Articles

বাংলাদেশের মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি





মুহাম্মাদ শাহিদুল ইসলাম





সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া





حركة اللغة الأم في بنغلادش وموقف الإسلام منها





(باللغة البنغالية)





محمد شهيد الإسلام





مراجعة: د/ أبو بكر محمد زكريا





সূচিপত্র





ভূমিকা... 3





ভাষা আন্দোলনের অর্থ. 4





বাংলাদেশে মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য.. 7





ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য পর্যালোচনা.. 10





ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা শহীদদের মূল্যায়ন ও আমাদের করণীয়. 42





উপসংহার. 47





সংক্ষিপ্ত বর্ণনা............





ভাষা মহান আল্লাহর এক বড় উপহার। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক নবীকেই তার জাতির ভাষায় পাঠিয়েছেন। সুতরাং ভাষার ভিন্নতা ইসলাম বিরোধী কোনো বিষয় নয়, যদি না ইসলামের আকীদা বা শরী‘আতের সাথে তা সাংঘর্ষিক হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে সেটিই সাব্যস্ত করা হয়েছে।





ভূমিকা





মাতৃভাষা ব্যবহার এবং তার মর্যাদা রক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন হয়েছে এবং হচ্ছে। যথা তুরস্ক, বুলগেরিয়া, মধ্যএশিয়ার অঞ্চলসমূহ এবং ভারতের উত্তর প্রদেশ কিন্তু ভাষার জন্য রক্তদান বা নিহত হওয়ার ঘটনা কেবল বাংলাদেশেই ঘটেছে। বাংলা ১৩৫৯ সালের ৮ ফাল্গুন। যা আজ ৬০ বছর ধরে এ দেশ মাতৃকায় একুশে ফেব্রুয়ারি নামে ভাষা আন্দোলনের স্মরণ দিবস হিসেবে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও গাম্ভীর্যের সাথে উদযাপিত হয়ে আসছে। মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার দীপ্ত শপথ নিয়ে বাংলার কিছু অকুতোভয় বীর সন্তান নিজেদের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করে এক সূর্যস্নাত রক্তিম ইতিহাস। যা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে আরো গভীরে নিয়ে গেছে। আলোচ্য নিবন্ধে ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও এ প্রসঙ্গে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা হবে।





ভাষা আন্দোলনের অর্থ:





মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিই ভাষা। তা কণ্ঠধ্বনির মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনো অঙ্গ প্রত্যঙ্গর ইশারার মাধ্যমে হোক। ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে ড. রামেশ্বর বলেন, “মানুষের বাকযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত কতকগুলো ধ্বনিগত ভাব সংকেত বা প্রতীক সমষ্টির নাম।”[1]





ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে Henry Sweet বলেন, "Language is the expression of ideas by means of speech-sounds combined into words. Words are combined into sentences, this combination answering to that of ideas into thoughts.[2]





ভাষাবিজ্ঞানী Edgar. H. Sturtevant বলেন, "A language is a system of arbitrary vocal symbols by which members of a social group Co-operate and interect.[3]





মানুষ সামজিক জীব। এজন্য তাকে অন্য মানুষের সাথে ভাব বিনিময় করতে হয়। এভাবে বিনিময়ের জন্য যে সব সংকেত প্রতীক ব্যবহৃত হয় তাই ভাষা, এভাবে বিশ্লেষণ করলে ভাষার চারটি মূল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়:





ক. এ কতগুলি ধ্বনির সমষ্টি





খ. এ ধ্বনি কণ্ঠনিঃসৃত





গ. এটি একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ ব্যবস্থা





ঘ. এ ধ্বনিগুলো বস্তু বা ভাবের প্রতীক।[4]





ভাষার সংজ্ঞা প্রদানে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ বলেন, ভাষা হচ্ছে মানুষের ভাব বিনিময় ও প্রকাশের প্রতীকী প্রত্যয় বিশেষ। এটি ধ্বনি ও ইশারা ও ইঙ্গিত উভয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে। তবে পারিভাষিক অর্থে কারো কণ্ঠনিঃসৃত অর্থবোধক ধ্বনিকেই ভাষা নামে অভিহিত করা হয়।[5]





