Articles

নবুওয়তের দাবীদারদের উৎপত্তি





ও ঐতিহাসিক পরিণতি





নবুওয়তের দাবীদারদের উৎপত্তি ও ঐতিহাসিক পরিণতি





ভূমিকাঃ





মুসলিম মাত্রই এটা বিশ্বাস করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে মহান আল্লাহ্ নবুওয়াতের ধারার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছেন, সুতরাং তাঁর পরে আর কোন নবী বা রাসূল আসবেন না। এটি এমন এক বিশ্বাস যা না করলে ঈমানই শুদ্ধ হবে না।





মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ, তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পর, উমাইয়া ও আববাসী যুগে এমনকি বর্তমান কালেও মাঝে মধ্যে নবুওয়াতের দাবীদারদের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের শত্রুদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্ররোচনা, তাদের ষড়যন্ত্র এবং তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতায় কিছু সময়ের জন্য তাদের কারো কারো কণ্ঠ উঁচু হতেও দেখা যায়। কিন্তু মহান আল্লাহ্ তাঁর দীন ইসলামকে যেমন পূর্ণ করেছেন তেমনি তার সংরক্ষণের দায়িত্বও পালন করেছেন। ফলে যুগে যুগে এ সমস্ত নবুওয়তের দাবীদাররা ধিকৃত ও লাঞ্ছিত হয়েছে। সাময়িকভাবে তারা পরিচিতি ও সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হলেও পরবর্তিতে তারা ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেনঃ ‘‘তারা তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহ্‌র জ্যোতি নিভিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আল্লাহ্ তার বিপরীত করলেন, যেন তার নুর পূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করে। যদিও তা কাফিরদের মনে খারাপ লাগছে। তিনিই সে মহান সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে সঠিক পথনির্দেশ ও সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন, যেন আর সব দীনের উপর বিজয়ী করতে সক্ষম হন, মুশরিকরা যদিও তাতে বিরক্ত হয়।’’[1]





আলোচ্য প্রবন্ধে ইতিহাসের পাতা থেকে সে সমস্ত ভন্ড নবীদের কথা বর্ণনা করা হবে যাদের অনুসারী তৈরী হয়েছিল এবং পরবর্তীতে তাদের আক্বীদা ও বিশ্বাসের প্রভাব রয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া অন্য যে সমস্ত নবুওয়তের দাবীদার রয়েছে কিন্তু তাদের মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের প্রভাব শেষ হয়ে গেছে বা তাদের অনুসারী-অনুগামী দল তৈরী হয়নি, তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হবে না।





এ প্রবন্ধের প্রথমেই নবুওয়াত ও রিসালাতের পরিসমাপ্তি সংক্রান্ত দলীল-প্রমাণাদি পেশ করা হবে। তারপর বিভিন্ন যুগে কারা কিভাবে নবুওয়তের দাবী করেছিল তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।





1. নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি ও তার প্রমাণাদি





মহান আল্লাহ্ যুগে যুগে নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। তাদের মাধ্যমে শরীয়ত ও দীনের উৎকর্ষ সাধন করেছেন। সবশেষে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে তাঁকে শ্রেষ্ঠ ও পূর্ণ শর‘আত প্রদান করে নবুওয়াত ও রিসালাতের পূর্ণতা দান করেছেন। যাতে কিয়ামত পর্যন্ত যাবতীয় সমস্যার সমাধান দিয়ে রেখেছেন। ফলে তাঁর পরে আর কোন নবী-রাসূল প্রেরণের আবশ্যকতা রইল না। যেমনি রইল না কোন কিতাব নাযিল করার। নিম্নে এর সপক্ষে আমরা কুরআন, হাদীস এবং সাহাবা-তাবে‘ঈন ও ইমামগণের উক্তি বর্ণনা করব।





1.1 নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি সংক্রান্ত পবিত্র কুরআনের ঘোষণাঃ





মহান আল্লাহ্ বলেনঃ








‘‘মুহাম্মাদ তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহ্র রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ[2]।’’





