যেসব মালে যাকাত ফরয হয়
১. পশু ও জন্তু সম্পদের যাকাত: উষ্ট্রের সংখ্য ৫-৯ টি হলে =১টি ছাগী, আবার ১০-১৪ টি হলে =২টি ছাগী এবং ১৪-১৯টি পর্যন্ত =৩টি ছাগী। এভাবে পর্যায়ক্রমে গরু-মহিষ কমপক্ষে ৩০টি হলে ১ বছর বয়সী ১টি বাছুর যাকাত ফরয। তবে শর্ত মালিকানায় একবছর অতিবাহিত হওয়া। ছাগল ও ভেড়া কমপক্ষে ৪০টি হতে ১২০টিতে ১টি ছাগী, ১২১টি হতে ২০০টি পর্যন্ত ২টি ছাগী এভাবে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ঘোড়া ও উট পালন করলে তার যাকাত আদায় করতে হবে।
২. স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাত: সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ স্বর্ণ বা এর তৈরি অলংকার, রৌপ্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি বা এর অলংকার অথবা স্বর্ণ-রৌপ্য উভয়ই থাকলে উভয়েরই মোট মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের সমান হলে, তার বাজার মূল্য ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
৩. ব্যবসায় পণ্যের যাকাত: ব্যবসায়ের মজুদ পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যের বেশী হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
৪. কৃষি সম্পদের যাকাত: কৃষির উৎপন্ন ফসলের ক্ষেত্রে এ যাকাত আদায় করতে হবে তার নাম ওশর। এ ক্ষেত্রে নিসাব হলো, সেচবিহীন জমির ফসলের শতকরা ১০ ভাগ এবং সেচপ্রদানকৃত জমির ফসলের শতকরা ২০ অংশ। আবার নিসাব পরিমাণ ২৬ মন ১০ সের মতান্তরে ৩০ মন না হলে ওশর দিতে হবে না।
৫. মধুর যাকাত: ৫ অসাকের মূল্য হিসেবে মধুর নিসাব ধার্য হবে। অর্থাৎ ৬৫৩ কিলোগ্রাম হলে তাতে ওশর দিতে হবে।
৬. খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদের যাকাত: খনিজ ও সামুদ্রিক সম্পদে এক-পঞ্চমাংশ যাকাত দিতে হবে।
৭. নগদ টাকা ও মজুদ সম্পদের যাকাত: নগদ টাকা বা মজুদ ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যামানের বেশী হলে তার ওপর শতকরা ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।
যে সব সম্পদের যাকাত দিতে হয় না
1. নিসাবের কম পরিমান সম্পদ,
2. নিসাব বছরের মধ্যেই অর্জিত ও ব্যয়িত সম্পদ
3. ব্যবহার্য সামগ্রী
4. শিক্ষা উপকরণ,
5. ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা যা বসবাস কিংবা কলকারখানা হিসেবে ব্যবহৃত
6. যন্ত্রপাতি ও সাজ সরঞ্জাম
7. ব্যবহার্য যানবাহন
8. ব্যবহার্য পশু,
9. ওয়াকফকৃত সম্পত্তি
10.পোষা পাখি ও হাঁস মুরগী।
আর্থ-সামাজিক উন্নযনে যাকাতের ভূমিকা
আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম। ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি এ প্রসঙ্গে বলেন, জরুরী পরিস্থিতিতে যাকাতের রেটের কোন সীমারেখা নেই। যে যত বেশী দান করবে সবার জন্য ততই মঙ্গলজনক। বিভিন্ন তহবিল গঠনে যে প্রচারণা চালানো হয় যাকাত তাদের সব লক্ষ্যই পুরণ করে।[93]
মহান রাববুল আলামীন, মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) খুলাফায়ে রাশেদীনসহ সকল ইমাম ও ইসলামী চিন্তাবিদ যাকাতের ব্যাপারে বারবার তাগিদ দিয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে বলা যেতে পারে যাকাত আদায় করা আমাদের জন্য অপরিহার্য করণীয় কাজ এবং আর্থ সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি যাকাত। যে ব্যাপারে কোন সন্দেহ ও সংশয়ের অবকাশ নেই। যাকাত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের চালিকা শক্তি। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অর্থ ক্ষুধা-দারিদ্র, সন্ত্রাস-নৈরাজ্য, চাঁদাবাজী, দুর্নীতি, হতাশা, শ্রেণী বৈষম্য, অসহনশীলতা, অনৈক্য, দুশ্চিন্তামুক্ত, পারস্পারিক সহযোগিতা সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদে সকল সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য দূর হয়ে সাম্য মৈত্রী ভ্রাতৃত্ব কল্যাণময়তা বিরাজ করে। পরস্পর এগিয়ে আসে একে অপরের দুঃখ দুর্দশা মোচন করতে। ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে ভ্রাতৃত্ব ও ভারসাম্যমূলক এই সামাজিক ব্যবস্থার নাম আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। যে সমাজ আমাদের কাছে স্বপ্নের সোনার হরিণ, আজকের আধুনিক ধনতান্ত্রিক বিশ্ব যে সমাজের কথা কল্পনাও করতে পারে না, সে সমাজ উপহার দিয়েছে ইসলাম এখন থেকে আরো প্রায় পনের শত বছর আগে। খুন, রাহাজানি, হত্যা-কলহ, সুদ, ক্ষুধা, দারিদ্র, অন্যায়-অবিচার, অনৈতিকতা, শ্রেণী বৈষম্য, যিনা ব্যাভিচার, হত্যা ধর্ষণসহ সব অন্যায় অসামাজিক কাজ ছিল যে সমাজের অলংকার, সে শতধাবিভক্ত সমাজকে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা) স্বপ্নের সোনালী সমাজে পরিণত করেছিলেন ইসলাম নামক শান্তির নির্ঝরণীয় মাধ্যমে। যাকাত ছিল যে সমাজের সকল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের রূপকার। নিম্নে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যাকাতের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার বিবরণ বর্ণনা করার প্রচেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ।
১. দুশ্চিন্তামুক্ত সমাজ গঠন: এ কথা আজ অবিসংবাদিত সত্য যে, যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে জাতি সম্পূর্ণরুপে দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারে। একটি সুখী, সুন্দর ও উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাদের সম্পদের একটি অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় করতে হবে। এর ফলে যে শুধু অসহায় এবং দুস্থ মানবতারই কল্যাণ হবে তা নয়, সমাজে আয় বন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য অনেকখানি হ্রাস পাবে। [94] কোন ব্যক্তির কাছে অর্থ-সম্পদ নেই; যাকাত তাকে অর্থের যোগান দেবে, মৃত্যুর পরে তার পরিবার পরিজন ও সন্তানদের লালন-পালন করবে, বেকার, অক্ষম, বিকলাঙ্গ, রুগ্ন ও বিধবাদের সম্মানজনক জীবন যাপনের নিশ্চয়তা দেবে। এর সহজ সরল সমীকরণ এ যে, আজ এক ব্যক্তি বিত্তবান আছে বিধায় সে অন্যদেরকে সাহায্য করবে। কারণ কাল সে যদি অভাবী হড়ে পড়ে, তখন অন্যরা তাকে সহযোগিতা করবে। মারা গেলে স্ত্রী, সন্তান, সন্ততির অবস্থা কি হবে সে চিন্তারও কোন দরকার নেই। কারণ তার দায়িত্বও যাকাত ব্যবস্থার সফরে টাকা শেষ হয়ে গেলে কি হবে? এ চিন্তা থেকেও মুক্তি দেবে যাকাত। এক্ষেত্রে সমাজের একজন সদস্যের দায়িত্ব হলো সে তার সম্পদের অতিরিক্ত অংশ হতে একট নির্দিষ্ট পরিমাণ যাকাত ফান্ডে দিয়ে রাখবে যাতে এ অর্থ তার দুঃসময়ে রক্ষা করতে পারে। এভাবে যদি কোন ব্যক্তির জীবনে অর্থ চিন্তা না থাকে, ক্ষুধার চিন্তা না থাকে, তার স্ত্রী, সন্তান-সন্তুতির দারিদ্রের ভয় না থাকে, তাহলে সম্পূর্ণরূপে হতাশামুক্ত সমাজ গঠিত হবে। আর যে সমাজে অর্থ চিন্তা থাকে না, সে সমাজে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, আত্মসাৎ, জবরদখল, সুদ-ঘুষসহ সব অনৈতিক কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
২. যাকাত ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূরীকরণে আর্থ-সামাজিক সেতুবন্ধন: প্রকৃতপক্ষে যাকাত ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দুর করে ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ইসলামী নৈতিকতা ও অর্থনৈতিক বিধান মেনে চললে সমাজে কখনও ধনী দরিদ্রের আকাশ চুম্বি পার্থক্য সৃষ্টি হতে পারে না। বর্তমানে শ্রেণী বিভক্ত, বৈষম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থার কারণে এক শ্রেণীর লোক সব সময় অবহেলিত। একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই পারে শ্রেণীহিন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। প্রকৃতপক্ষে যাকাত, সাদকা দান উপঢৌকন, আপ্যায়ন, খাদ্য বিতরন, সালাম বিনিময় এ সকলের মাধ্যমে সম্প্রীতি, ঐক্যবোধ পারস্পারিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এবং কল্যাণ কামনার বুনিয়াদের সকল বৈষম্য দুর হয়ে সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বভিত্তিক কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই ইসলামে সামাজিক বৈষম্য দুর করে সাম্য মৈত্রীর সমাজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যাকাত বিধান এক বিষ্ময়কার ব্যবস্থার নাম।[95]
