উবনুল আতওয়াল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,
“তার ভাই মারা গেলেন এবং তিনশত দিরহাম ও কতক অসহায় সন্তান রেখে যান। আমি সেগুলো তার সন্তানদের জন্য খরচ করতে মনস্থ করলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার ভাই দেনার কারণে আটক রয়েছে। অতএব, তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করো। সা‘দ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি তার পক্ষ থেকে সব দেনা শোধ করেছি, কেবল এক মহিলার দাবিকৃত দু’টি দীনার বাকী আছে। কিন্তু তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। তিনি বলেন, তা তাকে দিয়ে দাও, কারণ সে সত্যবাদিনী”।[7]
সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“আমরা এক জানাযায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তিনি তিনবার জিজ্ঞাসা করলেন: এখানে অমুক গোত্রের কেউ আছে কি? এক ব্যক্তি দাঁড়ালে তিনি বললেন, তুমি প্রথম দুইবার উত্তর দাও নি কেন? আমি তোমার ভালোর জন্যই ডেকেছি। এরপর তিনি তাদের এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলেন, সে তো মারা গেছে, কিন্তু সে দেনার দায়ে আবদ্ধ রয়েছে”।[8]
২- উপস্থিত লোকদের যেসব কাজ করা জায়েয:
মাইয়্যেতের চেহারা খুলে দেখা, চুম্বন করা, তিন দিন পর্যন্ত কান্না করা জায়েয। জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“(উহুদ যুদ্ধে) আমার পিতা (আব্দুল্লাহ) শহীদ হয়ে গেলে আমি তার মুখমণ্ডল থেকে কাপড় সরিয়ে কাঁদতে লাগলাম। লোকেরা আমাকে নিষেধ করতে লাগল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নিষেধ করেন নি। আমার ফুফী ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহাও কাঁদতে লাগলেন। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কাঁদ বা না-ই কাঁদ (উভয় সমান), তোমরা তাকে তুলে নেওয়া পর্যন্ত ফিরিশতাগণ তাদের ডানা দিয়ে ছায়া বিস্তার করে রেখেছেন”।[9]
আবূ সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা আমাকে বলেছেন,
“(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের খবর পেয়ে) আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘সুন্হ’-এ অবস্থিত তাঁর বাড়ি থেকে ঘোড়ায় চড়ে চলে এলেন এবং নেমে মসজিদে প্রবেশ করলেন। সেখানে লোকদের সাথে কোনো কথা না বলে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার ঘরে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে অগ্রসর হলেন। তখন তিনি একখানি ‘হিবারাহ’ ইয়ামানী চাদর দ্বারা আবৃত ছিলেন। আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখমণ্ডল উম্মুক্ত করে তার উপর ঝুকে পড়লেন এবং চুমু খেলেন, তারপর কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর নবী! আমার পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক। আল্লাহ আপনার জন্য দুই মৃত্যু একত্রিত করবেন না। তবে যে মৃত্যু আপনার জন্য নির্ধারিত ছিল তা তো আপনি কবুল করেছেন”।[10]
আব্দুল্লাহ ইবন জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمْهَلَ آلَ جَعْفَرٍ ثَلَاثًا أَنْ يَأْتِيَهُمْ، ثُمَّ أَتَاهُمْ، فَقَالَ: «لَا تَبْكُوا عَلَى أَخِي بَعْدَ الْيَوْمِ»
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফর পরিবারকে কান্নাকাটি করার জন্য তিন দিন সময় দিলেন। অতঃপর তিনি জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরিবারের কাছে এসে বললেন, তোমরা আমার ভাইয়ের জন্য আজকের দিনের পরে আর কাঁদবে না”।[11]
৩- মাইয়্যেতের আত্মীয় স্বজনের করণীয়:
ক- মাইয়্যেতের আত্মীয় স্বজন মৃত্যুর খবর দ্রুত জানিয়ে দিবে।
খ- আল্লাহর ফয়সালায় ধৈর্যধারণ করা ও সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহ বলেছেন,
“আর আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা, তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত”। [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৫৫-১৫৭]
আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যিনি কবরের পাশে কাঁদছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি আল্লাহকে ভয় কর এবং সবর কর। মহিলাটি বললেন, আমার কাছ থেকে চলে যান। আপনার ওপর তো আমার মতো মসীবত আসে নি। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চিনতে পারেন নি। পরে তাকে বলা হলো, তিনি তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তখন তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লানের কাছে হাযির হলেন, তাঁর কাছে কোনো পাহারাদার পেলেন না। তিনি আরয করলেন, আমি আপনাকে চিনতে পারি নি। তিনি বললেন: সবর তো বিপদের প্রথম অবস্থাতেই”।[12]
কারো সন্তান মারা গেলে সে ধৈর্যধারণ করলে তার বিনিময় অনেক। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَا مِنَ النَّاسِ مِنْ مُسْلِمٍ، يُتَوَفَّى لَهُ ثَلاَثٌ لَمْ يَبْلُغُوا الحِنْثَ، إِلَّا أَدْخَلَهُ اللَّهُ الجَنَّةَ بِفَضْلِ رَحْمَتِهِ إِيَّاهُمْ»
