Articles

আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যাকাতের ভূমিকা 1





মোঃ এনামুল হক





ভূমিকা





ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থায় সালাতের গুরুত্ব যেমন অপরিহার্য তেমনি যাকাতের গুরুত্বও অনস্বীকার্য। যাকাতভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুখী সমৃদ্ধিশালী প্রগতিশীল কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। আল্লাহর বাণী—





﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰة﴾ [البقرة:43]





তোমরা সালাত কায়েম কর যাকাত দাও।[1] উনিশ শতকে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণার সূচনা হলেও মূলত বিশ শতকে পশ্চাত্যে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ কল্যাণ নীতির উদ্ভব ঘটে।[2] একবিংশ শতকে কল্যাণ রাষ্ট্র বলতে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা উন্নয়নকেই বুঝায়। অধ্যাপক বেনহাম (Benham) এ কথাই বলেন। তার মতে ‘‘ যে রাষ্ট্র ব্যাপকভাবে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাই কল্যাণ রাষ্ট্র।’’[3] আর সামাজিক নিরপত্তা বলতে রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নূন্যতম অর্থনৈতিক প্রয়োজন পুরণের নিশ্চয়তাকেই বুঝায়। জি.ডি. এইস. কোল (G.D.H. Cole) এর মতে, ‘‘কল্যাণ রাষ্ট্র এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে নাগরিকের একটি সাধারণ জীবন যাত্রার মানের নিশ্চয়তা থাকে।’’[4]





পুঁজিবাদী সমাজে সরকারীভাবে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান নেই বলেই সেখানে জনগণকে মুষ্টিমেয় ধনকুবের বা পুঁজিপতিদের কৃপার দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে থাকতে হয়। এখানে ডলার পুজায় নিবেদিত সাইলক পুঁজিপতিরা লৌকিকতার খাতিরে কিছু দান করেন, মহানুভবতা বা সংবেদনশীলতার জন্য নয়; মেথ্য আরনল্ড শোষণ ও বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদি সমাজ চিত্রকে তুলে ধরেন এভাবে ‘‘আমাদের অসাম্য উচ্চশ্রেণীকে বৈষয়িক করে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে ইতর, আর নিম্ন শ্রেণীকে বর্বর করে তোলে।’’[5] পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ-নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য শ্রমিক, জনতা সমাজতন্ত্রের ছায়ায় আশ্রয় নেয়। কিন্তু এখানেও অবস্থা তথৈবচ। সমাজতন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্বের যাতাকলে শ্রমিক জনগণ নিপীড়িত। There is a little room for even a genuine philanthropic deed when all human beings are turned into robots employed and paid by the vast sprowling fumbling leviathan of the soviets.[6] ‘‘সেখানে সত্যিকার জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ডের সুযোগ নেই বললেই চলে। যেখানে সকল মানুষ রোবট কর্মচারীতে পরিণত হয় এবং শক্তিশালী সোভিয়েত এর এক বিরাট সংখ্যক আনাড়ীদের দ্বারা বেতন প্রদত্ত হয়।’’ সমাজতন্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ হতে পারে এমন- সমাজতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে সামাজিক অন্যায় অবিচারের এক অতি নিকৃষ্ট রূপ। যার দৃষ্টান্ত কোন নমরুদ, ফিরাউন ও চেংগিস খানের শাসনকালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক বা একাধিক ব্যক্তি বসে একটি সামাজিক দর্শন রচনা করলো। তারপর সরকারের সীমাহীন এখতিয়ারের বদৌলতে এ দর্শনকে অন্যায়ভাবে একটি দেশে বসবাসকারী কোটি কোটি মানুষের ওপর বলপূর্বক চাপিয়ে দিল। মানুষের ধন-সম্পদ কেড়ে নেয়া হলো। জমি-জমা, ক্ষেত-খামার অযাচিতভাবে হস্তগত করা হলো। কল-কারখানা রাষ্ট্রয়াত্ত করা হলো। সমগ্র দেশকে এমন এক জেলখানায় পরিণত করা হলো যে সমালোচনা, বিচার প্রার্থনা, অভিযোগ, মামলা দায়ের ইত্যাদি কাজ করা এবং বিচার বিভাগীয় সুবিচারের সকল পথ বন্ধ হয়ে গেল। দেশে কোন দল থাকবে না, কোন সংগঠন থাকবে না, যেখানে থেকে মানুষ তাদের মুখ খুলতে পারে; কোন প্রেস-মিডিয়া থাকবে না যার সাহায্যে মানুষ তাদের অভিমত প্রকাশ করতে পারে; কোন বিচারালয় থাকবে না, যার দুয়ারে সুবিচারের জন্য মানুষ ধর্ণা দিতে পারে।





