Articles



বাংলাদেশে ধর্মান্তরের অপতৎপরতা : ওলামায়ে কেরাম ও সুধীজনদের করণীয়





[ বাংলা – Bengali – بنغالي ]





ইঊসুফ সুলতান





সম্পাদনা : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া





2012 - 1433









حركة التنصير في بنغلاديش وواجب العلماء والمثقفين





« باللغة البنغالية »





يوسف سلطان





مراجعة: أبو بكر محمد زكريا





2012 - 1433





বাংলাদেশে ধর্মান্তরের অপতৎপরতা : ওলামায়ে কেরাম ও সুধীজনদের করণীয়





ইঊসুফ সুলতান





ভূমিকা :





প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। একাত্তরে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে আমাদের এ দেশ। এ দেশের শতকরা প্রায় নব্বই ভাগই মুসলিম বা ইসলাম ধর্মাবলম্বী।[1] এ দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মুসলিম।





প্রিয় এ দেশের সংবিধানে আছে, “প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে; প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে”[2]





আমরা জানি, সংবিধানের এ ধারা অন্য ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল করার জন্য প্রণীত। আর সহানুভূতি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন ও দেখিয়েছেন। পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান মদীনার সনদ তারই উজ্জ্বল প্রমাণ।





কিন্তু সংবিধানের এ ধারার সহানুভূতিশীলতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কিছু গোষ্ঠী জোরপূর্বক বা বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।[3] যা বিভিন্ন সময় জাতীয় দৈনিক ও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে বলে এতে আর কোনো সন্দেহ নেই। জোরপূর্বক ধর্মান্তর যে কেবল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই নিন্দনীয়, তা নয়; বরং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্যও তা হুমকিস্বরূপ।[4]





এই প্রবন্ধে ধর্মান্তরের সংজ্ঞা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, মাধ্যম ও মোকাবিলার উপায় আলোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ।





এক. ধর্মান্তর কী?





সংজ্ঞা : ধর্মান্তর শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ধর্ম পরিবর্তন করানো। পরিভাষায় আমরা বুঝি, মানুষকে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। যদি তারা খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ না করে, তাহলে অন্তত স্ব ধর্ম থেকে বের হওয়ায় উৎসাহিত করা। বিশেষ করে মুসলিমদের ক্ষেত্রে এমনটি করা।





ধর্মান্তর একটি ধর্মীয়-রাজনৈতিক আন্দোলন, যা ক্রুসেড যুদ্ধের প্রসারে প্রসার লাভ করেছে। উদ্দেশ্য, পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি-বর্ণের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করা, বিশেষ করে মুসলিমদের মাঝে।[5]





কুরআনিক ইতিহাস :





খ্রিষ্টধর্মানুসারীরা যখন থেকে তাদের পতন বুঝতে পেরেছে, তখন থেকেই তাদের ধর্মের প্রচার-প্রসারে বিশেষ করে মুসলিমদের ধর্মান্তর করে খ্রিষ্টান বানানোর চেষ্টা শুরু করেছে।[6] এজন্য তারা মুসলিমদের বন্ধু হয়েছে, ভাই সেজেছে। আল-কুরআনের বাণী :





ক.





﴿ مَّا يَوَدُّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ مِنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ وَلَا ٱلۡمُشۡرِكِينَ أَن يُنَزَّلَ عَلَيۡكُم مِّنۡ خَيۡرٖ مِّن رَّبِّكُمۡۚ وَٱللَّهُ يَخۡتَصُّ بِرَحۡمَتِهِۦ مَن يَشَآءُۚ وَٱللَّهُ ذُو ٱلۡفَضۡلِ ٱلۡعَظِيمِ ١٠٥ ﴾ [البقرة: ١٠٥]





আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের, তাদের মনঃপুত নয় যে, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি কোনো কল্যাণ অবতীর্ণ হোক। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ ভাবে স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহ মহান অনুগ্রহদাতা।[7]





খ.