“কোনো মুসলিমের তিনটি সন্তান বালিগ হওয়ার পূর্বে মারা গেলে তাদের প্রতি রহমতস্বরূপ অবশ্যই আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তিকে জান্নাতে দাখিল করবেন”।[13]
আবূ সা‘ঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,
“মহিলাগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, আমাদের জন্য একটি দিন নির্ধারিত করে দিন। তারপর তিনি একদিন তাদের ওয়ায-নসীহত করলেন এবং বললেন, “যে স্ত্রীলোকের তিনটি সন্তান মারা যায়, তারা তার জন্য জাহান্নামের প্রতিবন্ধক হবে। তখন এক মহিলা প্রশ্ন করলেন, দু’সন্তান মারা গেলে? তিনি বললেন, দু’সন্তান মারা গেলেও”।[14]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لاَ يَمُوتُ لِمُسْلِمٍ ثَلاَثَةٌ مِنَ الوَلَدِ، فَيَلِجَ النَّارَ، إِلَّا تَحِلَّةَ القَسَمِ» قَالَ أَبُو عَبْدِ اللَّهِ: ﴿وَإِن مِّنكُمۡ إِلَّا وَارِدُهَاۚ﴾ [مريم: ٧١]
“কোনো মুসলিমের তিনটি (নাবালিগ) সন্তান মারা গেলে তারপরও সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে -এমন হবে না। তবে শুধু কসম পূর্ণ হওয়ার পরিমাণ পর্যন্ত। আবূ আব্দুল্লাহ (ইমাম বুখারী রহ. কসম পূর্ণ হওয়ার সময় বলতে বুঝিয়ে) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার বাণী ﴿وَإِن مِّنكُمۡ إِلَّا وَارِدُهَاۚ﴾ [مريم: ٧١] “তোমাদের প্রত্যেকেই তা অতিক্রম করবে”।[15]
গ- মৃত সংবাদ শোনে إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ ‘ইন্না লিল্লাহ ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন বলা’।
উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি,
“কোনো মুসলিম যখন কোনো বিপদে পতিত হয়, তখন সে যদি আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী “ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজি‘উন” বলে এবং এ দো‘আ পাঠ করে “হে আল্লাহ! আমাকে বিপদে ধৈর্যধারণের সাওয়াব দান কর এবং এর চেয়ে উত্তম প্রতিদান দিয়ে ধন্য কর”। তবে আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দিয়ে ধন্য করবেন। যখন আবূ সালামার (তার স্বামী) মারা গেলো তখন আমি বললাম, আবূ সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে কে উত্তম হতে পারে? তাঁর পরিবারই প্রথম পরিবার যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হিজরত করেছিল। এরপর আমি ঐ দো‘আ পাঠ করলাম। ফলে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমার জন্য দান করলেন। উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, আমার নিকট হাতিব ইবন আবি বালতা‘আকে দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাহের পয়গাম পাঠালেন। আমি বললাম, আমার একটি মেয়ে রয়েছে আর আমি একটু অভিমানী। তিনি বললেন, তোমার মেয়ের জন্য আমি দো‘আ করছি যেন আল্লাহ তার সুব্যবস্থা করে দেন এবং এটাও দো‘আ করছি যে, তিনি তোমার অভিমানকে দুর করে দেন”।[16]
ঘ- ধৈর্যধারণ করা মানে এটা নয় যে, নারীরা সম্পূর্ণরূপে সাজসজ্জা পরিহার করবে। সন্তান বা অন্যদের ক্ষেত্রে তিন দিন শোক পালন করবে, আর স্বামীর জন্য চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে।
যায়নাব বিনতে আবূ সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“যখন শাম (সিরিয়া) থেকে (তাঁর পিতা) আবূ সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যু সংবাদ পৌঁছাল, তার তৃতীয় দিন উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা হলুদ বর্ণের সুগন্ধি আনলেন এবং তাঁর উভয় গাল ও বাহুতে মাখলেন। তারপর বললেন, অবশ্য আমার এর কোনো প্রয়োজন ছিল না, যদি আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একথা বলতে না শোনতাম, যে স্ত্রীলোক আল্লাহ এবং কিয়ামতের দিনের প্রতি ঈমান রাখে তার পক্ষে স্বামী ব্যতীত অন্য কোনো মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশি শোক পালন করা হালাল নয়। অবশ্য স্বামীর জন্য সে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে”।[17]
৪- মাইয়্যেতের আত্মীয় স্বজনের জন্য যেসব কাজ করা হারাম:
মানুষ যখন মারা যায় তখন তার জন্য যেমন করণীয় রয়েছে, তেমনি বর্জনীয়ও রয়েছে। অতএব, এসব কাজ জানা প্রত্যেকটি মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। নিম্নে এসব আলোচনা করা হলো:
ক- মৃত ব্যক্তির জন্য বিলাপ করা হারাম। আবূ মালিক আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“আমার উম্মাতের মধ্যে জাহেলিয়াত বিষয়ের চারটি জিনিস রয়েছে যা তারা ত্যাগ করছে না। বংশ মর্যাদা নিয়ে গর্ব, অন্যের বংশের প্রতি কটাক্ষ, গ্রহ-নক্ষত্রের মাধ্যমে বৃষ্টি প্রার্থনা এবং মৃতদের জন্য বিলাপ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, বিলাপকারিনী যদি তার মৃত্যুর পূর্বে তাওবা না করে, তবে কিয়ামতের দিনে তাকে দাঁড় করানো হবে, তখন তার দেহে আলকাতরার আবরণ থাকবে এবং খোস-পাঁচড়ার পোষাক থাকবে”।[18]