এখানে প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রটি এই যে, তা ব্যক্তিকে সীমাতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়ে পরিবার, গোত্র, সমাজ ও জাতির ওপর জুলম নিষ্পেষণ করার পূর্ণ লাইসেন্স দিয়েছিল এবং সামষ্টিক কল্যাণের জন্য সমাজের কাজ করার শক্তি শিথিল করে দিয়েছিল। অপরদিকে দ্বিতীয় ব্যবস্থা তথা সমজতন্ত্রে ত্রুটি এই ছিল যে, রাষ্ট্রকে সীমাহীন ক্ষমতা দান করে ব্যক্তি, পরিবার, গোত্র ও সমাজের স্বাধীনতা প্রায় একেবারেই খতম করে দিয়েছে। তারপর ব্যক্তিবর্গ থেকে সমষ্টির কাজ নেওয়ার জন্য রাষ্ট্রকে এতো বেশি কর্তৃত্ব দান করে যে, ব্যক্তি ব্যক্তিসত্তার পরিবর্তে একটি মেশিনের প্রাণহীন যন্ত্রাংশের রূপ ধারণ করে।[7]





পুঁজিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি যখন ব্যর্থ, তখন পুঁজিবাদের সংস্কারিতরূপ ‘‘কল্যাণরাষ্ট্রে’’ সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও শেষ পর্যন্ত আংশিক ছাড়া সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।[8] কল্যাণ রাষ্ট্রের ইংরেজ প্রবক্তা উইলিয়াম বেভারিজ প্রদত্ত সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার সমালোচনায় তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেন, ‘‘আমি মিথ্যা আশ্বাস এবং অবান্তর কল্পনাশ্রয়ী দর্শনের মাধ্যমে জনগণের সাথে প্রতারণা করতে চাই না।’’[9]





এ কথা ধ্রূব সত্য যে, পুঁজিবাদ ও কল্যাণ রাষ্ট্র একই আয়নার দুটো পিঠ। ওদিকে পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র এবং কল্যাণ রাষ্ট্র উদ্দেশ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে একই বিন্দু থেকে উৎসারিত। এই তিনটি মতবাদ কেবল বৈষয়িক বা বস্তগত তথা প্রযুক্তিনির্ভর উন্নতি সমৃদ্ধি চায়, আত্মিক, নৈতিক ও মানবিক উৎকর্ষ সেখানে উপেক্ষিত। অথচ আত্মিক পরিশুদ্ধি এবং মানবিক-সামাজিক মূল্যবোধের উপস্থিতি ছাড়া বস্ত্তগত উন্নতি ফলপ্রসু ও কার্যকর হয় না।[10]





আলড়ুয়াস হ্যক্সলি তাইতো বলেন- ‘এটি এমন এক স্পষ্ট পশ্চাদগামী পৃথিবী যেখানে কেবল প্রযুক্তির সদর্প বিচরণ চলে। প্রযুক্তিগত প্রগতি ধ্রূব, কিন্তু বদান্যতার প্রসারণ ছাড়া প্রযুক্তিগত প্রগতি মূল্যহীন। বরং মূল্যহীনতার চেয়েও ক্ষতিকর।’[11]





মানুষ একাধারে আত্মিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক, জৈবিক ইত্যাদি উপাদানের সমন্বয়ে সমন্বিত জীব। মানব এককে আত্মা, মন, নৈতিক চেতনা, যৌন তাড়না, বৈষয়িক বা অর্থনৈতিক লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, পরার্থপরতা, পরশ্রীকাতরতা, সংবেদনশীলতা, সহমর্মিতা, দয়া-মায়া, স্নেহ-ভালবাসা, হিংসা-বিদ্বেষ, বিনয়-অহমিকা, আবেগ-উচ্ছাস, ক্রোধ-উত্তেজনা, রাগ-অনুরাগ ইত্যাদি বিদ্যমান। এসব উপাদানের মধ্যে আত্মারই অবস্থান শীর্ষ। আত্মার অনুপস্থিতিতে মানব অবয়ব লাশ বা পদার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। পরিশোধিত ও উৎকর্ষিত আত্মা যথার্থ মানবিক অভিপ্রায়কে জাগ্রত করে। আর জাগ্রত মানবিক অভিপ্রায় যখন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিব্যাপ্ত হবে তখনই সামাজিক কল্যাণ নিরাপত্তা সম্বলিত সুষম ও ভারসাম্যমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ জীবন দর্শন এবং এর সামাজিক রাষ্ট্রিক বলয়ে আত্মিক দিক নিবাসিত। ধর্মাশ্রয়ী জীবন দর্শনেই আত্মিক উৎকর্ষ মন্ডিত সুষম সমাজ বিন্যাস সম্ভব।[12]





