Articles




২. অভাবগ্রস্থ মিসকীন ( المسكين) : মিসকীন বলা হয় যার এমন পরিমাণ সম্পদ আছে যাদ্বারা তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়। মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, মিসকীন সেই যার কোন কিছুই নেই।[55] আবার কেউ কেউ বলেন, মিসকীন সে যার কিছু সম্পদ আছে কিন্তু লজ্জা সম্মানের ভয়ে কারো কাছে হাত পাতে না যারা। তারা জীবন-জীবিকার জন্য প্রানান্তকর প্রচেষ্টা করার পরও প্রয়োজন মত উপার্জন করতে পারেন না। এতকিছুর পরও নিজের কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। হাদীসে মিসকীনের পরিচয়ে বলা হয়েছে: «الذى لا يجد غنى يغنية ولا يفطن له فيصدق عليه ولا يقوم فيسأل الناس» যে ব্যক্তি তার প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ পায় না আর না তাকে বুঝতে বা চিনতে পারা যায়, যার জন্য লোকেরা তাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে। আর না সে লোকদের কাছে কিছু চায়।[56]





আল-ফাতওয়া আল-হিন্দিয়ায় বর্ণিত আছে, মিসকীন এমন ব্যক্তিকে বলা হয়, যার কিছুই নেই, যে মানুষের কাছে হাত পাতে বেড়ায় এবং খোরাক-পোশাকের জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়।[57]





এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ (সা.) এর হাদীস উল্লেখযোগ্য, তিনি বলেন, সেই লোক মিসকীন নয়, যাকে একটি বা দুটি খেজুর অথবা দু-এক লোকমা খাবারের লোভ দ্বারে দ্বারে ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। বরং মিসকীন সে যে কারো কাছে চায় না। এ সম্পর্কে জানতে হলে কুরআনের এ আয়াত পাঠ কর, তারা মানুষকে আগলে ধরে সাহায্য চায় না।[58]





যেসব লোকদের প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ যাকাতের খাত থেকে দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে হযরত ওমর (রা) বলেন إذا أعطيتم فأغنوا যখন দিবেই, তখন ধনী বানিয়ে দাও সচ্ছল বানিয়ে দাও।[59]





উপরে বর্ণিত দুটি খাতকে সর্বাগ্রে উল্লেখ করাতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা দারিদ্র দুর করা ও ফকীর মিসকীনদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানই যাকাত ব্যবস্থার প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। আর যাকাতের আসল উদ্দেশ্যই তাই।





৩. যাকাত বিভাগের কর্মচারী (العامل): যারা যাকাত আদায়কারী, সংরক্ষণকারী, পাহারাদার, লেখক, হিসাব রক্ষক এবং তার বণ্টনকারী এদের সবাইকে যাকাতের ফান্ড থেকে বেতন দিতে হবে। তবে এমন যেন না হয় যে, আমিলদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে যাকাতের কোন অর্থ অবশিষ্ট না থাকে, সে ক্ষেত্রে তাদেরকে আদায়কৃত যাকাতের অর্ধেকের বেশী দেয়া যাবে না।[60] আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যবস্থা এজন্য করেছেন, যেন তারা মালের মালিকদের থেকে অন্য কিছু গ্রহণ না করেন। বরং এটা আসলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের আওতায় পড়ে। রাষ্ট্রই এর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, গঠন ও পরিচালনা করবে। এসব লোককে নিয়োগও দিবে রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের নিযুক্তির শর্তাবলী অন্যতম হচ্ছে:





ক) তাকে মুসলিম হতে হবে;





খ) পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ্য বিবেকসম্পন্ন হতে হবে;





গ) যাকাতের বিধান সম্পর্কে ইলম থাকতে হবে;





ঘ) আমানতদারী ও কাজের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে;





ঙ) স্বাধীন মুসলিম নিয়োগ করতে হবে, ক্রীতদাস নয়।





৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য (مؤ لفة القلوب) : ইসলামের জন্য যাদের মন আকর্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে এমন লোকদের যাকাতের খাত থেকে প্রদান করা। মুয়াল্লাফাতুল কুলুব কারা তা নির্ণয়ে ফকীহ ও আলিমদের মতামত হচ্ছে:





ইমাম যুহরী বলেন: المؤلفة من أسلم من يهودى أو نصرانى وإن كان غنيا যে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ইসলাম কবুল করবে, সে-ই এর মধ্যে গণ্য, সে যদি ধনী হয় তবুও।[61]





ইমাম কুরতুবী বলেন, وهم قوم كانوا في صدر الإسلام ممن يظهر الإسلام يتألفون يدفع سهم من الصدقة اليهم لضعف يقينهم তাদেরকে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব বলা হয়, যারা ইসলামী যুগে প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছে, কিন্তু ইসলামের প্রতি তাদের বিশ্বাস দুর্বল হওয়ায় যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদেরকে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত করা। [62]





মুহাম্মদ আলী সাবুনী বলেন, هم قوم من أشرف العرب أعطاهم رسول الله صلى الله عليه وسلم ليتألف قلوبهم على الإسلام মুয়াল্লাফাতুল কুলুব হলেন, আরবদের উচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তিত্বদের বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের দিকে তাদের হৃদয় জয় করার নিমিত্তে উপঢৌকন প্রদান করতেন।[63]





এ শ্রেণীর লোকদের কয়েকটি পর্যায়ে আছে, যেমন:





ক) এমন লোক যাকে অর্থ-সম্পদ দিলে সে বা তার গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়। যেমন এ রকম অনেক ঘটনা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।





খ) নতুন ইসলাম কবুলকারী লোকেরা, তাদেরকে যাকাতের খাত থেকে প্রদান। যে অন্য ধর্মের লোক সে যখন ইসলাম কবুল করবে, সেই এর মধ্যে গণ্য । সে যদি ধনী হয় তবুও তাকে এ ফান্ড থেকে দেয়া যাবে।





গ) দুর্বল ঈমানের লোকেরা, এমন লোক যাদেরকে অর্থ প্রদান করলে ঈমান দৃঢ় ও শক্তিশালী হবে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদে তাদের থেকে বেশী আনুকুল্য পাওয়া যাবে। মহানবী (সা) এ শ্রেণীর লোকদেরকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমাতের মাল বেশী বেশী প্রদান করতেন। ফলে তারা ইসলামী আদর্শে আরো দৃঢ়তা ও অনুকরণীয় আদর্শে পরিণত হয়েছিলেন।[64]





ঘ) কাফির বা অন্য ধর্মের লোক। যাকে অর্থ উপহার দিলে তারা গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়।[65] এ প্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাফওয়ান ইবন উমায়্যাহকে হুনাইন যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমাতের মাল থেকে প্রদান করেছিলেন। অথচ সে সময়ে তিনি মুশরিক ছিলেন। সাফওয়ান বলেন, মহানবী (সা.) এরূপভাবে আমার প্রতি তার দানের হাত সম্প্রসারিত করতে লাগলেন অবশেষে তিনি আমার কাছে সবচেয়ে ভাল মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেন। পরবর্তীতে তিনি মহানবী (সা.) এর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করেছিলেন বলে জানা যায়।[66]





ঙ) শত্রু পক্ষের প্রতিবন্ধকতা ও শত্রুতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এমন শ্রেণীর লোক যার দুষ্কৃতির ভয় করা হয়, সীমান্তে অমুসলিম শত্রু দেশের আক্রমণ প্রতিরক্ষা ও মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে পারে এমন লোক, তাদেরকে যাকাতের ফান্ড থেকে অর্থ প্রদান করা।[67]





৫. দাসমুক্তির জন্য (الرقاب) : যে ক্রীতদাস তার মালিককে অর্থ প্রদানের বিনিময়ে মুক্তিলাভের জন্য চুক্তিবন্ধ হয়েছে। এখানে এ পর্যায়ে মুসলিম যুদ্ধবন্ধীও এ খাতের আওতায় পড়বে। কাযী ইবনুল আরাবী বলেন, মুসলিম দাসকে যখন মুক্ত করতে যাকাতের খাত থেকে দেয়া যাবে, ঠিক তেমনি মুসলিম বন্দীকে কাফিরদের দাসত্ব শৃঙখলা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম বলে বিবেচিত হবে।[68] এ বিষয়ে বিখ্যাত তাফসীরকারক সাইয়্যেদ রশীদ রিযা বলেন, فى الرقاب বলে যাকাতের যে ব্যয় খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিসমূহকে মুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা যাবে।[69]