﴿ وَدَّ كَثِيرٞ مِّنۡ أَهۡلِ ٱلۡكِتَٰبِ لَوۡ يَرُدُّونَكُم مِّنۢ بَعۡدِ إِيمَٰنِكُمۡ كُفَّارًا حَسَدٗا مِّنۡ عِندِ أَنفُسِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ ٱلۡحَقُّۖ فَٱعۡفُواْ وَٱصۡفَحُواْ حَتَّىٰ يَأۡتِيَ ٱللَّهُ بِأَمۡرِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيۡءٖ قَدِيرٞ ١٠٩ ﴾ [البقرة: ١٠٩]





আহলে কিতাবদের অনেকেই প্রতিহিংসাবশত চায় যে, মুসলিম হওয়ার পর তোমাদেরকে কোন রকমে কাফের বানিয়ে দেয়। তাদের কাছে সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর (তারা এটা চায়)। যাক তোমরা আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত তাদের ক্ষমা কর এবং উপেক্ষা কর। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।[8]





গ.





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن تُطِيعُواْ فَرِيقٗا مِّنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ يَرُدُّوكُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡ كَٰفِرِينَ ١٠٠ ﴾ [ال عمران: ١٠٠]





হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আহলে কিতাবদের কোনো ফেরকার কথা মান, তাহলে ঈমান আনার পর তারা তোমাদেরকে কাফেরে পরিণত করে দেবে। [9]





দুই. ধর্মান্তরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী :





আল্লাহ তা‘আলা বলেন,





﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ يُنفِقُونَ أَمۡوَٰلَهُمۡ لِيَصُدُّواْ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ ﴾ [الانفال: ٣٦]





“নিঃসন্দেহে যেসব লোক কাফের, তারা ব্যয় করে নিজেদের ধন-সম্পদ; যাতে করে বাধাদান করতে পারে আল্লাহর পথে।”[10]





ধর্মান্তরের জন্য খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা বড় অংক খরচ করে থাকেন। তাদের লক্ষ্য নিম্নরূপ :





ক. খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের মুসলিম হওয়া থেকে বিরত রাখা





এ লক্ষ্যে তারা মুসলিম দেশগুলোকে যুদ্ধ-বিগ্রহে ও নানা অশান্তি-অরাজকতায় ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করে। মুসলিম দেশে আসার ভিসা দেয়ার ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে।





খ. অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও মুসলিম হওয়া থেকে বিরত রাখা





তাদের প্রচেষ্টা থাকে অন্য কেউ মুসলিমদের সংস্পর্শে আসতে না পারে। কারণ মুসলিম হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারলেই তাদের প্রচেষ্টা সার্থকতার মুখ দেখতে পারে।





গ. মুসলিমদেরকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করে আনা :





এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য। একজন মুসলিমকে নামমাত্র মুসলিমে পরিণত করা এবং তার সাথে আল্লাহর সম্পর্কে ছেদ ঘটানোই এখানে মূল উদ্দেশ্য। দীর্ঘ মেয়াদে যা ইসলাম ধ্বংসে সমূহ সাহায্য করবে।





ঘ. ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করা





এটি তাদের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র। তারা ভালোভাবেই জানে যে সত্যিকার ইসলাম জানতে পারলে সবাই ইসলামের দিকেই ঝুঁকবে। তাই তারা সবসময় ইসলাম সম্পর্কে মিথ্যা সন্দেহ তৈরী করে তা প্রচার করে বেড়ায়। তাছাড়া পয়সা খরচ করে কিছু লোকও তৈরী করে যারা তাদের সে সকল সন্দেহ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে পারে।





ঙ. ইসলামের শিক্ষা-দীক্ষার চেয়ে খ্রিষ্টধর্মের শিক্ষা-দীক্ষাকে প্রিয় করে তোলা





এ লক্ষ্যের বাস্তবায়ন স্পষ্ট হয় শিক্ষার সিলেবাসে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, ইংরেজী মাধ্যমের সয়লাব এবং বিভিন্ন এন.জি.ও পরিচালিত স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি পরিচালনার মধ্য দিয়ে।