আগামী ৫০ বছরের উন্নতি সমৃদ্ধি কোন ধরনের গবেষণার ওপর নির্ভরশীল প্রশ্নের উত্তরে ড. চালর্স ষ্টেইনমেজ ( Dr. Charles Stinmetz) বলেন, I think that the greatest discoveries will be made along spiritual times. Some day People will learn that material things do not bring happiness and are of little use in making men and women creative and powerful. Then the Scientist of the world will turn their laboratories over to the study of god and the spiritual forces which as yet have been hardly scratched. When that they comes, the world will see more advancement in one generation in has the last four. [13] অর্থাৎ ‘‘আমি মনে করি, সর্বশ্রেষ্ঠ আবিস্কার হবে আধ্যাত্মিকতার পথ ধরে। একদিন মানুষ বুঝতে পারবে যে, বস্তগত জিনিস মানুষের সুখ-শান্তি আনে না এবং এগুলো নর-নারীকে সৃজনশীল ও ক্ষমতাশালী করতে খুব কমই কাজে আসে। তখন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণাগারগুলোকে আল্লাহ, প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক চেতনার দিকে ঘুরিয়ে নেবে যার সম্পর্কে বর্তমানে খুব কমই আলোচিত হয়। তখন বিশ্ব এক প্রজন্মে অনেক সমৃদ্ধি দেখবে যা বিগত চার প্রজন্ম দেখেনি।





আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রধান প্রতিবন্ধক হলো দারিদ্রতা। ক্রমবর্ধমান দারিদ্রতা বর্তমান বিশ্বের উন্নয়নকারী দেশসমূহের সামনে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় দারিদ্র বিমোচন গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে স্থান পেয়েছে বহু পূর্বেই। বিভিন্ন দেশের সরকারের পরিকল্পিত প্রয়াসের ফলে দারিদ্রের প্রকটতা কিছুটা হ্রাস পেলেও এর ব্যাপকতা ও গভীরতা মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। সর্বোচ্ছ বিশ্ব সংস্থা (জাতিসংঘ) কর্তৃক ঘোষিত ‘Millennium development Goals’ এর অন্যতম প্রধান অঙ্গ দারিদ্র বিমোচন।[14]





এতো কিছুর পরেও দারিদ্র কমে না বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে, মাত্র কয়টা টাকার জন্য নারী তার সতীত্ব পর্যন্ত বিকিয়ে দিচ্ছে। ‘মা’ তার সন্তানকে ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বিক্রি করে দিচ্ছে। ডাষ্টবিনের ময়লা পচা-বাসি খাবার খাওয়ার জন্য কুকুর মানুষ এক সাথে লড়াই করছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতিদিন দারিদ্রতার কারণে মানুষ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। পৃথিবীর লাখ লাখ বনী আদম তপ্ত মরুভূমিতে খাদ্যহীন, আশ্রয়হীনভাবে উদ্ধাস্ত অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, কাশ্মির, ইরাক, ভারত, সুদান, কঙ্গো তার জ্বলন্ত প্রমাণ।





এতো গেল এশিয়া আর আফ্রিকার কথা। স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আয়হীন পরিবার আছে, যাদের বাৎসরিক আয় ৮/১০ হাজার ডলারের বেশি নয়। ১৯৮৭ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গরীব লোকের সংখ্য ছিল ৩২.৫ মিলিয়ন যা সেখানকার মোট জনসংখ্যা ১৩.৫% । এর সংখ্যা আরো বেশি হবে কারণ গৃহহীন পরিবার বাদেই উক্ত পরিসংখ্যান। ১৯৯৫ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর BAAS ও USIS -এর উদ্যোগে আয়োজিত কর্মশালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কিবরিয়াউল খালেক তার ‘আমেরিকায় দারিদ্র্য’ নামক প্রবন্ধ উক্ত তথ্য প্রদান করেন।