৬. ঋণভারাক্রান্তদের জন্য (الغارمون) : এমন ব্যক্তি যে ঋণভারাক্রান্ত অবস্থায় নিপতিত, তাকে যাকাতের ফান্ড থেকে সাহায্য করা। তবে যে কোন অসৎ কাজে বা অপব্যয়ের কারণে ঋণভারাক্রান্ত হয়েছে তাওবা না করা পর্যন্ত যাকাতের ফান্ড দেয়া যাবে না। আবার ঋণভারাক্রান্ত এর পর্যায়ে যেমন জীবিত ব্যক্তি শামিল, তেমনি মৃত্যু ব্যক্তিও এর আওতায় পড়ে। মৃতব্যক্তি যিনি ঋণ রেখে মারা গিয়েছেন। ইমাম কুরতুবী (রা.) তাই বলেছেন।[70]





ইবনুল হুমাম বলেছেন, গারিমুন হচ্ছে সে সমস্ত লোক যাদের উপর ঋণের বোঝা চেপে আছে অথবা লোকদের নিকট পাওনা আছে কিন্তু তারা তা আদায় করছে না, তাকে গারিমুন বলার প্রচলন আছে। [71]





আল্লাহর পথে: আল্লাহর পথ বলতে আকীদা বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয় যে পথ, তাই আল্লামা রশীদ আহমদ বলেছেন, فى سبيل الله ইসলামী শাসন পুন:প্রতিষ্ঠার চেষ্টা প্রচেষ্টার কাজই ফী সাবিলিল্লাহর খাত। অর্থাৎ ইসলামী জীবন বিধান পুন:প্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালানো, যেখানে ইসলামী আইন বিধান বাস্তবায়িত হবে, মুসলিম সভ্যতার পুনরাভ্যুদয়, মুসিলম উম্মতের পুনজার্গরণ, ইসলামী আকীদা বিশ্বাস, আচার-আচরণ, শরীয়াত, চরিত্র ইত্যাদি সবকিছু পুরামাত্রায় কার্যকর হবে।[72]





ইবনুল আসীর বলেন, فى سبيل الله এর অর্থ এমন কার্যক্রমকে বুঝায় যা খালিস নিয়্যাত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে, তা ফরয নফল ও বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগীকে বুঝায়।[73]





জালালুদ্দিন সুয়ুতী বলেন, فى سبيل الله এর অর্থ যারা জিহাদের কাছে নিয়োজিত আছে।[74]





সলফে সালেহীনদের মতে ফী সাবিলিল্লাহ আল্লাহর দ্বীনের প্রচার, প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী দেশষমূহের প্রতিরক্ষার জন্য পরিচালিত প্রচেষ্টা সাধনা ও সামগ্রিক তৎপরতাকে বুঝায়। এখানে فى سبيل الله অর্থ স্বশস্ত্র সংগ্রামকে বুঝানো হয়েছে।[75]





ইসলাম বিরোধী শক্তি তাদের চেষ্টা সাধনা ও অর্থ শক্তি দ্বারা লোকদেরকে আল্লাহর পথে চলার বাধাদানে নিয়োজিত হলে বিত্তশালী মুসলিমদের কর্তব্য হবে তাদের শক্তি, সামর্থ ও অর্থ দ্বারা কুফরী শক্তি প্রতিরোধকারীদের সাহায্য করা। তাই এরূপ সাহায্য করাই ফরয যাকাতের একটি অংশ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।[76]





মূলত আল্লাহর পথের পর্যায় ও স্তর অনেক। যেসব কাজের নির্দেশনা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তা সবই এর আওতায় পড়বে। ওলামায়ে কিরামদের বিশ্লেষণে জিহাদের কয়েকটি পর্যায়ের অন্যতম হচ্ছে:





এক. দাওয়াত ইলাল্লাহ, আল্লাহর পথে আপামর মানুষকে দাওয়াত দেয়া। যুগে যুগে সকল নবী রাসূলগণ তাদের সমসাময়িক জনগণকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন। তারা বলেছেন