৩. যাকাত ব্যবস্থায় ধনীদের সম্পদে দরিদ্রের অধিকার: যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ দারিদ্রমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন। যাকাত দুস্থ দারিদ্রের প্রতি ধনীদের দয়া বা অনুকম্পা নয় বরং অধিকার।[96] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন,
﴿ وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ﴾ [الذاريات:19]
এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্থ ও বঞ্চিতদের হক। [97] অন্যত্র বলা হয়েছে ধনীদের যা প্রদান করতে বলা হয়েছে তা বদান্যতা নয়, বরং গরীবদের অধিকার حق অধিকার হিসেবেই তা গরীবদের নিকট ফেরত আসা উচিত। বস্ত্তত গরীবরাই তাদের শ্রম দ্বারা জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি করে।[98]
৪. অভাব, দুর্দশা, ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সমাজ গঠনে যাকাত: যাকাতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার দারিদ্র বিমোচন, যা সামাজিক নিরাপত্তার মূল চালিকা শক্তি। যাকাত বন্টনের ৮টি খাতের মধ্যে ৪টি খাতই (ফকির, মিসকিন, দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্থ) সর্বহারা, অসহায়, অভাবগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিত। এছাড়া নও মুসলিমের খাতটাও বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে এর মধ্যে আসতে পারে।
ওমর (রা.) মিসকিনের খাতটিকেও সম্প্রসারিত করে বেকার বা কর্ম-সংস্থানহীনদেরকেও এর অন্তর্ভুক্ত করেন। অথচ এর ১২০০ বছর পরে উইলিয়াম বেভারিজ এটাকে কল্যাণ নীতির অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়া অষ্টম খাতটিও সামাজিক অভাবে পতিতদের জন্য। এর দ্বারা বুঝা যায় দারিদ্র দূর করাই যাকাতের মূল লক্ষ্য।[99] শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী (রহ) এর কথায় শুনা যায় তারই প্রতিধ্বনি। তিনি বলেন, Zakat has been ordained to serve two purposes; self discipline and provision against social destitution. [100] অর্থাৎ যাকাত দুটি লক্ষ্যে নিবেদিত আত্মশৃঙ্খলা অর্জন ও সামাজিক দারিদ্র নিরসন।
বিংশ শতাব্দির বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সমাজ বিজ্ঞানী ড. হাম্মুদাহ আব্দালাতি বলেন, Zakat mitigates to a minimum the suffering of the ready and poor members of society. It is a most comforting conslation to the less fortunate people. Yet it is a loud appeal to everybody to rool up his sulves and improve his lot. [101]
যাকাত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুঃখ কষ্ট নিবারণ করে। এটি অভাবীদের জন্য স্বস্তি ও ভাগ্যোন্নয়নের শ্রেষ্ঠ উপায়। দুঃস্থ, অভাবগ্রস্থ, মানুষের সমাধানে যাকাতই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। যাকাত অভাবগ্রস্থকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে যাতে সে আর অবভাগ্রস্থ না থাকে। কোন কোন ফকীহ মত প্রকাশ করেছেন যে, যাকাত গ্রহীতাকে এক বছরের প্রয়োজন পুরণ করে দিতে হবে। কেউ কেউ আবার সারা জীবনের প্রয়োজন পুরণ করে দেওয়ার কথাও বলেছেন। উমার (রা) বলেছেন যখন দিবেই তখন স্বচ্ছল বানিয়ে দাও।[102]