সম্প্রতি ইউএনডিপি ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট বিশ্বে প্রতিটি ১ ডলারের নীচে আয় এমন দরিদ্র লোকের সংখ্যা বলা হয়েছে ১২৫ কোটি। যার মধ্যে শুধু এশিয়াতেই ৯৫ কোটি এবং বাংলাদেশে এর পরিমাণ ৫ কোটি।[15]





সামাজিক ব্যাধি নামক দারিদ্রের নির্মম নিষ্ঠুর যাতনায় ক্ষুধার্ত মানুষ যে কোন অপরাধ করতে পারে। দারিদ্রপূর্ণ সমাজে মানবতাবোধ লোপ পায়। মানুষ যে কোন নিষ্ঠুর আচরণে জড়িয়ে পড়ে দারিদ্র্যের কারণে মানুষ আক্বিদা-বিশ্বাস মোটকথা ধর্মকেও বিসর্জন দিতে পারে। আমাদের দেশসহ পৃথিবীর বহু দেশের অসংখ্য মানুষ শুধু দারিদ্র্যের কারণে এনজিওদের প্রলোভনে পড়ে ধর্ম ত্যাগ করছে। মহানবী (সা.) এর ব্যাপারে বলেছেন ‘এটি অত্যন্ত সংগত কথা যে দারিদ্র মানুষকে কুফরীর দিকে নিয়ে যায়।[16] শুধু এ কারণে মহানবী (স.) দারিদ্রতা ও কুফরী হতে একসাথে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট কুফরী ও দারিদ্র্যতা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’’[17]





বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, দার্শনিক আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী এ ব্যাপারে বলেন, ‘‘ইসলাম ধনাঢ্যতাকে আল্লাহর নি’আমাত মনে করে যার শোকর আদায় করা উচিত। আর দারিদ্রকে মনে করে মুছিবাত যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা আবশ্যক।’’[18] দারিদ্র্য মানুষের সুষম চিন্তা শক্তিকে বিলুপ্ত করে দেয়। ইমাম আবু হানিফা (রহ) এ প্রসঙ্গে বলেন ‘যার বাড়িতে আটা নেই তার নিকট কোন পরামর্শ নিতে যেয়ো না। কারণ তার চিন্তা বিক্ষুব্ধ হতে বাধ্য। একবার ইমাম আবু হানিফা (রহ) এর এক শিষ্য মুহাম্মদ ইবন হাসানকে তার পরিচারিকা এসে বললো যে, তার ঘরের আটা শেষ হয়ে গেছে। তখন তিনি বললেন ‘আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন এ খবরে আমার মাথা থেকে ৪০টি ফিকহি মাসআলা উধাও হয়ে গিয়েছে।’





আশ্চর্যের বিষয় হলো দারিদ্রের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও বিশ্বের মোট সম্পদের পরিমাণ মোট জনসংখ্যার প্রয়োজনের তুলনায় কিন্তু কম নয়, বরং অনেক বেশি। আসলে মূল সমস্যা হলো বন্টন ব্যবস্থায়। যে সমস্যার সমাধানে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার কার্যকারিতা ঐতিহাসিক প্রমাণিত।[19]





যাকাতভিত্তিক সমাজে কারো পক্ষে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার কোন সুযোগ নেই। আবার কারো পক্ষে গরীব থাকার সম্ভাবনাও নেই। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান। আর ইসলামের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অংগ হলো যাকাত। আল্লাহ রাববুল আলামীন কুরআনে বলেছেন





﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ﴾[البقرة:43]





তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত দাও।’’[20] আল্লাহ আরো বলেন-





﴿خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم ﴾[التوبة:103]





তাদের সম্পদ হতে যাকাত (সাদাকা) গ্রহণ করবে, যা দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে। [21] হযরত আবু বকর (রা) বলেছেন, যে যাকাত প্রদানে ছলচাতুরী করবে, তার কাছ থেকে আমি যাকাত এবং সম্পদের অর্ধেক আদায় করব।’’[22]





আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্রের ভাষায় যাকাতকে আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিধান বলা যায়। বলতে দ্বিধা নেই, যখন পাশ্চাত্যে বিশ্ব শতকের মাঝামাঝি সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, তখন সাত শতকে ইসলাম সামাজিক নিরাপত্তা বিধান তথা সমাজকল্যাণ নীতির ফলপ্রসু প্রয়োগ করে যথার্থ কল্যাণ রাষ্ট্রের মডেল বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছে, যখন এ পৃথিবীতে সামাজিক নিরাপত্তা পরিকল্পনার নাম নিশানাও ছিল না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে ইসলাম নির্দেশিত যাকাত ব্যবস্থা অনিবার্য ফলগুধারায় এ বাস্তবতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।