কুরআনের তাফসীরকারগণ সবাই এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, এ আয়াতে خَاتَمَ ٱلنَّبِيِّ‍ۧنَۗ এর অর্থ, শেষ নবী[3]।





মহান আল্লাহ্ আরও বলেনঃ





‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাংগ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নি‘আমত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দীন মনোনীত করলাম[4]’’।





এ আয়াতে মহান আল্লাহ্ তাঁর মুমিন বান্দাদের উপর তার দয়া প্রদর্শনপূর্বক এটা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের দীন পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। সুতরাং আর কোন নবী এসে কোন সংযোজন বা বিয়োজন করার সুযোগ অবশিষ্ট নেই। তাই এ দীনের উপরই আমল করে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে[5]।





অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা আরও বলেনঃ








‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহ্‌র প্রতি, তাঁর রাসুলের প্রতি, তিনি যে কিতাব তাঁর রাসুলের প্রতি অবতীর্ণ করেছেন তার প্রতি এবং যেসব কিতাব তিনি আগে অবতীর্ণ করেছেন সেসবে ঈমান আন’’[6]।





এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমরা পূর্ববর্তী রাসূলগণের নিকট যে কিতাব নাযিল করা হয়েছে তার উপর ঈমান আন। কিন্তু এ কথা বলা হয়নি যে, পরবর্তীতে যা নাযিল হবে তার উপরও ঈমান আনিও। পক্ষান্তরে পূর্ববর্তী উম্মতদের থেকে আমাদের নবী ও তাঁকে প্রদত্ত কিতাব কুরআন অনুসরণের অঙ্গিকার নেয়া হয়েছিল। মহান আল্লাহ বলেনঃ





‘‘স্মরণ কর, যখন আল্লাহ্ নবীদের অংগীকার নিয়েছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু দিয়েছি তারপর তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রাসুল আসবে তখন তোমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে।’ তিনি বললেন, ‘তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অংগীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে?’ তারা বলল, ‘আমরা স্বীকার করলাম।’ তিনি বললেন, ‘তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সাথে সাক্ষী রইলাম’’[7]।





এ আয়াতে রাসূল বলে আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। সুতরাং তার উপর ঈমান আনয়ন করার জন্য সমস্ত নবী-রাসূলগণ আদিষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ অঙ্গিকার নেয়া হয়নি, কারণ তারপরে আর কোন নবী-রাসূল আসবে না।





1.2 নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি সংক্রান্ত পবিত্র হাদীস থেকে উদ্ধৃতিঃ





পবিত্র কুরআনে যে ভাবে স্পষ্টভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী ঘোষনা করা হয়েছে তেমনিভাবে বিভিন্ন হাদীসেও তা এসেছে। নিম্নে কয়েকটি বিখ্যাত হাদীস বর্ণনা করছিঃ





এক. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘আমার উম্মতের মধ্য থেকে অনেক মিথ্যাবাদির উদ্ভব ঘটবে যারা প্রত্যেকেই মনে করবে যে, সে নবী, অথচ আমি নবীদের শেষ, আমার পরে আর কোন নবী নেই[8]।’





দুই. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ ‘আমি নবীদের নেতা, গর্ব করে বলছি না। আমি শেষ নবী, গর্ব করে বলছি না। আমি প্রথম সুপারিশকারী এবং প্রথম যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে, এটাও গর্ব করে বলছি না।[9]’





তিন. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেনঃ ‘আমি হাজার হাজার নবীদের শেষ নবী। প্রত্যেক অনুসৃত নবীই তাদের উম্মতকে দাজ্জালের ভয় দেখিয়েছেন’[10]।





চার. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেনঃ ‘নবুওয়াত শেষ হয়ে গেছে তবে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রাপ্ত শুভসংবাদ বাকী রয়েছে [11]’।