দারিদ্র মানুষের পয়লা নম্বরের দুশমন। যে কোন সমাজ ও দেশের জন্য এটা জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজের হতাশা ও বঞ্চনার অনুভুতির সৃষ্টি হয় দারিদ্রের মাধ্যমে। পরিণামে দেখা দেয় মারাত্মক সামাজিক সংঘাত। এ সমস্যা সমাধানের জন্য যাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে ইসলামের সোনালী যুগ থেকে। [103]
মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা দরিদ্র লোকের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করো। তাদের প্রতি সাধ্যমত অনুগ্রহ ও উপকার করো। আখিরাতের পথে তারা তোমাদের জন্য সংগৃহীত ধন এবং প্রধান সম্বল। কিয়ামতের দিন আল্লাহ রাববুল আলামিন দরিদ্রের প্রতি আদেশ করবেন যে, পৃথিবীতে যারা তোমাদের এক লোকমা অন্ন এবং এক ঢোক পানি দান করেছে, এক প্রস্থ বস্ত্র দান করেছে আজ তোমরা তাদের হাত ধরে জান্নাতে চলে যাও।[104] ওমর (রা) বলেছেন, আমার রাজ্যে ফোরাত নদীর তীরে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মারা যায় তাহলে তার জন্য আমি উমরকে আল্লাহর কাছে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িযে জবাবদিহি করতে হবে।
৫. যাকাত সম্পদ পবিত্র করে সামাজিক সম্প্রীতি স্থাপন করে:
মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যে যাকাত দেয় তা তার নিজের জন্য পবিত্রকারী।[105] এ কাজটিকে যাকাত বলার কারণ হলো এভাবে যাকাতদাতার অর্থসম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র ও পরিস্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর দেয়া অর্থ সম্পদ থেকে আল্লাহর বান্দাদের অধিকার বের করে দেয় না, তার অন্তরে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই। সে সাথে তার আত্মা থেকে যায় অপবিত্র। কেননা আল্লাহ যে তার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এ জন্য তার অন্তরে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা নেই। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনের আসছে
﴿ خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم ﴾
‘তাদের সম্পদ হতে যাকাত (সাদাকা) গ্রহণ করবে, যা দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে।’[106]
যাকাত ধনী ব্যক্তিদের সম্পদকে পবিত্র করে। যে পরিমাণ অর্থ সম্পদ যাকাত হিসেবে ধনীদের উপর ফরয হয় তাতে দাতার কোন নৈতিক ও আইনগত অধিকার থাকে না। এ অর্থ সম্পদ গ্রহীতার অধিকার হিসেবেই চিহ্নিত হয়। দাতা যাকাত দিতে ব্যর্থ হলে তার অর্থ এ দাঁড়ায় যে তিনি অন্যের সম্পদ বেআইনী ভোগ দখল করছেন। এ বেআইনী সম্পদকে ভোগ দখল করার কারণে তার সব সম্পদ অপবিত্র হয়ে যায়। যাকাত কেবল দাতার সম্পদকে পবিত্র করে না বরং তার হৃদয়কে সুনির্মল ও প্রসারিত করে। তার মন-মানস আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা চেতনামূলক হয়ে সমাজ কেন্দ্রিক সঞ্জিবিত হয়। সাথে সাথে সম্পদ লিপ্সা ও স্বার্থপরতা ইত্যাদি দূর হয়। যাকাত প্রাপ্তির ফলে গ্রহীতার মন থেকে ধনীদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, শত্রুতা ও ঘৃণার মানসিকতা দূর হয়ে যায়।[107] যার কারণে সমাজের সর্বস্তরে সম্প্রীতি বিরাজ করে সহমর্মিতা ও সহনশীলতা বৃদ্ধি পায়।
৬. যাকাত মজুদদারী বন্ধ করে অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি করে:
যাকাত অর্থ সম্পদ দরিদ্র শ্রেণীর মধ্যে বন্টন করার মাধ্যমে শুধু সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না বরং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। ফলশ্রুতিতে বাজারে কার্যকর চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।[108] গতিশীল হয় অর্থনীতি। আমরা যে সমাজে বসবাস করি তার কল্যাণ ও উন্নতির সাথেই আমাদের কল্যাণ ও উন্নতি জড়িত। এ কথা সত্য যে, আপনি যদি আপনার অর্থ সম্পদ হতে আপনার অপরাপর ভাইদের সাহায্য করেন তবে তা আবর্তিত হয়ে বহু কল্যাণ সাথে নিয়ে আপনার কাছেই ফিরে আসবে। কিন্তু, যদি সংকীর্ন দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে তা নিজের কাছেই জমা করে রাখেন কিংবা কেবল নিজের ব্যক্তি স্বার্থে ব্যয় করেন তবে শেষ পর্যন্ত তা ক্ষয়প্রাপ্ত হতে বাধ্য।