﴿ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُ ﴾ [الأعراف:59]





অর্থ হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতিত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই।[77] দাওয়াত ইলাল্লাহর কর্মকৌশল, দাওয়াত প্রদানের কাঙিখত মান এবং পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:





﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ﴾ [النحل:125]





‌তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহবান কর হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়। তোমার প্রতিপালক তার পথ ছেড়ে কে বিপদগামী হয়, সে সম্বন্ধে সবিশেষ অবহিত এবং সৎ পথে আছে তাও তিনি সবিশেষ অবহিত।[78]





দুই. নিজেকে সত্যের সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা। আল্লাহ বলেন: ‘‘কথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তির চেয়ে যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে আমি তো অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত।[79]





তিন. জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ: আল্লাহর বাণী, ﴿وَجَٰهِدُواْ فِي ٱللَّهِ حَقَّ جِهَادِهِۦۚ ﴾ [الحج:78] আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ কর আল্লাহর পথে যেভাবে জিহাদ করা উচিত।[80]





৮. মুসাফিরদের জন্য: এমন যার নিজ আবাসস্থলে সম্পদ আছে, কিন্তু সফরে সে বিপদগ্রস্থ ও নি:স্ব তাকে যাকাতের তহবিল থেকে সাহায্য করা। তবে সে সফর পাপের কাজের বা অনুরূপ পর্যায়ের কোন সফর হওয়া যাবে না।





আল্লামা তাবারী মুজাহিদ সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, যাকাতের সম্পদ ধনী হওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের নি:স্ব পথিকের একটি হক রয়েছে। যদি সে তার নিজের ধন-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।[81]





মুসাফিরদেরকে খোরাক-পোশাকের ব্যয় এবং লক্ষ্যস্থল পর্যন্ত পৌঁছার জন্য যা প্রয়োজন অথবা তার ধন-মাল পথিমধ্যে কোথাও থাকলে তা যেখানে রয়েছে, সে পর্যন্ত পৌঁছার খরচ যাকাতের ফান্ড থেকে দিতে হবে।[82]





কতুটুকু পরিমাণ দিতে হবে এ ব্যাপারে দুটি মত পাওয়া যায়। এক: যাতায়াত ও অবস্থানের প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া অতিরিক্ত দেয়া যাবে না। দুই. প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্রহণ করা তার বৈধ হবে।[83]





যাকাত না দেয়ার কঠোর শাস্তি





যাকাত দিবে না কিংবা অস্বীকারকারীদের কঠোর ও ভয়াবহ শাস্তির ভয় প্রদর্শন করা বর্ণিত হয়েছে হাদীসে। এখানে ভয় প্রদর্শনের মূলে চেতনাহীন মন মানসে চেতনা সৃষ্টি এবং লোভী ও স্বার্থপর মানুষকে দানশীল বানানোর উদ্দেশ্যে নিহিত আছে। মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (স.) যাকাত দানে উৎসাহ প্রদান ও ভয় প্রদর্শনের মাধ্যমে লোকদেরকে কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।





পরকালীন শাস্তি





যাকাত প্রদান না করলে তার ভয়াবহ শাস্তি বর্ণনায় কুরআনের ভাষ্য:





﴿وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤ يَوۡمَ يُحۡمَىٰ عَلَيۡهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكۡوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمۡ وَجُنُوبُهُمۡ وَظُهُورُهُمۡۖ هَٰذَا مَا كَنَزۡتُمۡ لِأَنفُسِكُمۡ فَذُوقُواْ مَا كُنتُمۡ تَكۡنِزُونَ﴾ [التوبة:34-35]





‘‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভুত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যে দিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে, সেদিন বলা হবে এটাই তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জীভুত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভুত করেছিলে তা আস্বাদন কর।[84]





﴿ٱلَّذِينَ يَبۡخَلُونَ وَيَأۡمُرُونَ ٱلنَّاسَ بِٱلۡبُخۡلِ وَيَكۡتُمُونَ مَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦۗ وَأَعۡتَدۡنَا لِلۡكَٰفِرِينَ عَذَابٗا مُّهِينٗا ﴾[النساء:37]





‘‘যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহর নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে যা দিয়েছেন তা গোপন করে, আর আমি আখিরাতে কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি।’’[85]