যদি বৃটেনের রাণী এলিজাবেথের আমলের ‘‘ poor law-1601”- কে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের দৃষ্টান্ত হিসেবেও ধরা হয় তাহলে তারও ১ হাজার বছর পূর্বে আর যদি ১৮৮৩ সালে জামার্নীতে ‘বিসমার্ক’ সম্মেলনে শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য গৃহীত ‘‘ Accisdesital Insurance Act” কে দৃষ্টান্ত হিসেবে নেয়া হয় তাহলে তারও ১২৫০ বছর পূর্বে ইসলাম যাকাত নামক সামাজিক নিরাপত্তা স্কীম সফলতার সাথে রাষ্ট্রে প্রবর্তন করেছে।’’[23] এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ খালিদ বলেন, যা হোক ৬২২ খিষ্টাব্দে কল্যাণ রাষ্ট্রের ইতিহাসে এক মাইল ফলক। এ বছর মুহাম্মাদ (স.) মদিনায় হিজরত করেন এবং সেখানে সাম্য, স্বাধীনতা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে লিখিত ইতিহাসে বিশ্বের প্রথম কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা ছিল এরিজাবেথিয়ান দারিদ্র আইন ১৬০১ এর অনেক আগের।[24]





যাকাত এর আভিধানিক পরিচয়





যাকাত একটি ব্যাপক প্রত্যয়। এটি আরবী শব্দ زكوة থেকে গেৃহীত। যার অর্থ পবিত্রতা বা পরিশুদ্ধতা। যাকাতের আরেক অর্থ পরিবর্ধন (Growth)[25] শুধু তাই নয়, যাকাত একাধারে পবিত্রতা, বর্ধিত হওয়া, আর্শীবাদ (Blessing) এবং প্রশংসা অর্থেও ব্যবহৃত হয়, কুরআন ও হাদিসে যাকাতের এ সব তাৎপর্য নিহিত।[26] আল্লামা জুরযানী বলেন- الزكاة فى اللغة الزيادة[27] অর্থাৎ যাকাতের আভিধানিক অর্থ অতিরিক্ত। মাওলানা আব্দুর রহীম বলেন, যাকাত শব্দের আসল অর্থ হচ্ছে প্রবৃদ্ধি (Growth), প্রবৃদ্ধি লাভ (Increa8uuuse), প্রবৃদ্ধির কারণ (To Cause to grow) ইত্যাদি যা আল্লাহ প্রদত্ত বারাকাত (Blessing) থেকে অর্জিত হয়।[28]





ইসলাম বিশ্বকোষে যাকাতের অর্থ সম্পর্কে আছে, যাকাত অর্থ পবিত্রতা ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা।[29]





আল্লামা শাওকানী বলেন,





الزكاة مأخوذة من الزكاء وهو النماء- زكا الشيئ اذا نما وزاد رجل زكا أي زائد الخير- وسمى جزء منى المال زكوة أى زيادة مع أنه نقص منه لأنها تكثر بر كته بذلك أو تكثر أجر صاحبه-





যাকাত শব্দটি মূল زكاء এর অর্থ প্রবৃদ্ধি, বর্ধিত হওয়া। কোন জিনিস বৃদ্ধি পেলে এই শব্দ বলা হয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া। খুব বেশী কল্যাণকময় হলে তা زكى বলা হয়। আর ধন সম্পদের একটা অংশ বের করে দিলে তাকে যাকাত বা প্রবৃদ্ধি পাওয়া বলা হয়, অথচ তাকে কমে। তা বলা হয় এ জন্য যে যাকাত দিলে তাকে বরকত বেড়ে যায় বা যাকাত দাতা অধিক সওয়াবের অধিকারী হয়।[30]





ইবনুল মানযুর বলেন, যাকাত শব্দের অর্থ হলো পবিত্রতা, ক্রমবৃদ্ধি ও আধিক্য।[31]





সাদী আবু জীব বলেন, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে সম্পদ কমলেও প্রকারান্তে এর পরিবর্ধন ঘটে। এছাড়া এর মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন হয় এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে সমাজ হয় মুক্ত ও পবিত্র।[32]





আবুল হাসান বলেন, যাকাতের অর্থ الطهارة والنماء والبركة والمدح পবিত্রতা, বৃদ্ধি, বরকত ও প্রশংসা।[33]