চ. পশ্চিমের উন্নতি খ্রিষ্টধর্মের কল্যাণেই, এ ধারণা বদ্ধমূল করা





যদিও প্রকৃত প্রস্তাবের প্রাশ্চাত্যের কেউই খ্রিষ্টধর্ম পালন করে না, হয়ত রবিবারে একদিন কারও কারও ইচ্ছা হলে গীর্জায় যায়। কিন্তু খ্রিষ্টধর্মের অনুসারীরা তাদের দেশের উন্নয়নকে ধর্মের কল্যাণে অর্জিত হয়েছে বলতে কুণ্ঠাবোধ করে না।





ছ. মুসলিম দেশগুলোতে বৃহদাংশে খ্রিষ্টান বানানো, প্রবেশ করানো





এটি তাদের বৃহৎ ও প্রধান উদ্দেশ্য। এ জন্যই তারা তাদের যাবতীয় অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে থাকে। কোনো এলাকা খ্রিষ্টান হয়ে গেলে সেখানে সমস্যা তৈরী করে তারপর সেখানকার লোকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে স্বাধীনতার জন্য প্ররোচনা দেয়। যেমন পূর্ব তীমূর এর ঘটনা, অনুরূপভাবে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলেও এমন কিছু যে করবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?





জ. মুসলিমদের ঐক্য বিনষ্ট করা





তাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করা। মুসলিমদের মধ্যে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সমাজে সমাজে, এমনকি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সংঘর্ষ লাগানোর জন্য তাদের প্রচেষ্টা সর্বদা অব্যাহত থাকে। সে জন্য তারা কুটনৈতিক প্রচেষ্টাও কাজে লাগায়। তারপর সেখানে অস্ত্র বিক্রি করে সে টাকা ধর্মান্তকরণের জন্য ব্যয় করে।





তিন. ধর্মান্তরের মাধ্যমগুলো কী ?





ধর্মান্তর একটি জটিল প্রক্রিয়া। এটি মানুষের বিশ্বাসে পরিবর্তন আনার নাম, যা কখনোই সহজে হয় না। তাই তা সহজ করতে তারা বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ নিয়ে থাকে।





ক. বিভিন্ন মুসলিম দেশে মিশনারি দল পাঠানো





মিশনারি দল হলো বিভিন্ন ধর্মীয় দল, যারা শিক্ষা-চিকিৎসা ইত্যাদি সেবার মাধ্যমে বা সরাসরি ইঞ্জিল প্রচারের কাজ করেন।[11]





খ. বই-পত্র, আর্টিকেল ছাপানো – যেগুলো ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি ও সন্দেহ ছড়ায়, ইসলামকে বিশ্ববাসীর সম্মুখে হেয় করে তোলে





এসবের মধ্যে সিলেবাসের পাঠ্য বই, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।





গ. চিকিৎসা - এক্ষেত্রে সারা বিশ্বে রোগের ছড়াছড়ি এবং সে তুলনায় মুসলিম রাষ্ট্রের চিকিৎসা-মাধ্যমের কমতি তাদের সুযোগ করে দিচ্ছে।





যেখানে মানুষ আছে, সেখানেই রোগ আছে। আর যেখানে রোগ আছে, সেখানেই চিকিৎসকের প্রয়োজন আছে। আর চিকিৎসকের প্রয়োজন যেখানে, সেখানেই ধর্মান্তরের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।[12]





ঙ. শিক্ষা পদ্ধতি – স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা, যেগুলোতে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে খ্রিষ্টধর্মের বীজ বপন করা হয়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোও অনেক ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে।





প্রখ্যাত খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক হেনরী জেসব বলেন, খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলগুলোতে শিক্ষা হলো লক্ষ্যে পৌঁছানোর মাধ্যম মাত্র। আর সেই লক্ষ্য হলো, মানুষকে মাসীহের নেতৃত্বে নিয়ে আসা, আর তাদের এমনভাবে শিক্ষা দেয়া যেন তারা মাসীহী জনগণে পরিণত হয়; পরিণত হয় মাসিহী গোষ্ঠীতে।[13]





চ. নাস্তিকতা ছড়ানো :