‘আন্দোলন’ শব্দটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য প্রচার বা আলোচনা দ্বারা উত্তেজনা সৃষ্টিকরণকেই আন্দোলন বলে।[6] সুতরাং ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ইসলামে ভূমিকা কী? তা নির্ভর করে ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্যের ওপর।





বাংলাদেশে মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য:





ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ধারণা থেকে জানা যায় যে, বাংলাদেশের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রথমত মূল উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষা ব্যবহার এবং তার সার্বিক উৎকর্ষ সাধন ও চর্চা করার অধিকার আদায় করা। এছাড়া পূর্ববর্তী রাজাদের বিভিন্ন যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, এটি বৌদ্ধ যুগের পর ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী সেন রাজারা বাংলাভাষা চর্চা নিষিদ্ধ করেছিল। আর হিন্দু পুরোহিতরা এ কথা বলে বেড়াতো যে, যে ব্যক্তি বাংলাভাষায় কথা বলবে সে নরকে যাবে। তেমনি বৃটিশ ইংরেজরাও ইংরেজি ভাষা ও তাদের সংস্কৃতি এতদঞ্চলে চাপিয়ে দেওয়ার চরম ষড়যন্ত্র করেছিল।[7] বাঙ্গালী মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ নির্বিশেষে সকল ধর্মের বুদ্ধিজীবীরা সে নিষেধাজ্ঞা এবং ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বাংলাভাষায় বিবিধ সাহিত্য রচনা করে এ ভাষার ভাণ্ডার বিবিধ রতনে সমৃদ্ধ করেন। অতঃপর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে তৎকালীন বিশ্বরাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে চীন ও রাশিয়ার স্টাইলে ভাষাগত ঐক্যের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য সুদঢ় করার লক্ষ্যে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ও তাদের তোষণকারী অনুসারীরা উর্দূকে জাতীয় ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল ভাষাতত্ত্বের এক ভুল ব্যাখ্যার ছত্রছায়ায়। তারই প্রতিবাদে বাংলাভাষা আন্দোলন নতুনরূপে বেগবান হয় মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য।[8]





বাংলাভাষার জন্য আন্দোলনের অপর একটি উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে অফিস আদালতসহ রাষ্ট্রের সর্বস্তরে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা, জাতীয় স্বকীয়তা ও পরিচিতি সারা বিশ্বে আরো উন্নত করা। এজন্য বাংলাভাষা আন্দোলনের অন্যতম শ্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’।[9]





অপর একটি উদ্দেশ্য ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করার জন্য ভাষা আন্দোলন। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুখের ভাষা উপেক্ষা করে অন্য একটি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা চরম অন্যায়, তথা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থী। এ অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে বাংলাভাষা আন্দোলন শুরু হয়। যে জন্য এটি অবশেষে এতদঞ্চলের অবহেলিত জনতার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য দূরীকরণ তথা স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নেয়।





ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য পর্যালোচনা:





ভাষা আন্দোলনের পূর্বোল্লিখিত উদ্দেশ্যের মাঝে এখানে মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকারের বিষয়টি আসে। এর ব্যাখ্যা করতে গেলে আল-কুরআন ও সুন্নাহর দিকে দৃষ্টিপাত করলে মানুষের মাতৃভাষা ব্যবহার করা এবং এ ব্যবহারের অধিকার আদায়ের আন্দোলন সম্পর্কে অনেকগুলো দিক পাওয়া যায়। সেগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো:





ইসলাম ঘোষণা করেছে, মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সৃষ্টিগত তথা জন্মগত অধিকার। কারণ, মহান আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সাথে সাথে তাকে তার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,





﴿ٱلرَّحۡمَٰنُ ١ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ ٢ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ ٣ عَلَّمَهُ ٱلۡبَيَانَ ٤﴾ [الرحمن: ١، ٤]





“দয়াময় আল্লাহ। তিনিই শিক্ষা দিয়াছেন কুরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।” [সূরা আর-রহমান, আয়াত: ১-৪]