আল মুজামুল অসীতে আছে, আভিধানিক অর্থ زكا যে জিনিস ক্রমশ বৃদ্ধি পায় ও পরিমাণে বেশী হয়। زكا فلان অমুক ব্যক্তি যাকাত দিয়েছে অর্থ-সুস্থ ও সুসংবদ্ধ হয়েছে।





অতএব, যাকাত হচ্ছে বরকত, পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়া, প্রবৃদ্ধি লাভ, পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা- সুসংবদ্ধতা।[34]





যাকাত এর পারিভাষিক পরিচয়





ইসলামী শরীয়াতের পরিভাষায় জীবন যাত্রার অপরিহার্য প্রয়োজন পুরণের পর সম্পদে পূর্ণ এক বছরকাল অতিক্রম করলে ঐ সম্পদ থেকে নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে ব্যয় করাকে যাকাত বলা হয়।[35]





আল্লামা জুরজানী বলেন:





الزكاة فى الشرع عبارة عن إيجاب طائفة من المال فى مال مخصوص لمالك مخصوص





ইউসুফ কারযাভী বলেন, শরীয়াতের দৃষ্টিতে যাকাত ব্যবহৃত হয় ধন-মালে সুনির্দিষ্ট ও ফরযকৃত অংশ বোঝানোর জন্য। যেমন পাওয়ার যোগ্য অধিকারী লোকদের নির্দিষ্ট অংশের ধন-মাল দেওয়াকে যাকাত বলা হয়।[36]





ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, যাকাত আল্লাহ নির্দেশিত অংশ ধন-মাল থেকে হকদারদের দিয়ে দেয়া, যাতে মন-আত্মা পবিত্র হয় এবং ধন-মাল পরিচ্ছন্ন হয় ও বৃদ্ধি পায়।[37]





নিজের অর্থ সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ অভাবী মিসকিনদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়াকে যাকাত বলে। এটাকে যাকাত বলার কারণ হল এভাবে যাকাত দাতার অর্থ সম্পদ এবং তার নিজের আত্মা পবিত্র -পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। যাকাতের শরয়ী অর্থই তো, আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে কোন মালদার ব্যক্তি কর্তৃক কোন হকদার ব্যক্তিকে তার মালের নির্ধারিত অংশ অর্পন করা।





যাকাত ফরয হওয়ার সময়কাল





ইসলামী বিশ্বকোষ এর ভাষ্যমতে, আল-কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮২ বার যাকাতের কথা বলা হয়েছে। আল-কুরআনে প্রত্যক্ষভাবে ৩২ বার যাকাত এর কথা বলেছেন। এর মধ্যে নামায ও যাকাতের কথা একত্রে বলেছেন ২৮ বার। ফুয়াদ আব্দুল বাকী বর্ণনা করেছেন, আল-কুরআনে মোট ১৯টি সুরায় ২৯টি আয়াতে যাকাত শব্দটির উল্লেখ দেখা যায়।[38] আল-কুরআনের সূরা আত তাওবার ৬০ নং আয়াত দ্বারা যাকাত ফরয হয়। আয়াতটি হলো:





﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيم﴾ [التوبة:60]





দ্বিতীয় হিজরীতে রোজা ফরয হওয়ার পরপরই শাওয়াল মাসে যাকাত ফরয হয় এবং নবম হিজরীতে এটি পুর্ণাঙ্গরূপে কার্যকর করা হয়। হাফিয ইবন হাজর বলেন, যাকাত হিজরতের ২য় বৎসরেই ফরয হয়েছে, রমযানের সিয়াম ফরয হওয়ার পূর্বে। সায়াদ ইবন উবাদাহ বর্ণিত হাদীস থেকেও তা-ই প্রমাণিত।





امرنا رسول الله (ص) بصدقة الفطر قبل أن تنزل الزكوة ئم نزلت فرضية الفرضية الزكوة





রাসূল(সা) যাকাত সংক্রান্ত হুকুম নাযিল হওয়ার পূর্বে সাদকায়ে ফিতর দেয়ার জন্য আমাদের আদেশ করেছিলেন। যাকাত ফরয হওয়ার কথা নাযিল হয়েছে তার পরে।[39]





যাকাতের গুরুত্ব





ইসলামের ৫টি স্তম্ভ বা ভিত্তির একটি যাকাত। ঈমান ও নামাযের পরেই যাকাতের স্থান। আল্লাহর কালাম আল কুরআনে যাকাতের ব্যাপারে বারবার গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল-কুরআনের নামায কায়েমের কথা বলার সাথে সাথে অনেক স্থানে যাকাত আদায়ের প্রসঙ্গটিও এসেছে। [40] আল্লাহর বাণী