ধর্মান্তরের একটি অন্যতম উপায় হলো নাস্তিকতা ছড়ানো। ধর্মান্তরকারীদের মূল উদ্দেশ্য মুসলিমদেরকে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের করা। যদি তাদের উদ্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী বানানো যায়, তাহলে তো কথাই নেই। তা সম্ভব না হলে অন্তত নাস্তিক বানানো গেলেও ইসলাম থেকে তাদের বের করা যায়।





খ্রিষ্টধর্ম প্রচারক জেমের বলেন, “তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, মুসলিমকে ইসলাম থেকে বের করা। যেন সে এমন এক সৃষ্টে পরিণত হয়, যার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক নেই।”[14]





চ. মিডিয়ার ব্যবহার – প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক ও ইন্টারনেট মিডিয়ার ব্যবহার করে তারা ইসলামের অপমান করছে, ইসলামের বিভিন্ন মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ ঢেলে দিচ্ছে। ফলে মানুষ খ্রিষ্টান না হলেও অমুসলিম বা নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে।





আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যে কোনো লেখনী, বক্তব্য, দলীল ইত্যাদির চেয়েও হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী।





ফ্রেড ওকারোড বলেন, এটা স্পষ্ট যে মিডিয়া আজ অনত্যম বৃহৎ মাধ্যম, যার মাধ্যমে সহজেই মধ্যপ্রাচ্য আর উত্তর আফ্রিকার মুসলিমদের দ্বারে পৌঁছা যায়। কেননা আমাদের জানা মতে মিডিয়া সীমানার প্রাচীর ভেঙে দিতে পারে, সমুদ্র আর মরুভূমি পাড়ি দিয়ে দূর্গম অঞ্চলের মুসলিমদের কাছে পৌঁছে যেতে পারে।[15]





এসব মিডিয়াতে তারা কয়েক ভাবে কাজ করে থাকে :





১. সরাসরি খ্রিষ্টধর্মের দিকে আহ্বান করা, তাদের বৈশিষ্ট্য, ভাতৃত্ব, মায় ইত্যাদি বড় করে দেখানো।





২. মুসলিমদের আকীদা ও দ্বীনের মৌলিক বিষয়ে সন্দেহ ছড়ানো ও ব্যঙ্গাত্বক ভাবে তুলে ধরা। এ ক্ষেত্রে নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন সবই ভূমিকা রাখতে পারে।





৩. অশ্লীলতা ও পর্ণোগ্রাফী ছড়িয়ে চরিত্র নষ্ট করা, লজ্জা কমিয়ে আনা, আত্মমর্যাদা ভুলিয়ে দেয়া এবং নানা রিপুতে ডুবিয়ে দেয়া। চরিত্র বিনষ্টকারী পণ্য সুলভ মূল্যে ও আকর্ষণীয় উপায়ে বাজারজাত করা। যেন এরপর এসব মানুষকে সহজেই যে কোনো দিকে ডাকা যায়। এমনকী আল্লাহর সাথে নাফরমানী করতেও তাদের ডাকতে অসুবিধা না হয়।





১৯৮৬ সনের পরিসংখ্যানে স্পষ্ট যে, মিডিয়া ও যোগাযোগ খাতে ধর্ম প্রচারের জন্য ব্যয় ১১৯৬৫ ডলার পৌঁছে গেছে।[16]





এই তিনটি ছাড়াও আরো অনেক মাধ্যম চিন্তা করলেই পাওয়া যাবে। তাদের মাধ্যমগুলো সীমিত নয়। আল্লাহ বলেন:





﴿ وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٥٤ ﴾ [ال عمران: ٥٤]





তারা যেমন ছলনা করত তেমনি, আল্লাহও ছলনা করতেন। বস্তুতঃ আল্লাহর ছলনা সবচেয়ে উত্তম। [17]





﴿ يُرِيدُونَ أَن يُطۡفِ‍ُٔواْ نُورَ ٱللَّهِ بِأَفۡوَٰهِهِمۡ وَيَأۡبَى ٱللَّهُ إِلَّآ أَن يُتِمَّ نُورَهُۥ وَلَوۡ كَرِهَ ٱلۡكَٰفِرُونَ ٣٢ ﴾ [التوبة: ٣٢]





তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নির্বাপিত করতে চায়। কিন্তু আল্লাহ অবশ্যই তাঁর নূরের পূর্ণতা বিধান করবেন, যদিও কাফেররা তা অপ্রীতিকর মনে করে। [18]





চার. ধর্মান্তর মোকাবেলার উপায় কী ?