পাঁচ. রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেনঃ ‘বনী ইসরাঈলদেরকে তাদের নবীরা শাসন করত। যখন কোন নবী মারা যেত তখনি অন্য নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতো। কিন্তু আমার পরে কোন নবী নেই। তবে অনেক খলীফা হবে আর তাদের সংখ্যাও বেশী হবে[12]।’





ছয়. তাছাড়া ‘আমার পরে আর কোন নবী নেই’ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উক্তি মুতাওয়াতির বা অকাট্যভাবে অগণিত অসংখ্য বর্ণনায় এসেছে[13]।





1.3 নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি প্রমাণকারী সাহাবা, তাবেয়ীন ও ইমামগণের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডঃ





· সাহাবায়ে কিরামগণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর নবুওয়তের দাবীদারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করেছিলেন।





· যে সমস্ত হাদীসে ‘খাতমে নবুওয়াত’ বা নবী-রাসূল প্রেরণের ধারার পরিসমাপ্তি সাব্যস্ত হয়েছে সেগুলো সাহাবাগণই বর্ণনা করেছেন।





· এ সমস্ত হাদীস অত্যন্ত অকাট্যভাবে এত অধিক হারে বর্ণিত হয়েছে যে, এখানে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না।





· যে সমস্ত সাহাবা থেকে হাদীসে ‘খাতমে নবুওয়াত’ সংক্রান্ত হাদীস বর্ণিত হয়েছে তাদের সংখ্যাঃ ৩৭ জনে দাঁড়িয়েছে[14]।





তাছাড়া উম্মতের সত্যনিষ্ঠ আলেমগণ এ ব্যাপারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন, নিম্নে এর কয়েকটি উদ্ধৃত করা হলোঃ





· ইমাম আবু হানিফা রাহেমাহুল্লাহর সময়ে এক ব্যক্তি নবুওয়তের দাবী করল এবং তার দাবীর সমর্থনে দলীল-প্রমাণাদি উত্থাপনের সুযোগ চাইল। তখন ইমাম আবু হানিফা রাহেমাহুল্লাহ বলেছিলেনঃ ‘যে কেউ তার থেকে তার নবুওয়তের সমর্থনে কোন দলীল-প্রমাণ পেশ করতে বলবে সে কাফের হয়ে যাবে; কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘আমার পরে কোন নবী নেই’[15]’। অর্থাৎ, নবুওয়তের দাবীদারদেরকে তাদের দাবীর সমর্থনে কোন প্রমাণ বা যুক্তি-তর্ক পেশ করারও সুযোগ দেয়া যাবে না; কারণ এটা আমাদের কুরআন ও হাদীসের সরাসরি বিপরীত কাজ।





· ইমাম আবু ইউসুফ রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘যদি কোন নবুওয়তের দাবীদার বের হয় এবং নবুওয়তের দাবী করে তখন যে কেউ তার কাছে তার দাবীর সমর্থনে প্রমাণ পেশ করতে বলবে, সে নিজেই কাফের হয়ে যাবে। কারণ, তখন সে সরাসরি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহকে অস্বীকার করেছে[16]’।





· ইমাম তাহাভী রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবীদের মধ্যে শেষ নবী, সমস্ত মুত্তাকীদের ইমাম এবং সমস্ত রাসূলদের নেতা। তাঁর পরে এ ধরনের যাবতীয় দাবী পথভ্রষ্টতা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ[17]’।





2. যুগে যুগে নবুওয়াতের দাবীদারদের উৎপাত





আগেই বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে ভন্ড নবীদের উত্থানের বিষয়ে পূর্বাহ্নেই সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পরে ত্রিশের মত মিথ্যুক, দাজ্জাল বা প্রতারক লোকের উদ্ভব না ঘটা পর্যন্ত কিয়ামত আসবে না, যাদের প্রত্যেকেই ধারনা করবে যে, সে আল্লাহ্র রাসূল[18]’।





রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বানী প্রমাণিত হয়েছে। যুগে যুগে ভন্ড নবীদের উত্থান ঘটেছে। নিম্নে তাদের উত্থান, পতন ও বিভিন্ন কর্মকান্ড সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।