﴿ وَٱلَّذِينَ هُمۡ لِلزَّكَوٰةِ فَٰعِلُونَ ﴾[المؤمنون:4]





অর্থাৎ যারা যাকাতদানে সক্রিয়।[41]





যাকাত পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও ফরয ছিল।





স্মর্তব্য যে, যাকাত ব্যবস্থা শুধু উম্মতে মুহাম্মদী (সা.) এর উপর নয় বরং অতীতের সকল নবীদের উম্মতের ওপরও অপরিহার্য পালনীয় ও প্রচলিত ছিল। তবে সম্পদের পরিমাণ এবং ব্যয়ের খাত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ছিল। আল কুরআনুল কারীমে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। যেমন সাইয়্যেদুনা ইবরাহীম (আ.) এবং তার বংশের নবীদের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন:





﴿وَجَعَلۡنَٰهُمۡ أَئِمَّةٗ يَهۡدُونَ بِأَمۡرِنَا وَأَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡهِمۡ فِعۡلَ ٱلۡخَيۡرَٰتِ وَإِقَامَ ٱلصَّلَوٰةِ وَإِيتَآءَ ٱلزَّكَوٰةِ﴾ [الأنبياء:73]





এবং তাদেরকে করেছিলাম নেতা। তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করতো। তাদেরকে ওহী প্রেরণ করেছিলাম সৎকর্ম করতে, সালাত কায়েম করতে এবং যাকাত প্রদান করতে।[42]





ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে





﴿وَكَانَ يَأۡمُرُ أَهۡلَهُۥ بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ﴾[مريم:55]





সে তার পরিজনর্বগকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিত।[43]





মূসা (আ) এর প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,





﴿وَرَحۡمَتِي وَسِعَتۡ كُلَّ شَيۡءٖۚ فَسَأَكۡتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤۡتُونَ ٱلزَّكَوٰة﴾ [الأعراف:156]





َ আর আমি আমার দয়া তা-তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যপ্ত। সুতরাং আমি তা তাদের জন্য নির্ধারিত করব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত দেয় ও আমার নিদর্শনে বিশ্বাস করে। [44]





ঈসা (আ.) এর সময়কার অবস্থা বর্ণনায় রাববুল আলামীন,





﴿وَجَعَلَنِي مُبَارَكًا أَيۡنَ مَا كُنتُ وَأَوۡصَٰنِي بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ مَا دُمۡتُ حَيّٗا﴾[مريم:31].





যেখানেই আমি থাকি না কেন তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি ততোদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে। [45]





মোটকথা, সে প্রাচীন যামানা থেকেই সকল নবী-রাসূলদের উম্মতের ওপর নামায ও যাকাত ফরয হিসেবে পালনীয় ছিলো। কোন নবীর সময়কালেই দ্বীন ইসলাম দুটো ফরয থেকে মুক্ত ছিল না। তবে উম্মতে মুসলিমার বর্তমান পর্যায়ে ধনীদের সম্পদ পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে হিসেব করত: প্রতিবছর যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।[46] যাকাত দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থদের মধ্যে আল্লাহ নির্ধারিত অবশ্য কর্তব্য ও বাধ্যতামুলক প্রদেয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।





যাকাতের ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীন ও ইসলামী চিন্তাবিদদের অভিমত





যাকাতের ফরযিয়্যাত বিষয়ে ইসলামের সোনালী যুগের মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ (সা.) এর সান্নিধ্যে ধন্য সাহাবায়ে কিরাম বিশেষ করে খুলাফায়ে কিরামগণ গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। পাশাপাশি পরবর্তীকালীন ইসলামী চিন্তাবিদগণ তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যেমন: হযরত আবু বকর (রা) বলেন, ‘যারা যাকাত দিতে ছল চাতুরীর আশ্রয় নেবে আমি তাদের কাছ থেকে যাকাত এবং সম্পদের অর্ধেক আদায় করবো।’ ওমর (রা.) বলেন, ‘‘আমি যদি আগে বুঝতে পারতাম তাহলে বিত্তশালীদের অতিরিক্ত সম্পদ গরীব ও মুহাজিরদের মাঝে ভাগ করে দিতাম।’’[47]