ক. দাওয়াত ও তাবলীগ : ধর্মান্তরকারীদের যে কোনো লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার প্রধান সুযোগ সৃষ্টি করে দেয় মুসলিমদের দুর্বল ঈমান। কাজেই ধর্মান্তর মোকাবেলায় এই দুর্বল ঈমানকে সবল করার চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। আর এ লক্ষ্য নিয়েই ১৯২৬ সনে তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠা হয় এ স্লোগান নিয়ে "হে মুসলিমগণ! মুসলিম হও"। যা আল-কুরআনেরই একটি আয়াতের মর্মার্থ :





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱدۡخُلُواْ فِي ٱلسِّلۡمِ كَآفَّةٗ وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٞ ٢٠٨ ﴾ [البقرة: ٢٠٨]





হে ঈমানদার গন! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ কর না। নিশ্চিত রূপে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। [19]





মুসলিমদের ঈমান শক্তিশালী করার জন্য এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার অভ্যাস করার জন্য তাবলীগের কাজকে আরো বেগবান করতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এ খিদমত আরো দায়িত্ব নিয়ে পালন করতে হবে।





খ. গবেষণা-লেখালিখি : ধর্মান্তরের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম বই-পত্র ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ। আমাদের লেখকদের এ বিষয়ে সচেতনতামূলক ও ঈমানের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশি বেশি বই-পত্র প্রকাশ ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশে উৎসাহী হতে হবে।





এছাড়া শিক্ষার সিলেবাসের জন্য উপযোগী বই প্রণয়নেও মনোযোগী হতে হবে। মনে রাখার বিষয়, শিক্ষাই ধর্মান্তরের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম।





গ. মিডিয়া : মিডিয়া যে কোনো কিছু প্রচারের একটি অদ্বিতীয় মাধ্যম। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও ইন্টারনেট মিডিয়া এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। হকপন্থী আলেমদের এ ক্ষেত্রে অনুপস্থিতি বাতিলপন্থীদের শক্ত অবস্থান তৈরীর সুযোগ করে দিচ্ছে। আর প্রত্যেক বাতিলই কোনো না কোনো ভাবে ধর্মান্তরের চক্রান্তকারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্যকারী রূপে কাজ করে যাচ্ছে। বাতিলের সয়লাবই নাস্তিকদের নাস্তিক হতে উৎসাহিত করে। ইসলামের মৌলিক বিষয়াদিতে সন্দেহ ঢোকায়।





এ বিষয়টা নিয়ে আলেমদের আরো গভীর দৃষ্টি দেয়া এখন সময় ও ঈমানের দাবী।





৪. সাহায্য সংস্থা : সমস্যা যেখানে, সেখানেই সমাধানের প্রয়োজন। আর সমাধানের প্রয়োজন যেখানে, সেখানেই ধর্মান্তরের কাজ করার সুবর্ণ সুযোগ।





মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো যেমন, আহার, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি যদি রাষ্ট্র মেটাতে না পারে, তখন অন্যরা এ সুযোগকে কাজে লাগায়। কাজেই ইসলামের হিতাকাঙ্ক্ষীদের কর্তব্য হলো, দলমত নির্বিশেষে আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা। সাহায্য সংস্থা, সাহায্য সংগঠন ইত্যাদি তৈরী করা। তাহলে আর সুযোগসন্ধানীদের সুযোগ থাকবে না।





৫. ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি : বলা হয়, অর্থনীতিই হলো সমাজের মূল চালিকাশক্তি। আর অর্থনীতির গোড়ায় আছে ব্যবসা-বাণিজ্য। কাজেই ইসলামের আলোকে ব্যবসা পরিচালনা, ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপন প্রচারনা ইত্যাদি সবকিছুই ধর্মান্তরের চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত নস্যাত করে দিতে পারে।