2.1. ইসলামের প্রাথমিক যুগে ভন্ড নবীদের উত্থান





ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই ভন্ড নবীদের উত্থান শুরু হয়। সবপ্রথম যে সমস্ত ভন্ডের উৎপত্তি হয়েছিল তারা হলো, আল-আসওয়াদ আল-আনাসী, তুলাইহা ইবন খুয়াইলিদ, মুসাইলামাহ আল-কাযযাব এবং সাজাহ। নিম্নে তাদের প্রত্যেকের পরিচিত ও পরিণতি দেয়া হলো।





২.১.১ আল-আসওয়াদ আল-আনাসীঃ





তার নাম ছিল ‘আবহালাহ’ পিতার নাম কা‘ব[19]। সর্বদা পাগড়ী পড়া ও মুখ ঢাকা অবস্থায় থাকত। বিভিন্ন তেলেসমাতি দিয়ে মানুষদের ধোকা দিত। ইয়ামানের এক বিরাট অংশে সে তার প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হলো। একসময় মুসলমানগণ তার অনুসারীদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্জ থেকে ফিরে মদীনায় এসে এসব ঘটনা জানতে পারলেন। তিনি মুসলমানদেরকে এ ফেতনা রুখে দাড়ানোর নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ তার স্ত্রী (যিনি সত্যিকার ঈমানদার মহিলা ছিলেন) তার সহযোগিতায় তাকে হত্যা করলেন। তার সময়কাল ছিল মাত্র তিন মাস। মতান্তরে চার মাস। তার মৃত্যুর সাথে সাথে তার সাথীরা পুনরায় ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসতে শুরু করে[20]।





২.১.২ তুলাইহা ইবন্ খুয়াইলিদঃ





তার নাম তুলাইহা, পিতার নাম খুয়াইলিদ, গোত্র বনু আসাদ। সে আরবের সাহসী বীরদের অন্যতম ছিল। হিজরী নবম সনে সে বনু আসাদ গোত্রের প্রতিনিধিদের সাথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দেখা করতে আসে এবং তার স্বজাতির সাথে ইসলাম গ্রহণ করে। তারপর সে তার দেশে ফিরে গিয়ে নবুওয়তের দাবী করে বসে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিযুক্ত গভর্ণর দ্বারার ইবনুল-আযওয়ার তাকে আক্রমন করে কিন্তু তরবারী আঘাতে তার শরীরে কাজ করেনি। এটা দেখে মানুষের মধ্যে তার গুরুত্ব বেড়ে যায়। আরবের বনু আসাদ, গাতফান এবং ত্বাই গোত্রের অপরিনামদর্শী অনেকেই তার সাথী হয়ে যায়[21]। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যান।





আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খলীফা হয়ে তার বিরুদ্ধে খালেদ ইবন ওয়ালিদকে প্রেরণ করেন। সে যুদ্ধে তুলাইহা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে তার স্ত্রী সহ সিরিয়ায় পলায়ন করে। সেখানে থাকা অবস্থায় সে পুনরায় ইসলাম গ্রহণ করে এবং তার পরবর্তী জীবন ইসলামের ছায়াতলেই কাটিয়েছিল। পরবর্তীতে নাহাওয়ান্দের যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতা করেছিল এবং সে যুদ্ধেই শহীদ হয়েছিলেন[22]।





২.১.৩. মুসাইলামাহ আল কায্যাবঃ





তার নাম মুসাইলামাহ, পিতা সুমামাহ, গোত্র বনু হানিফা। নাজদের ইয়ামামাহ অঞ্চলের আল-আইনিয়্যাহ এলাকায় তার জন্ম। লোকেরা তাকে রাহমানুল ইয়ামামাহ বলত। হিজরী নবম সনে তার গোত্র বনু হানিফার সাথে সে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে হাজির হয়। সে তখন বলেছিল যে, মুহাম্মদ যদি আমাকে তার সাথে নবুওয়তে অংশীদার মেনে নেয় তবে আমি তার অনুসরণ করবো। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবেত ইবন কায়েস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে সাথে নিয়ে তার কাছে এক খন্ড গাছের ছোট ডাল নিয়ে এসে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ ‘যদি তুমি আমার কাছে এ কাঠটিও প্রত্যাশা কর, তাহলেও আমি তোমাকে তা দিব না। আল্লাহ্র নির্দেশ নবুওয়াত বা ওহী তোমার ভাগ্যে জুটবে না। যদি তুমি তোমার দেশে ফিরে যাও তবে তিনি (আল্লাহ) তোমাকে জবাই করবেন[23]।