আলী (রা.) বলেন, ‘‘অভাবগ্রস্থদের অভাব দূরীকরণে বিত্তশালীদের ধন-সম্পদের ওপর অনেক দায়িত্ব বর্তায়। যদি ক্ষধার্ত ও নাঙ্গা মানুষ থাকে তাহলে বুঝতে হবে যে সম্পদশালীরা তাদের দায়িত্ব পালন করছে না।’’[48]





আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বলেন, ‘‘তোমাদের সম্পত্তিতে যাকাত এবং এর অতিরিক্ত আরো দাবি আছে।’’





ইমাম কুরতুবী লিখেছেন, ‘‘মুসলিম জনসমষ্টির ওপর বিপদ বা অভাব দেখা দিলে যাকাত দেয়া এবং অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা ধনী লোকদের জন্য ওয়াজিব।’’[49]





ইমাম ইবনে তাইমিয়্যা বলেন, ‘বুভুক্ষকে খাবার খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে পরিধেয় দেওয়া ফরযে কিফায়া হিসেবে জরুরী হয়ে পড়ে।’’[50] আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী বলেন, ‘‘যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সব অভাবগ্রস্থ ও দুদর্শাগ্রস্থ মানুষের অভাব দূর করা ও অর্থনৈতিকভাবে পূর্ণবাসন করা সম্ভব। যাকাত অভাবগ্রস্থকে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে যাতে সে আর অভাবগ্রস্থ না থাকে।’’[51]





মূলত যাকাত ব্যবস্থার দ্বারা ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা দারিদ্রমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন। যাকাত দুস্থ গরীবদের প্রতি ধনীদের কোন দয়া বা অনুগ্রহ নয়, বরং অধিকার বা হক, এটাই প্রকৃত সত্য ও শাশ্বত কথা।





যাকাত বণ্টনের খাতসমূহ





যাকাত বণ্টনের ব্যাপারে আল-কুরআনের স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে:





﴿إِنَّمَا ٱلصَّدَقَٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡعَٰمِلِينَ عَلَيۡهَا وَٱلۡمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمۡ وَفِي ٱلرِّقَابِ وَٱلۡغَٰرِمِينَ وَفِي سَبِيلِ ٱللَّهِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِۖ فَرِيضَةٗ مِّنَ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٞ﴾[التوبة:60]





অর্থাৎ সাদাকাহ (যাকাত) তো কেবল নি:স্ব, অভাবগ্রস্থ ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণভারাক্রান্তদের, আল্লাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান।[52]





মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের আলোকে যাকাত ব্যয়ের খাত ৮টি। যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে পেশ করছি:





১. নিঃস্ব ফকীর (الفقير): ফকীহ বলা হয় যার কোন সম্পদ নেই, নেই তার উপযোগী হালাল উপার্জন, যদ্বারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। যার খাওয়া-পরা ও থাকার স্থান নেই। অন্যান্য নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেই। আবার কেউ বলেছেন, ফকীর সে যার সামান্য সম্পদ আছে। তবে জীবন ধারণের জন্য অপরের ওপর নির্ভর করে।





ফকীরের সংজ্ঞায় আল্লামা তাবারী বলেন, المحتاج المتعفف الذى لايسأل সে অভাবগ্রস্থ যে নিজেকে সর্বপ্রকার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলেছে, কারোর নিকটই কিছুর প্রার্থনা করে না।[53]





ইবনে আববাস, হাসান আল বসরী, মুজাহিদ, ইকরামা ও জহুরীর মতে: ফকীর এমন ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের কাছে হাত পাতে না। তবে এক্ষেত্রে ফকীহদের সংজ্ঞা বিষয়ক ইমাম শাফিয়ীর দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্নরূপ। তিনি বলেন, ফকীর ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে কর্মজীবি নয় , যার কোন সম্পদ নেই। ইমাম আবু হানিফা সহ অন্যান্য আহলুর রায়গণ বলেন-الفقير أحسن حالا من المسكين ومن الناس মিসকীন অপেক্ষা ফকীরের অবস্থা উত্তম।[54]





মুলকথা হলো, এ পর্যায়ের লোকদেরকে যাকাতের খাত থেকে সাহায্য করা যাবে।





এ খাতটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বলে আল্লাহ ৮টি খাতের মধ্যে সর্ব প্রথমে উল্লেখ করেছেন। আর আরবী বাচনিক রীতি আছে, সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা সর্বপ্রথম বলা।



Recent Posts

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 3

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 2

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 1