ব্যবসায়িক ব্রান্ড, বিজ্ঞাপন, বিলবোর্ড সবই আজ ধর্মান্তরের প্রচারনায় লিপ্ত। এ দিকটায় গভীর দৃষ্টি দেয়ার সময় এসেছে।





এছাড়া :





ক. মুসলিমদের মৌলিক আকীদাগুলো শিক্ষার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্তি এবং সাধারণ প্রোগ্রামের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অন্তরে গেঁথে দেয়া।





খ. উম্মতের সর্বস্তরে দ্বীনের গুরুত্ব এবং দ্বীনী আত্মমর্যাদাবোধ ছড়িয়ে দেয়া।





গ. যেসব মাধ্যম/মিডিয়া ধর্মান্তরকে উৎসাহিত করে, সেসব সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নেয়া; জনগণকে সতর্ক করা; সম্ভব হলে সেগুলো প্রচার/প্রকাশ বন্ধ করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা।





ঘ. ধর্মান্তরের পদ্ধতি, সমস্যা, ক্ষতিগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা। ধর্মান্তরকারীদের কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন করা।





ঙ. মুসলিমদের জীবনের যাবতীয় বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দিককে প্রাধান্য দেয়া।





চ. একান্ত প্রয়োজন ছাড়া অমুসলিম দেশে সফর করা থেকে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে সতর্ক হওয়া।





ছ. মুসলিমদের পরস্পরিক সহযোগিতামূলক সংগঠন গড়ে তোলা। যেগুলো দরিদ্র মানুষের উপকার করবে, অসহায়ের পাশে দাঁড়াবে। যেন এসব বিষয়ে ধর্মান্তরকারীদের চক্রান্তে পড়তে না হয়।





পাঁচ. কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যান :





ক. ইন্দোনেশিয়ায় গত চল্লিশ বছরে খ্রিষ্টানদের মোট সংখ্যা ১.৩ মিলিয়ন থেকে ১১ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে।[20]





খ. ১৯৬০ এর পূর্বে নেপালে কোনো খ্রিষ্টান অফিশিয়ালি বসবাসের সুযোগ পেত না। এখন সেখানে ৭৫টা জেলার সবগুলোতে চার্চ আছে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন খ্রিষ্টান জনসংখ্যা নিয়ে।[21]





গ. Book of Acts এ একজন চার্চ লিডার তার বন্ধুকে লিখেন, “তোমাদের শক্তিশালী প্রার্থনায় প্রভু জানুয়ারী থেকে জুনে ২০০৬ এর মধ্যে ৪৪৫২ জনকে রক্ষা করেছেন (ধর্মান্তর করেছেন) এবং ১৫০টা চার্চ স্থাপন করেছেন। প্রার্থনার অনুরোধ : আমাদের লক্ষ্য ২০০৬ এ ৩০০ চার্চ স্থাপন করা এবং ৯০০০ মানুষকে রক্ষা করা (ধর্মান্তর করা)[22]





ঘ. ১৮৮১ সনে বাংলাদেশে প্রতি ৬০০০ মানুষে একজন খ্রিষ্টান ছিল। ২০০০ সনে তা এসে দাঁড়ায় ১১ জনে একজন। ২০১৫ তে তাদের লক্ষ্য হলো প্রতি তিনজনে একজন।[23]





ঙ. ২০০৫ এ ভারত ছিল পৃথিবীর ৭ম বৃহত্তম খ্রিষ্টধর্মী দেশ। ২০২৫ এ তা ৫ম এ উন্নীত হবে। [24]





চ. আর ২০০৫ এ ভারত ছিল পৃথিবী ২য় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। যা ২০২৫ এ ৩য় তে চলে যাবে।[25]