আবার মজুদদারিকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার অর্থ সম্পদ চল্লিশ দিনের বেশী জমা রাখবে সে জাহান্নামী।[109] মজুদদারীর কারণে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয় এবং দ্রব্য মূল্য হুহু করে বেড়ে যায়। ইসলাম মজুদ সম্পদের ওপর যাকাত ধার্য করার কারণে অর্থ সম্পদ মজুদ করাকে নিরুৎসাহিত করেছে।
৭. যাকাত ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা দেয়
প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে কোন ব্যক্তি যদি তার অর্থ সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়, ঋণগ্রস্থ হয়ে যায় তাহলে যাকাত তার ঋণ পরিশোধ করবে, তার হারানো ব্যবসা বা অর্থ সম্পদ ফিরিয়ে আনার জন্য যথাযথ সহযোগিতা করবে। এখানে বলা দরকার যে তারা এমন ঋণগ্রস্থ যে, নিজের অর্থ সম্পদ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করলে আর নিসাব পরিমাণ অর্থ নিজের কাছে থাকে না। এমন ব্যক্তি উপার্জনশীল হোক, ফকীর বলে পরিচিত হোক কিংবা ধনী হোক সর্বাবস্থায় তাকে যাকাত থেকে সাহায্য করা যেতে পারে।[110]
এ ব্যবস্থার কারণ হলো ইসলাম কখনও কোন ব্যক্তির ওপর যুলুম করে না। ব্যক্তি যখন ধনী ছিল তখন তার অর্থ থেকে রাষ্ট্র উপকৃত হয়েছে আর সে যখন দরিদ্র হয়ে গেছে তখন তাকে ইসলাম ফেলে দেবে? কখনো নয় বরং তার হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য যাকাত তার দয়ার ভান্ডারকে উন্মুক্ত করে দেবে।
যাকাত আদায়ের আটটি খাতের মধ্যে ঋণমুক্তি তাইতো একটি অন্যতম খাত। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন:
﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ ﴾[التوبة:60]
‘সাদকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।[111]
৮. অমুসলিমদের ব্যাপারে যাকাতের নীতি
অমুসলিমদের যাকাতের অর্থ লাভ করতে পারবে কিনা, এ ব্যাপারে আইম্মায়ে কিরামগণ বলেছেন, তা হলো যাকাতের অর্থ অমুসলিমদের দেওয়া যাবে না। কারণ হাদীসে বলা হয়েছে .... যাকাত তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে আদায় করা হবে এবং তোমাদের গরীবদের মাঝে বণ্টন করা হবে।[112]
এ ব্যাপারে বক্তব্য হলো যাকাত নয় বরং বাইতুলমাল হতে অমুসলিমদের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। হযরত ওমর (রা.) এক ইয়াহুদীকে ভিক্ষা করতে দেখে বাইতুলমাল হতে তার ভাতার ব্যবস্থা করে দেন।
ইমাম আবু ইউসুফ (রহ) তার কিতাবুল খারাজ এর মধ্যে লিখেছেন, হযরত ওমর ফারুক (রা.)এর শাসনামলে ইরাকের হিরাবাসী খ্রিষ্টানদের সাথে যে চুক্তি হয় তাতে লিখিত ছিল যে বৃদ্ধ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে কিংবা কোন বিপদে পড়েছে কিংবা পূর্বে ধনী ও স্বচ্ছল ছিল এখন দরিদ্র হয়ে পড়েছে আর সমাজের লোকেরা তাকে ভিক্ষা দিতে শুরু করেছে এরূপ ব্যক্তি যতদিন ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক থাকবে ততদিন তার ধার্য জিযিয়া প্রত্যাহার হবে এবং মুসলিমদের বায়তুলমাল হতে তার ও তার পরিবারের জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে।[113] আসলে যাকাত কেবল মুসলিমদের হক, অমুসলিমরা যাকাত পাবে না। তবে অমুসলিমদেরকে সাধারণ দান খয়রাত অবশ্যিই দেয়া যাবে।
৯. শিক্ষা প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে যাকাতের ভূমিকা
জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার জন্য যাকাতের অর্থ দিয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক অনেক কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যাকাতের অর্থ দিয়ে গরীব অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের বই পুস্তক, খোরাক, পোশাক, শিক্ষা উপকরণসহ লিল্লাহবোর্ডিং এ উন্নততর ও গুণগত শিক্ষা প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে গরীব অথচ মেধাবী শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া যাবে।