এ ব্যাপারে শাস্তির ভয়াবহতা হাদীসে বর্ণিত আছে:





عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: "مَنْ آتَاهُ اللَّهُ مَالًا، فَلَمْ يُؤَدِّ زَكَاتَهُ مُثِّلَ لَهُ مَالُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ شُجَاعًا أَقْرَعَ لَهُ زَبِيبَتَانِ يُطَوَّقُهُ يَوْمَ القِيَامَةِ، ثُمَّ يَأْخُذُ بِلِهْزِمَتَيْهِ - يَعْنِي بِشِدْقَيْهِ - ثُمَّ يَقُولُ أَنَا مَالُكَ أَنَا كَنْزُكَ، ثُمَّ تَلاَ: (لَا يَحْسِبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ) " الآيَةَ





আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ যাকে ধন-মাল দিয়েছেন, সে যদি তার যাকাত আদায় না করে, তা হলে কিয়ামতের দিন তা একটি বিশধর অজগরের যার দুচোখের উপর দুটো কালো চি‎হ্ন রয়েছে রূপ ধারণ করবে। বলবে, আমিই তোমার ধন-মাল, আমিই তোমার সঞ্চয়। অত:পর রাসূল (সা.) এর আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন, আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে, তাদের জন্য এটা মঙ্গল, এটা যেন তারা মনে না করে। না এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যাতে তারা কৃপণতা করবে কিয়ামতের দিন সেটাই তাদের গলায় বেড়ী হবে। আসমান ও জমিনের স্বত্বাধিকারী একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত আছেন।[86],[87]





সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে:





عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ، أَنَّ أَبَا صَالِحٍ ذَكْوَانَ، أَخْبَرَهُ أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا مِنْ صَاحِبِ ذَهَبٍ وَلَا فِضَّةٍ، لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا، إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، صُفِّحَتْ لَهُ صَفَائِحُ مِنْ نَارٍ، فَأُحْمِيَ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ، فَيُكْوَى بِهَا جَنْبُهُ وَجَبِينُهُ وَظَهْرُهُ، كُلَّمَا بَرَدَتْ أُعِيدَتْ لَهُ، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ [ص:681] سَنَةٍ، حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ، فَيَرَى سَبِيلَهُ، إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِمَّا إِلَى النَّار » قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، فَالْإِبِلُ؟ قَالَ: «وَلَا صَاحِبُ إِبِلٍ لَا يُؤَدِّي مِنْهَا حَقَّهَا، وَمِنْ حَقِّهَا حَلَبُهَا يَوْمَ وِرْدِهَا، إِلَّا إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ، بُطِحَ لَهَا بِقَاعٍ قَرْقَرٍ، أَوْفَرَ مَا كَانَتْ، لَا يَفْقِدُ مِنْهَا فَصِيلًا وَاحِدًا، تَطَؤُهُ بِأَخْفَافِهَا وَتَعَضُّهُ بِأَفْوَاهِهَا، كُلَّمَا مَرَّ عَلَيْهِ أُولَاهَا رُدَّ عَلَيْهِ أُخْرَاهَا، فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ، حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ الْعِبَادِ، فَيَرَى سَبِيلَهُ إِمَّا إِلَى الْجَنَّةِ، وَإِمَّا إِلَى النَّارِ»





আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, স্বর্ণ ও রৌপ্যের যে মালিকই তার উপর ধার্য হক আদায় করে দেবে না, কিয়ামতের দিন সেগুলোকে তার পার্শ্বে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হবে। পরে তার উপর জাহান্নামের আগুনে তাপ দেয়া হবে, সে উত্তপ্ত বস্ত্ত দ্বারা তার পার্শ্ব, ললাট ও পৃষ্ঠে দাগ দেয়া হবে; সে দিন যার সময়কাল ৫০ হাজার বছরের সমান দীর্ঘ। শেষ পর্যন্ত লোকদের মাঝে চূড়ান্ত ফায়সালা করা হবে। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে। হয় জান্নাতের দিকে নতুবা জাহান্নামের দিকে। গরু বা ছাগলের মালিকও যদি তার উপর ধার্য হক আদায় না করে, তাহলে কিয়ামতের দিন তা নিয়ে আসা হবে, সেগুলো নিজেদের দু‘ভাবে বিভক্ত পায়ের খুর দিয়ে মালিককে লাথি মারবে এবং তার শিং দ্বারা তাকে গুঁতোবে যখনই তার উপর অপরটি এসে যাবে, প্রথমটি প্রত্যাহার করা হবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তার বান্দাদের মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করবেন, যে দিনের সময়কাল তোমাদের গণনামতে ৫০ হাজার বছরের সমান। পরে তাকে তার পথ দেখানো হবে, হয় জান্নাতের দিকে নতুবা জাহান্নামের দিকে।[88]