ছ. আশার কথা হলো, পৃথিবীর ১০ বৃহত্তম খ্রিষ্টধর্মী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই। আর বৃহত্তম মুসলিম দেশের তালিকায় ২০০৫ এ বাংলাদেশ ৩য়, কিন্তু ২০২৫ এ ২য় হয়ে যাবে।[26] তবে ভারতের মিডিয়া ও বিভিন্ন প্রভাব বাংলাদেশকে কোথায় দাঁড় করায় সেটাই দেখার বিষয়।





জ. ১৫ই জানুয়ারী, ২০১২ এর হিসাব মতে ইন্টারনেটে মোট পেইজের সংখ্যা ৮.৩৫ বিলিয়ন (৮৩৫ কোটি)[27] তবে দু:খের বিষয় হলো, ইন্টারনেটে প্রতি সেকেন্ডে ২৮,২৫৮ জন ব্যবহারকারী অশ্লীল পেইজ ভিজিট করে থাকেন।[28]





ঝ. ৭৫০ জন মুসলিম থেকে ক্রিস্টান কনভার্টের ওপর একটি জরিপ করা হয়। যা থেকে ৫টি কারণ উদঘাটন করা হয়, যে কারণে তারা ধর্ম পরিবর্তন করেছেন।





১. খ্রিষ্টানদের জীবন-যাপন পদ্ধতি। ২. প্রচলিত ইসলামের প্রতি অনাগ্রহ। এবং ৩. বাইবেলের ভালবাসার দীক্ষা। [29]





এই জরিপ থেকে এটা স্পষ্ট যে, যাদের খ্রিষ্টান বানানো হয়, তাদেরকে মুসলিমদের জীবন যাপন পদ্ধতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেয়া হয়। এবং প্রচলিত ইসলামের নানা অসঙ্গতিগুলোকে তাদের কাছে মৌলিক ইসলাম রূপে পেশ করা হয়, যার ফলে তাদের অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়। এবং পরিশেষে বাইবেলের ভালবাসার আহ্বান তুলে ধরা হয়। অথচ আল-কুরআনে প্রতিটি সূরায় এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাদীসে যে ভালবাসার আহ্বান জানিয়েছেন, তার চেয়ে বড় আর কোনো ভালোবাসার আহ্বান হতে পারে না।





রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দয়াশীলদের মহান দয়ালু (আল্লাহ তা’আলা) দয়া করেন। পৃথিবীতে যারা আছে (মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টি) তাদের প্রতি দয়া করো। তাহলে উপরে যিনি আছেন (আল্লাহ তা’আলা) তিনিও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। [30]





এ ছাড়াও দয়া, মায়া আর ভালোবাসার হাদীস রাসূলের সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস ভান্ডারে অসংখ্য। তিনি নিজেই ছিলে দয়ার জীবন্ত প্রতীক। তাঁর কাছে একজন মুসলিম যে মায়া ও ভালোবাসা পেত, একজন অমুসলিমও সেই ভালোবাসা নিয়ে ফিরে যেত।





ছয়. কিছু সংবাদ শিরোনাম :





ক. বাংলাদেশে খ্রিষ্টান মিশনারীদের গরিব হিন্দু-মুসলিমদের খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার অপপ্রচেষ্টা [31]





খ. ময়মনসিংহে ৫৫ মুসলিমকে ধর্মান্তরের চেষ্টা : ৩ ধর্মযাজক আটক [32]





গ. পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র : সেনা সদরের হুঁশিয়ারি [33]





ঘ. দামুড়হুদায় চিকিৎসা সেবার নামে খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারের সময় ৬ জন আটক [34]





ঙ. পার্বত্য চট্টগ্রাম খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল গড়তে বিভিন্ন তত্পরতা [35]





চ. তানোরে সাঁওতাল সম্প্রদায় ধর্মান্তরিত হচ্ছে [36]





ছ. পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপক ধর্মান্তরকরণ নিয়ে প্রশ্ন : খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলই কি লক্ষ্য? [37]





লেখক:





সহকারী মুফতী, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা





সহকারী মুফতী, জামিয়াতুল আস’আদ আল ইসলামিয়া ঢাকা





খতীব, বাইতুল ফালাহ জামে মসজিদ, মালিবাগ, ঢাকা





Recent Posts

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 3

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 2

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 1