এ আয়াতে মানব সৃষ্টির সাথে ভাষা শিক্ষার বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে। এটির কারণ হলো ভাষা মানুষ সৃষ্টির একটি অবিভাজ্য বিষয়। যে ভাষার মাধ্যমে পরস্পরে ভাব বিনিময় করবে, সে ভাষাই হবে পরস্পরের সম্পর্কের সেতুবন্ধন। মানুষের ভাষা মহান আল্লাহ তা‘আলার একটি বিশেষ নি‘আমত। আর মানুষের এ ভাষা কৌশল আল্লাহর ইচ্ছাকৃত সৃষ্টি। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টির সাথে সাথেই তাকে ভাষাজ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন:





﴿وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبِ‍ُٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ ٣٢ قَالَ يَٰٓـَٔادَمُ أَنۢبِئۡهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡۖ فَلَمَّآ أَنۢبَأَهُم بِأَسۡمَآئِهِمۡ قَالَ أَلَمۡ أَقُل لَّكُمۡ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ غَيۡبَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَأَعۡلَمُ مَا تُبۡدُونَ وَمَا كُنتُمۡ تَكۡتُمُونَ ٣٣﴾ [البقرة: ٣١، ٣٣]





“আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন, তারপর সেই সমুদয় ফিরিশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করলেন এবং বললেন: ‘এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’ তারা বলল: ‘আপনি মহান, পবিত্র। আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ব্যতীত আমাদের তো কোনো জ্ঞানই নেই। বস্তুত আপনি জ্ঞানময় ও প্রজ্ঞাময়।’ তিনি বললেন: ‘হে আদম! তাদেরকে এই সকল নাম বলে দাও।’ সে তাদেরকে এ সকলের নাম বলে দিলে তিনি বললেন: ‘আমি কি তোমাদেরকে বলি নি যে, আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীর অদৃশ্য বস্তু সম্বন্ধে আমি নিশ্চিতভাবে অবহিত এবং তোমরা যা ব্যক্ত কর বা গোপন রাখ আমি তাও জানি?” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ৩১-৩৩]





আলোচ্য আয়াতের “আর তিনি আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন অংশ দ্বারা পৃথিবীর সকল ভাষাকে বুঝানো হয়েছে।[10]





প্রত্যেক দেশের মানুষের সাথে ঐ দেশের মাতৃভাষার আত্মার সম্পর্ক বিদ্যমান। ইসলামও এ বিষয়টির প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সত্তাগত ও স্বভাবজাত তথা জন্মগত মৌলিক অধিকার। শুধু মৌলিক অধিকারই নয়। এটি মৌলিক অধিকার জরুরী অবস্থায় রাষ্ট্র কর্তৃক স্থগিত ঘোষিত হতে পারে; কিন্তু ভাষা এমন ধরনের অধিকার যা কখনো হস্তক্ষেপযোগ্য নয়। আর এটি করলে মানবসৃষ্টির কাঠামোতেই হস্তক্ষেপ করা হবে, তার অস্তিত্ব ও সত্ত্বাকে অস্বীকার করা হয়। সুতরাং এ যদি হয় ভাষা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি, তাহলে তা ব্যবহার করার অধিকার আদায় আন্দোলনে নিঃসন্দেহে কোনোরূপ বাধা প্রদান করে না। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলন অধিকার আদায়ের আন্দোলন। আর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করতে ইসলাম বিভিন্নভাবে মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে।





অধিকার আদায়ের জন্য ইসলামে যুদ্ধের প্রয়োজন হলে যুদ্ধ করে অধিকার আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,





﴿أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَٰتَلُونَ بِأَنَّهُمۡ ظُلِمُواْۚ وَإِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ نَصۡرِهِمۡ لَقَدِيرٌ ٣٩﴾ [الحج: ٣٩]





“যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ নিশ্চয় তাদেরকে সাহায্য করতে সম্যক সক্ষম।” [সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত: ৩৯]