১০. উৎপাদন বৃদ্ধিতে যাকাতের ভূমিকা
আল্লাহ প্রদত্ত ও নির্দেশিত যাকাত ব্যবস্থায় অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। যাকাত নিঃস্ব ব্যক্তিদের ভিক্ষার হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করে। যে কোন উৎপাদন কাজে শ্রমের সাথে পুজির সংযোজন অনস্বীকার্য। মানুষ তার শ্রমের মাধ্যমে বিষ্ময়কর উন্নয়ন ঘটাতে পারে, কাজে লাগাতে পারে অসংখ্য প্রকৃতির সম্পদকে, পারে মরুভূমিকে উর্বর জমিতে পরিণত করতে। তবে এর জন্য প্রয়োজন যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার যা অর্থনীতির ভাষায় পুঁজি দ্রব্য বলা হয়ে থাকে। পুঁজির অভাবে বহু কর্মক্ষম দারিদ্র জনগোষ্ঠী বেকারত্ব জীবন যাপন করছে। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করে এই সকল দরিদ্র জনশক্তিকে উৎপাদন কর্মকান্ডে ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।[114]
১১. আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের আরো কতিপয় পদক্ষেপ
এদেশের তথা সারা পৃথিবীতে অসংখ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিজ পরিবারের গলগ্রহ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার কারণে পাশ্চাত্য পরিবার প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার কারণে বৃদ্ধ বয়সে সেখানকার নারী পুরুষেরা তাদের সন্তান সন্ততি হতে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সরকারের করুনায় বেঁচে থাকে। অথচ যাকাত দিতে পারে তাদের সুন্দর স্বপ্নীল জীবনের নিরাপত্তা।
· কন্যা দায়গ্রস্থ পিতা অর্থের অভাবে কন্যা বিবাহ দিতে পারে না। এ সমস্ত অক্ষম পিতার কন্যার বিয়েতে যাকাত তার নিজস্ব ফান্ড থেকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে দিয়ে দিবে।
· মুসাফিরদের সাহায্য প্রদান, দরিদ্র শিশুদের পুষ্টি সাহায্য, ইয়াতীম প্রতিপালনে ব্যবস্থা গ্রহণ, শীত বস্ত্ত বিতরণ, স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার, নও-মুসলিম পুর্ণবাসন, ইউনিয়ন মেডিকেল সেন্টার স্থাপন, অসহায় মায়েদের প্রসবকালীন সাহায্য প্রদান, ঋণগ্রস্থ কৃষকদের ঋণ পরিশোধে সহায়তাসহ নানামুখী আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে যাকাত তার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী শান্তির সমাজ কায়েমে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
· এছাড়া দ্বীনী শিক্ষা অর্জনে সহযোগিতা, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বৃত্তি, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ, বেকারদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্হা না করা পর্যন্ত ভাতা প্রদান, দুস্থ পরিবারের জন্য গরু-ছাগলসহ অন্যান্য পশু কিনতে সাহায্য দান, গৃহহীনদের গৃহ তৈরী করে দেওয়া, অসহায় গরীব মানুষের গৃহস্থালী আসবাবপত্র ক্রয় করতে সহযোগিতা করাসহ সব প্রকার উন্নয়ন কর্মসূচীতে যাকাতের সরব উপস্থিতিই সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ, জাতি,ডিজিটাল সমাজ গড়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে।
· যাকাতের মূল উদ্দেশ্যই তো ক) গরীবের প্রয়োজন পুরণ, খ) ধনীরা তাদের কষ্টোপার্জিত সম্পদকে বিলিয়ে দেয়ার চেতনা ও গ) আল্লাহর নৈকট্য লাভ এ টার্গেট পুরণ করার নিমিত্তেই আর্থ-সামাজিক বহুবিধ পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।[115]
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাত ব্যবস্থার সফলতার সম্ভাবনা
যাকাত ব্যবস্থা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখার সামর্থ বিষয়ে বলা যায়, এদেশের মেজরিটি পার্সেন্ট দরিদ্র মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নযনের মাধ্যমে তাদের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানোর মতো অর্থনৈতিক যোগান এদেশের বিভিন্ন খাত থাকে যাকাত পর্যাপ্ত পরিমাণে পাবে কিনা বা পাওয়া সম্ভব কিনা সেটা আলোচনার প্রয়োজন।
ব্যক্তির হাতে মজুদ নগদ অর্থ, গৃহে বা ব্যাংকে রাখা স্বর্ণালংকার ও গোপনে রাখা ডলার/পাউন্ড বাদে শুধু ব্যাংকে সঞ্চিত মেয়াদি আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিটের কথাই উল্লেখ করা যায় যা নূন্যতম এক বছরের জন্য রাখা হয়। বাংলাদেশের সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধিনে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটাসটিকস প্রকাশিত “Statistical yearbook of Bangladesh” এর তথ্যানুসারে ১৯৯৫-৯৬ অর্থ বছরে দেশে মেয়াদী সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল নিম্নরূপ:
ক. তফসীল ব্যাংকসমূহের সঞ্চয় = ৩১,২৩১.১৭ কোটি টাকা
খ. পোষ্টাল সেভিংস সমূহের সঞ্চয় = ০৬,৩২১.৪৭ কোটি টাকা
গ. সকারের সঞ্চয় প্রকল্পে = ৬২,২৮৬.৮০ কোটি টাকা
সর্বমোট = ৯৯,৮৩৯.৪৪ কোটি টাকা
শতকরা ২.৫% যাকাত ধরলে এর যাকাত আসে প্রায় ২,৪৯৬ কোটি টাকা। অনুরূপভাবে এদেশের ছাহিবে নিসাব পরিমাণ ফসলের অধিকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে ওশর আদায় করলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে আরো অন্তত: ১,০০০ কোটি টাকার বেশি। সবকিছু বাদ দিলেও দেখা যাচ্ছে শুধু মেয়াদী আমানত এবং ফসলে ওশর থেকে প্রায় ৩৫০০ কোটি টাকা আসা সম্ভব।[116]
এছাড়া এখনও অনেকগুলো খাত আছে যেখান থেকে যাকাত আসা সম্ভব। আর এই পরিসংখ্যান হলো এখন থেকে প্রায় এক যুগেরও আগের। বর্তমানে তো এই অর্থের পরিমাণ আরো বেশি আসতে বাধ্য।
বাংলাদেশের ১৬ লাখ পরিবার রয়েছে ছিন্নমূল ও ঠিকানাহীন। এছাড়া আরো ৩২ লাখ পরিবার রয়েছে যাদের সামান্য আশ্রয় থাকলেও কোন জমি জমা নেই। এবার যদি প্রতি বছর এদেশের ৫,০৩৫ টি ইউনিয়ন ও পৌর ওয়ার্ড এর মধ্যে ৩৫০০ কোটি টাকা ভাগ করে দেয়া হয় তাহলে প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌর ওয়ার্ড পাবে প্রায় ৬৯ লক্ষ টাকা। এই টাকা হতে ৪০ হাজার করে যদি একেকটি পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে উক্ত পরিবারের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য আর কোন সমস্যা থাকে না। আর প্রতি বছর প্রতিটি পৌর ওয়ার্ড ও ইউনিয়নের ১৫০ জন ব্যক্তি এভাবে টাকা পেয়ে স্বাবলম্বী হতে থাকলে দশ বছরে বাংলাদেশ দারিদ্রমুক্ত হয়ে যাবে।[117]
প্রভুত সম্ভাবনাময় আমাদের এ সুজলা সোনার বাংলাদেশ। এখানে আছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্য, বনজ সম্পদ, পশু সম্পদ, পানি সম্পদ, আর সব চাইতে বড় হলো ১৫ কোটি মানব সম্পদ। কিন্তু, এ সব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার না থাকায় বৈষম্যমূলক বণ্টননীতির কারণে সম্পদের অদক্ষ ব্যবহারের ফলে আমরা আস্তে আস্তে অসীম সম্ভাবনা থাকার পরেও প্রতিনিয়ত দারিদ্রের সাথে লড়াই করছি, হাত পাতছি পাশ্চাত্যের কাছে। আর তারা আমাদেরকে ইচ্ছা মতো যতটুকু না ঋণ দিচ্ছে তার চাইতে বেশি দিচ্ছে উপদেশ। যা আমাদের জাতির অস্তিত্বকে সংকটের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। তারা আমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক ভিক্ষার ঝুলি ‘‘ম্যালথাসের দেশ উন্নয়নের টেস্ট কেস’’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
শুধু তাই নয়, বিশ্ব ব্যাংকের বিশেষজ্ঞরা আমাদেরকে আরো বলছে, Success in solving its (Bangladesh) economics problem would be a convincing evidence that no other country in the world need face extreme poverty.
অথচ এক সময় এদেশ ছিল পৃথিবীর মানুষের স্বপ্নের আবাসভুমি। শোনা যায় শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় ৮মন চাউল পাওয়া যেত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বাংলাদেশ সহযোগিতা করত। আর আজ; যে দেশের মাটিতে সোনা ফলে, যে দেশের গাছে গাছে দেখা যায় নানান রকম ফুল-ফলের সমাহার, যে দেশের নদী, খাল বিলগুলোতে দেখা যায় রূপালী মাছের সমাহার, যে দেশে আছে ৩০ কোটি হাত; সে দেশের সংসদে বৈদেশিক ঋণ ছাড়া বাজেট পেশ হয় না। বন্যার্তদের সহযোগিতা করা যায় না, নদী-খাল-বিল খনন হয় না। সে দেশের মায়েরা মাত্র দু‘মুঠো অন্নের জ্বালায়, এক প্রস্থ কাপড়ের জন্য, একটুখানি মাথা গুঁজার ঠাই এর জন্য অসুস্থ সন্তান-সন্তুতি, বাবা মায়ের স্বামীর চিকিৎসার জন্য নিজেদের সতীত্বকে পর্যন্ত বিক্রি করে, নিজের গর্ভজাত সন্তানকে মাত্র ২০০ টাকায় বিক্রি করে দেয়। অথচ বেশি কিছু নয় শুধুমাত্র যাকাত ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণের মাধ্যমে ১০ বছর বা আরও কম সময়ের এদেশকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষুধা দারিদ্রমুক্ত করা সম্ভব। গৃহহীনের গৃহ, বস্ত্রহীনদের বস্ত্র, ক্ষধার্তকে অন্ন রোগগ্রস্থকে সুস্থতা, ঋণগ্রস্তকে ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা, বৃদ্ধ, অসহায় বনী আদমকে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেওয়ার মাধ্যমে এ দেশকে আর্থ-সামাজিক উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহন করতে সক্ষম শুধু ইসলাম প্রদত্ত যাকাত ব্যবস্থা। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি খুন-রাহজানি, যিনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ-লুণ্ঠন, জোরদখল, টেন্ডারবাজী, আত্মসাৎ, শ্রেণী বৈষম্যসহ সকল প্রকার সমাজ বিধ্বংসী কাজ নিরসনকল্পে সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ-জাতি পৃথিবী গঠনে সক্ষম একমাত্র যাকাত ব্যবস্থাই।
সমাপনী
পরের সুখে হাসব সবাই কাঁদব সবার দুখে,
নিজের খাবার বিলিয়ে দিব অনাহারীর মুখে,
আপনাকে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনি পরে
সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকেই আমরা পরের তরে।
কবিতায় কবি তার মনের যে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন, মহান রাববুল আলামীন যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রায় পনের শত বছর পূর্বে মানব মনে সে অনুভূতি জাগ্রত করার কার্যকরী পথ দেখিয়েছেন।
সমাজ বিজ্ঞানী ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি তাইতো যথার্থই বলেছেন, কুরআনিক শব্দ যাকাত কেবল বদান্যতা দান, সদয়তা, সরকারী কর, ঐচ্ছিক দান ইত্যাদিকেই অন্তর্ভূক্ত করে না, উপরন্ত এটা এসব কল্যাণকামী মন-মানস এবং নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার সুসমন্বিতরূপ।[118]
আর এ চেতনার মূলকথা হলো মানুষ মানুষের দুঃখে এগিয়ে আসবে, অন্যের কষ্টতে নিজের কষ্ট মনে করবে, পাওনাদার দেনাদারকে স্বত:স্ফুর্তভাবে ক্ষমা করে দেবে, দরিদ্র অভাবী প্রতিবেশীর দুঃখ দুর্দশা মোচনে এগিয়ে আসবে। তাহলে প্রত্যেক নাগরিক তার জান-মাল পরিবার পরিজন সন্তান-সন্তুতির নিরাপত্তা ফিরে পাবে, যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর হবে শ্রেণী বৈষম্য, কৌলিন্য ইত্যাদি।
একথা সত্য যে, অধিকাংশ সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হয় দরিদ্রতার কারণে। এ সমস্যার প্রতিবিধান করার জন্য যাকাত ইসলামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। যাকাতের অর্থসম্পদ প্রাপ্তির ফলে দারিদ্রের জীবন যেমন আনন্দ ও নিরাপদ হয় তেমনি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হয়।[119]
ফিরে আসবে আবার সেইদিন, যেদিন হযরত ওমর (রা.) যাকাতের অর্থ দেওয়ার লোক খুঁজে পেতেন না, গহীন রাতে সুন্দরী মহিলা রাস্তা দিয়ে একাকী চললেও সে থাকতো নিরাপদ, প্রত্যেকেই ছিল প্রত্যেকের জীবনের রক্ষাকর্তা, কেউ কারো জন্য মান হানিকর কিছু করা থেকে বিরত থাকত। যে দিনের কথা বলেছেন ড. হাম্মুদাহ আবদালাতি, It is authentically reported that there were times in the history of the Islamic administration when there was no person eligible to receive Zakah. Every subject Muslim, Christian and Jew of the vast Islamic empire had enough to satisfy his needs and the rulers had to deposit the Zakah collections in the public treassury. [120]
ইসলামী সোনালী শাসনকালের ইতিহাসে এমন এক সময় ছিল যখন যাকাত নেওয়ার মতো লোক ছিল না। তখন মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইয়াহুদী সকল নাগরিক তার অভাব মোচনে সক্ষম ছিল। শাসকবর্গ যাকাতের অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা রাখত। এখনও সে পরিবেশ আসতে পারে, যদি যাকাতভিত্তিক অর্থনীতি এবং সুষম বণ্টননীতি নিশ্চিত করা যায়। আল্লাহ তাওফিক দিন। আমীন!