ইয়ামামায় ফিরে গিয়ে মুসাইলামাহ মুরতাদ হয়ে যায় এবং নবুওয়তের দাবী করে বসে ও বিভিন্ন কথা মিথ্যা বানিয়ে বলতে আরম্ভ করে। তারপর দশম হিজরী সনে মদীনায় তার পক্ষ থেকে দূত প্রেরণ করে এবং তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে নবুওয়তের অংশীদার হিসেবে মেনে নেয়ার আহবান জানায়। তখন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উত্তরে লিখে পাঠিয়েছিলেন যে, ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমান, আল্লাহ্‌র রাসূল মুহাম্মাদ হতে মিথ্যুক মুসাইলামাহর প্রতি। যে হিদায়েত অনুসরণ করে তার প্রতি সালাম। তারপরঃ যমীনের মালিকানা আল্লাহ্রই। তিনি তার বান্দাদের মাঝে যাকে ইচ্ছা ওয়ারিশ বানান। আর শুভ পরিণাম শুধু মুত্তাকীদের জন্য।[24]’’





ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা গেলেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খলীফা নিযুক্ত হলেন। তিনি খালেদ ইবন ওয়ালীদ, ইকরিমা ইবন্ আবি জাহল এবং শুরাহবীল ইবন হাসানাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম এর নেতৃত্বে এক বিরাট বাহিনী প্রেরণ করলেন। তারা তার শক্তিকে ধ্বংস করতে সামর্থ হলেন। রাসূলের চাচা হামযা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে যিনি শহীদ করেছিলেন সেই ওয়াহশী পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি এ যুদ্ধে মুসাইলামাহকে হত্যা করেছিলেন।





তার মৃত্যুর সাথে সাথেই সমস্ত মানুষ দীন ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন করে। এটা ছিল হিজরী ১১ তম সনের ঘটনা[25]।





২.১.৪. সাজাহ বিন্ত হারিস





এ মহিলার পূর্ণ নাম, সাজাহ বিনত হারিস ইবন সুওয়াইদ ইবন উকফান। সে সিরিয়ার আরব্য গোত্র বনু তাগলিবের নাসারাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে সে নবুওয়াতের দাবী করে। তার গোত্রের লোকেরা তাকে সহযোগিতা করে। সে আশে পাশের অন্যান্য গোত্রের উপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সামর্থ হয়। এমনকি তার ক্ষমতায় ভীত হয়ে মুসাইলামাহ তার সাথে সন্ধির প্রস্তাব করে। সন্ধির মজলিসে মুসাইলামাহ তাকে বিয়ের প্রস্তাব করে এবং তার সাথে তিনদিন অবস্থান করে। তারপর সে বনু তাগলিবে অবস্থান করতে থাকে[26]।





পরবর্তীতে আমীরে মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করলে সে ইরাকের বাসরায় চলে যায় এবং সেখানে অবস্থান করে। অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে সে পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং সাহাবী সামুরাহ ইবন জুনদুব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার মৃত্যুর পর তার উপর জানাযার সালাত আদায় করেছিলেন[27]।





2.2. উমাইয়া ও আববাসী যুগে ভন্ড নবীদের উত্থান





উমাইয়া ও আববাসী যুগেও বেশ কয়েকজন নিজেদেরকে নবী বলে দাবী করেছিল। নিম্নে তাদের মধ্যে বিখ্যাতদের আলোচনা করা হলোঃ





2.2.1. আল-মুখতার





তার নামঃ আল মুখতার, পিতার নামঃ আবু উবাইদ ইবন্ মাসউদ। গোত্র বনু সাকীফ। তার পিতা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায়ই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু তিনি তাকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেননি। এ জন্য তাকে কেউ সাহাবী হিসেবে গণ্য করেনি। ইবনুল আসীর বলেনঃ তার পিতা ইসলামের খেদমতে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন এবং পারসিকদের সাথে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।





কিন্তু তার পুত্র মুখতার। সে প্রথমে নিজেকে শিয়াদের মতবাদে বিশ্বাসী বলে প্রচার করল। তারপর বলতে শুরু করল যে, তার কাছে জিবরীল ফিরিশ্তা আসে এবং তাকে জানিয়ে দেয়। এভাবে সে নবুওয়াতের দাবী করে বসে। শিয়া মতবাদের অনুসারীরা তার আনুগত্য করল। ফলে সে ভীষণ শক্তিশালী হয়ে ইরাকের কূফা নগরী দখল করে বসে। তখন আব্দুল্লাহ্ ইবন যুবাইর তার ভাই মুস‘আব ইবন্ যুবাইরকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হওয়ার পর হিজরী ৬৭ সনে সে চুড়ান্তভাবে পরাজিত ও নিহত হয়[28]।





2.2.2. আল-হারেস ইবন সা‘য়ীদ





তার নামঃ আল হারেস ইবন্ সা‘য়ীদ, দাস শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। দামেস্কে অবস্থান করত। সেখানে সে ইবাদত ও পরহেযগারীতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীতে সে পদস্খলিত হয়ে পড়ে। প্রাথমিক জীবনে তার অবস্থা এমন ছিল যে, তাকে দেখলে ও তার কথা শুনলে সবাই প্রভাবিত না হয়ে পারত না। ইতোমধ্যে সে বিভিন্নভাবে শয়তান কর্তৃক প্রতারিত হতে আরম্ভ করে। সে তার পিতার নিকট তার বিভিন্ন অবস্থা লিখে পাঠায় যে, আমাকে মনে হচ্ছে শয়তান কুপ্ররোচনা দিচ্ছে। কিন্তু তার পিতা তাকে এ ধারণা দিতে সক্ষম হয় যে, তুমি তো আবেদ মানুষ, তোমাকে শয়তান প্ররোচনা দিবে কেন? সুতরাং যা দেখছ তাই বলে বেড়ায়। এতে সে আরো বেশী উৎসাহী হয়ে যায় এবং নবুওয়তের দাবী করে বসে। খলীফা আব্দুল মালেক ইবন মারওয়ান তাকে ডেকে এনে আলেমদের মাধ্যমে অনেক উপদেশ দেয়। কিন্তু সে তার নবুওয়তের দাবী থেকে পিছপা হয়নি। তখন ৭৯ হিজরী সালে তিনি তাকে শুলে বিদ্ধ করে হত্যা করেন[29]।





2.2.3. বায়ান ইবন সাম‘আন





তার নামঃ বয়ান ইবন সাম‘আন। গোত্রঃ আন-নাহদী। তিনি বনী তামীমের লোক ছিলেন। হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষে সে নবওয়তের দাবী করে। তার অনুসারীদের ‘‘আল-বায়ানীয়্যাহ’’ বলা হতো[30]।





সে শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ছিল। তাই তার মধ্যে ইমাম নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা কাজ করছিল। তার মতে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর পুত্র ‘মুহাম্মাদ আল-হানাফীয়্যাহ’র পুত্র আবু হাশিম হলো হক্ক ইমাম। আবু হাশিমের মৃত্যুর পর ইমামত বা শিয়াদের নেতৃত্ব তার অর্থাৎ, বায়ান ইবন সাম‘আনের উপর অর্পিত হয়েছে। সে অদ্ভুত কিছু বিশ্বাসের অধিকারী ছিল। সে মনে করত যে, আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে আল্লাহ‌্‌র কিছু অংশ বর্তমান (নাউযুবিল্লাহ) সে হিসেবে এটি ধীরে ধীরে পুনর্জন্মবাদ মতবাদের মাধ্যমে তার (বয়ান ইবন্ সাম‘আনের) মধ্যেও সন্নিবেশিত হয়েছে। (নাউযুবিল্লাহ)। শেষ পর্যন্ত সে নবওয়তের দাবী করল।





সে যুগের ইরাকের বিখ্যাত গভর্ণর খালিদ ইবন্ আবদুল্লাহ আল-কাছরীকে তার সম্পর্কে জানানো হলো তিনি বিভিন্ন ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে তাকে পাকড়াও করতে সামর্থ হন। তিনি তাকে শুলে চড়িয়ে হত্যা করেন। কারও কারও মতে তাকে তিনি পুড়িয়ে মেরেছিলেন[31]।





2.2.4. আল-মুগীরাহ ইবন সা‘ঈদ আল-‘ইজলী





তার নামঃ আল-মুগীরাহ ইবন্ সা‘ঈদ। গোত্রঃ আল ‘ইজলী। সে কুফার অধিবাসী ছিল। ইরাকের গভর্ণর খালিদ ইবন আব্দুল্লাহ আল-কাছরীর দাস ছিল[32]।





নিজে শিয়া মতবাদে বিশ্বাসী হওয়ায় তার মধ্যে ইমাম হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সে প্রথমে দাবী করে বসল যে, মুহাম্মাদ ইবন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান ‘নাফসে যাকীয়্যাহ’ এর উত্তরসূরী ইমাম। কিছুদিন পর দাবী করে বসল যে, সে রাসূল এবং জিবরীল তার কাছে ওহী নিয়ে আসে। তাছাড়া আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে এমন সব বাজে মন্তব্য করতে লাগল যা কোন সুস্থ বিবেক মেনে নেয় না[33]।





ইরাকের গভর্ণর খালিদ ইবন্ আব্দুল্লাহ আল-কাছরী তার সম্পর্কে জানার পর তাকে পাকড়াও করলেন এবং তাকে আগুনে ঝাঁপ দিতে বললেন। কিন্তু সে তা করতে সমর্থ হলো না। এমতাবস্থায় তিনি তাকে ১১৯ হিজরী সনে হত্যা করেন[34]। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়[35]।





2.2.5. আবু মানসূর আল-‘ইজলী





লোকটি তার কুনিয়াত আবু মানসূর নামেই প্রসিদ্ধ। সেও আল-‘ইজলী গোত্রের লোক ছিল। কুফায় বসবাস করত। তবে সে মোটেই লেখাপড়া জানত না।





লোকটি শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ছিল। সে প্রথমে নিজেকে ‘আবু জা‘ফর মুহাম্মাদ ইবন আলী ইবন আল-হুসাইন ‘‘আল-বাকের’’এর খলীফা দাবী করত। পরবর্তীতে দাবী করল যে, আল-বাকের তাকে ইমামতের দায়িত্ব প্রদান করে গেছেন[36]।





তারপর সে ঘোষণা করল যে, রিসালতের ধারা সমাপ্ত হয়নি। আলী ইবন্ আবী তালেব একজন রাসূল। অনুরূপভাবে হাসান, হুসাইন এবং হুসাইনের সন্তানগণ সবাই রাসূল। তারপর যখন (তার ধারণা মতে) মুহাম্মাদ আল বাকের তাকে প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে সুতরাং সেও রাসূল। এরপর দাবী করল যে, জিবরীল তার কাছে ওহী নিয়ে আসে।





খলীফা হিশাম ইবন্ আবদুল মালিক এর খিলাফত কালে তার পক্ষ থেকে নিযুক্ত ইরাকের গভর্ণর ইউসুফ ইবন্ উমর আস-সাকাফী তাকে পাকড়াও করে এবং শুলের মাধ্যমে হত্যা করে[37]।





2.2.6. আবুল খাত্তাব আল-আসাদী





তার নামঃ মুহাম্মাদ ইবন্ আবি যয়নব[38]। কূফার বনী আসাদ গোত্রের দাস ছিল। সে ইমাম জা‘ফর সাদেকের মাযহাবের অনুসারী বলে নিজেকে পরিচয় দিত। কিন্তু ইমাম জা‘ফর সাদেক তার আচার-আচরণ সম্পর্কে অবগত হয়ে তার সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করেন[39]।





এতে সে রাগান্বিত হয়ে নিজেকে ইমাম ঘোষণা করে বসে। এভাবে পর্যায়ক্রমে সে নবুওয়তের দাবী করে এবং জান্নাত ও জাহান্নাম অস্বীকার করে বসে।





আববাসী খলীফা মানসূর তার সম্পর্কে জানার পর কূফার গভর্ণর ঈসা ইবন মূসাকে তাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিলেন। ঈসা ইবন মূসা তাকে গ্রেফতার ও হত্যা করলেন। মতান্তরে তিনি তাকে শুলে চড়িয়ে হত্যা করেন[40]।





2.2.7. আলী ইবন্ ফাদল আল-হিময়ারী





তার নামঃ আলী ইবন ফাদল ইবন আহমাদ আল-খানফারী আল-হিময়ারী[41]। শিয়া সম্প্রদায়ের লোক ছিল। সে হজ্জ ও কারবালায় হুসাইনের কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পর উবাইদুল্লাহ ইবন মাইমূন আল-কাদ্দাহ নামক কারামাতী (কিরমতী) সম্প্রদায়ের নেতার সাথে সাক্ষাত হয়। উবাইদুল্লাহ এ লোককে দেখেই বুঝতে পারল যে তাকে পথভ্রষ্টতায় খাটানো যাবে। সুতরাং সে তাকে ইয়ামেনে প্রতিনিধি নিযুক্ত করল।





ইয়ামেনে ফিরে আলী ইবন্ ফাদল নিজেকে বড় সূফী হিসেবে প্রকাশ করল। লোকেরা তার চারপাশে জড়ো হতে লাগল। এভাবে সে ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয় এবং ইয়ামনের বিরাট অংশ দখল করে নেয়। তারপর ‘সান‘আ’য় প্রবেশ করে সেখানকার এক মসজিদের মিম্বরে উঠে নিজেকে নবী হিসেবে দাবী করে এবং প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ইয়ামনবাসীগণ তার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠে এবং তাকে হত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোনভাবেই তারা এ কাজে সফল হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত একজন বিজ্ঞ ডাক্তার তার কক্ষে প্রবেশ করে তাকে হত্যা করল। আর সেটা ছিল ৩০৩ হিজরী সনের ঘটনা[42]।





3. পরবর্তীকালের নবুওয়তের দাবীদার





আববাসী যুগের শেষের দিকে মুসলমানদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়লেও নবুওয়তের দাবীদারদের সংখ্যা তখন উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে ছিল না। তারপর উসমানীয় তুর্কী খিলাফত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর নবুওয়তের দাবীদারদের পুনরুত্থান ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে তুর্কী খিলাফত অবসান হয়ে যাওয়ার পর এ ফিতনা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। ইসলামের প্রাথমিক যুগ এবং উমাইয়া ও আববাসীয় যুগের মিথ্যা নবুওয়তের দাবীদারদের শেষ পরিণতি এই ছিল যে, তারা তৎকালীন খলীফা বা গভর্ণরের হস্তক্ষেপে অবদমিত হয়। ফলে তাদের কোন অনুসারী অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু ১৯২৩ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিম খিলাফতের পতনের পর দীন বিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিকারের ধারা স্তব্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় মুসলমানগণ ক্ষোভ প্রকাশের মধ্যেই তাদের অধিকাংশ কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ রাখে। ফলে এ যুগে যারা নবুওয়তের মিথ্যা দাবী করেছিল তাদের দমন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।





 



Recent Posts

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 3

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 2

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 1