যাকাত না দেয়ার বৈষয়িক শাস্তি





আল্লহার নির্দেশিত এ হুকুম যাকাত না দিলে বৈষয়িক শাস্তির বিষয় বর্ণিত হয়েছে:





মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, যে লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাদের কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করে দিবেন।[89]





অপর একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, ওদের ধন-মালের যাকাত দিতে অস্বীকার করে আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ করিয়েছে মাত্র। কেবল জন্তু জানোয়ারের কারণেই তাদের বৃষ্টিপাত হয়।[90]





শরীয়াতসম্মত শাস্তি





যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের জন্য শরীয়াতসম্মত শাস্তির কথাও হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রশাসক এ শাস্তি কার্যকর করবেন। রাসূল (সা.) বলেছেন-যে লোক সাওয়াব পাওয়ার আশায় যাকাত দিবে সে তার সাওয়াব অবশ্যই পাবে। আর যে তা দিতে নারাজ হবে, আমি তা অবশ্যই গ্রহণ করব তার ধন-মালের অংশ থেকে। তা হচ্ছে আমাদের রব-এর বহু সুনিদিষ্ট সিদ্ধান্তের অন্যতম। মুহাম্মদ (সা) এর বংশধরের লোকদের পক্ষে তা থেকে কিছু গ্রহণ করা হালাল নয়।[91] আবু বকর রাষ্ট্রপ্রধান অবস্থায় যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:





عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: لَمَّا تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَاسْتُخْلِفَ أَبُو بَكْرٍ بَعْدَهُ، وَكَفَرَ مَنْ كَفَرَ مِنَ العَرَبِ، قَالَ عُمَرُ لِأَبِي بَكْرٍ: كَيْفَ تُقَاتِلُ النَّاسَ؟ وَقَدْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: « أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، فَمَنْ قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ، إِلَّا بِحَقِّهِ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ »، فَقَالَ: وَاللَّهِ لَأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ، فَإِنَّ الزَّكَاةَ حَقُّ المَالِ، وَاللَّهِ لَوْ مَنَعُونِي عِقَالًا كَانُوا يُؤَدُّونَهُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَقَاتَلْتُهُمْ عَلَى مَنْعِهِ، فَقَالَ عُمَرُ: «فَوَاللَّهِ مَا هُوَ إِلَّا أَنْ رَأَيْتُ اللَّهَ قَدْ شَرَحَ صَدْرَ أَبِي بَكْرٍ لِلْقِتَالِ، فَعَرَفْتُ أَنَّهُ الحَقُّ»





রাসূল (সা.) বলেন, আমি লোকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি, যতক্ষণ না তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু-এর সাক্ষ্য দিবে। তারা যদি তা করে তাহলে তাদের রক্ত তথা জান ও মাল আমার নিকট নিরাপত্তা পেয়ে গেল। তবে ইসলামের অধিকার আদায়ের জন্য কিছু করার প্রয়োজন হলে তা তাদের উপর বর্তাবে। হযরত আবু বকর(রা) যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে বলেন, অবশ্যই আমি যুদ্ধ- লড়াই করবো যদি কেউ সালাত ও যাকাতের ব্যাপারে পার্থক্য সৃষ্টি করে। কেননা যাকাত মালের হক। আল্লাহর কসম, যদি কেউ একটি ছাগল ছানা দিতে অস্বীকৃতি জানায় যা তারা রাসূল (সা.) এর যামানায় দিত, তাহলেও আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ লড়াই করবো।[92]





 



Recent Posts

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 3

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 2

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 1