আর এ অধিকার আদায় করতে যেয়ে সংঘর্ষ হলে তাতে যদি কেউ মারা করে তাহলে তাকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হবে। কিয়ামতে যার প্রতিদান হবে জান্নাত। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে, যায়িদ ইবন ‘আলী ইবন হুসাইন তার পিতা থেকে তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করে বলেন, “কোনো নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত (মুসলিম) নিজের অধিকার তথা হক আদায়ে যুদ্ধ করে নিহত হলে সে শহীদ।”[11]





অপর এক হাদীসের বর্ণনায় এসেছে যে, সত্যের পথে, ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ও অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করাই সর্বোত্তম জিহাদ। এ প্রসঙ্গে আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে হক তথা সঠিক কথা বলা অর্থাৎ ন্যায় অধিকার প্রদান করার স্পষ্ট দাবী করাই শ্রেষ্ঠ জিহাদ।”[12]





মাতৃভাষার প্রতি প্রত্যেক ধর্মের একটি আলাদা অনুপ্রেরণা রয়েছে। আল-কুরআন আরবী ভাষায় এবং শেষ নবী সারা বিশ্বের মানুষের নবী আরবী ভাষাভাষী, সেহেতু সারা বিশ্বের মানুষের ভাষা হবে আরবী। তাদের মাতৃভাষা ত্যাগ করে শুধু ‘আরবী ভাষায় কথা বলতে হবে। ইসলাম কখনও এমন কথা বলে না। এর সমর্থনে প্রমাণস্বরূপ কুরআন ও হাদীসে অনেক দিক পাওয়া যায়। যেমন,





ইসলাম সারা বিশ্বের মানুষের মাঝে ভাষার বিভিন্নতা ও বৈচিত্রতাকে স্বীকার করে নিয়েছে এবং ঘোষণা করেছে, এ বৈচিত্রতা মানুষের হাতে গড়া নয়। এটি আল্লাহ তা‘আলারই সৃষ্টিকুলে এক রহস্যময় নিদর্শনস্বরূপ। কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন:





﴿وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦ خَلۡقُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفُ أَلۡسِنَتِكُمۡ وَأَلۡوَٰنِكُمۡۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّلۡعَٰلِمِينَ ٢٢﴾ [الروم: ٢٢]





“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম নিদর্শন হলো আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণে বৈচিত্রতা। নিশ্চয় এতে পৃথিবীবাসীর জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।” [সূরা আর-রূম, আয়াত: ২২]





কথা বলা বা ভাব প্রকাশের মাঝে একই রকম। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিভিন্ন কোকিলের সুরে যেমন সাদৃশ্য পাওয়া যায়, তেমনি বিভিন্ন মানুষের সুরে ভাষায়ও সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। তা ছাড়া পরিবেশ পরিস্থিতি তথা আবহাওয়াজনিত কারণে বাক্য বিন্যাস বৈচিত্রতা ও দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতার প্রেক্ষাপটে ভাষায় বিভিন্নতা অহরহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।[13]





ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহ’র মতে, বর্তমান বিশ্বে ভাষার সংখ্যা ২৭৯৬টি। ক্রমান্বয়ে মানুষ বেড়ে যাচ্ছে। এ ক্ষুদ্র বাংলাদেশেই বাংলা ভাষাতে বৈচিত্র লক্ষ্যণীয়। তাই পৃথিবীর অসংখ্য ভাষাকে একটি ভাষায় রূপ দেওয়া ইসলামের উদ্দেশ্য নয় এ দুনিয়াতে। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, “আল্লাহ তা‘আলা সব ভাষাই জানেন।”[14]





আল্লাহ তা‘আলা মানবজাতির হিদায়াতের জন্য প্রায় লক্ষাধিক নবী প্রেরণ করেছেন। এমনকি প্রত্যেক সম্প্রদায় তথা জাতির জন্য আল্লাহ তা‘আলা নবী পাঠিয়েছেন। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেছেন:





﴿إِنَّآ أَرۡسَلۡنَٰكَ بِٱلۡحَقِّ بَشِيرٗا وَنَذِيرٗاۚ وَإِن مِّنۡ أُمَّةٍ إِلَّا خَلَا فِيهَا نَذِيرٞ ٢٤﴾ [فاطر: ٢٤]





“নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সত্য, সুসংবাদ ও সতর্ককারী রূপে। আর এমন কোনো জাতি নেই যার নিকট সতর্ককারী প্রেরিত হয় নি।” [সূরা ফাতির, আয়াত: ২৪]





এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, হিন্দুস্থান, চীন, আরব, গ্রিক তথা সারা বিশ্বের ভিন্ন ভাষা-ভাষী মানুষের নিকট আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। আর তাদের ভাষা ছিল মাতৃভাষা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন:





﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوۡمِهِۦ لِيُبَيِّنَ لَهُمۡۖ فَيُضِلُّ ٱللَّهُ مَن يَشَآءُ وَيَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ﴾ [ابراهيم: ٤]





“এ পৃথিবীতে আমরা যত নবী রাসূল পাঠিয়েছি, প্রত্যেককে তার মাতৃভাষা তথা স্বজাতির ভাষাভাষী করেই পাঠিয়েছি এজন্য যে, তারা যেন মানুষের নিকট আমার দেওয়া দাওয়াত স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে পারেন।” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪]





এ আয়াতের মাধ্যমেও পৃথিবীর সকল ভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। আমরা যদি প্রাচীন নবী-রাসূলদের জীবনেতিহাস বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখতে পাব যে, প্রসিদ্ধ আসমানী গ্রন্থগুলো বিভিন্ন ভাষায় নাযিল হয়েছে। যেমন, তাওরাত হিব্রু ভাষায়, যাবুর ও ইঞ্জীল সুরিয়ানী ভাষায় এবং মহাগ্রন্থ আল-কুরআনুল কারীম আরবী ভাষায়। এটাও ভাষা বৈচিত্র স্বীকৃতির জ্বলন্ত প্রমাণ।





এ প্রসঙ্গে আরো লক্ষ্যণীয় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো-ভাষী নিয়োগ করতেন। সকল দেশের সকল ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যায়িদ ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বিদেশী ভাষা শিক্ষা করতঃ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বুঝে তাদের চিঠিপত্র পড়া, লিখা ও ভাব বিনিময়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন।[15]





মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় পৃথিবীতে কিছু কিছু এলাকার অধিবাসীরা তাদের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছে অফিস আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মাতৃভাষা ব্যবহার করার জন্য সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন করছে। সুতরাং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্দিষ্ট ভাষাভাষী জাতি তাদের পরিচিতি বা স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা জাতীয় প্রতীক ধারণ করা ইসলাম বৈধ হিসেবে দেখে। বিভিন্ন সম্প্রদায় বা জাতির সেই প্রতীকী স্বাতন্ত্র্য বা স্বকীয়তাকে ইসলাম স্বীকৃতি দেয়। আল-কুরআনে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে:





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفۡسٖ وَٰحِدَةٖ وَخَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَبَثَّ مِنۡهُمَا ٗا كَثِيرٗا وَنِسَآءٗۚ......﴾ [النساء: ١]





“হে মানব! তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর তোমাদের রবের, যিনি পয়দা করেছেন তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে এবং যিনি পয়দা করেছেন তার থেকে তার জোড়া, আর ছড়িয়ে দিয়েছেন তাদের দু’জন থেকে অনেক নর ও নারী।...” [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১]





অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,





﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ﴾ [الحجرات: ١٣]





“হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিতি হতে পার। তবে তোমাদের মধ্যে সে-ই অধিক মর্যাদাবান, যে আল্লাহর অধিক তকওয়া অবলম্বন করে।” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]



Recent Posts

মুসলিম মা ও বোনদের প্ ...

মুসলিম মা ও বোনদের প্রতি আহ্বান

যে সকল মহিলাকে বিবাহ ...

যে সকল মহিলাকে বিবাহ করা হারাম

রজব নিয়ে অলীক ভাবনা ...

রজব নিয়ে অলীক ভাবনা

রজব মাসের বেদআত:শরিয়ত ...

রজব মাসের বেদআত:শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি