Articles

 





''কিন্তু সীমালংঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালংঘনকারীদেরকে ভালবাসেন না।'' [17]





রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ''তুমি নিজের জন্য যা পছন্দ কর অন্যের জন্যও তা করবে।''





ইসলামী মিডিয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতা পরিলক্ষিত হয়। যেমন আকীদার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কর্মের স্বাধীনতা। বিভিন্ন যোগাযোগ ও গণমাধ্যমের সাহায্যে মানুষ সাধারণতঃ তার স্বাধীনতা চর্চা করে থাকে। যেমন: বক্তৃতা-বিবৃতি, কবিতা, কিসসা-কাহিনী বর্ণনা ইত্যাদি। আর মানুষ তার মত অনুযায়ী নিজ নিজ আকীদার অনুশীলন করে। তবে এক্ষেত্রে জোর-জবরদস্তির কোনো স্থান নেই। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে অনেক আয়াত বিদ্যমান। যেমন:





﴿ لَآ إِكۡرَاهَ فِي ٱلدِّينِۖ ٢٥٦ ﴾ [البقرة: ٢٥٦]





''দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই।'' [18]





এছাড়া আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবীকে লক্ষ্য করে বলেন:





﴿ ۚ أَفَأَنتَ تُكۡرِهُ ٱلنَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُواْ مُؤۡمِنِينَ ٩٩ ﴾ [يونس: ٩٩]





''তবে কি আপনি মুমিন হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবেন?''[19]





সাহাবীগণ তাদের জীবনে স্বাধীন ও জবাবদিহীমূলক সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে গেছেন। যেমন: ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু 'আনহু যখন জেরুজালেম শহরের জন্য বিজয়ী মুসলিমদের সাথে নিয়ে শান্তি চুক্তি ও সন্ধি স্থাপন করতে গেলেন, তখন তিনি সেখানে দেখতে পেলেন ইয়াহূদীদের একটি মন্দির। আর তা মাটি দ্বারা ঢাকা ছিল এবং উপরের অংশটুকু দৃশ্যমান ছিল। তারপর তিনি অতিরিক্ত কাপড়সহ আসলেন। আর কিছু স্তুপীকৃত মাটি তুলে নিলেন। মুসলিম সৈন্যগণ তাঁকে অনুসরণ করতে লাগল। এভাবে মন্দিরটির ঢাকনা তুলে ফেলা হল এবং সেখানে ইয়াহূদীদের ধর্মীয় নিদর্শন প্রকাশ পেল।[20]





উক্ত সফরে নামাযের সময় উপস্থিত হল, মুসলিমগণ বায়তুল মাকদাস গীর্জার পাশে দাঁড়াতে চাইল। কিন্তু ওমর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু তাদেরকে বারণ করলেন। সেখানে নামায আদায় করতে তিনি তাদেরকে গীর্জা দূরবর্তী স্থানে নামায আদায় করতে আহ্বান জানান। অতঃপর তাকে বলা হল- সেখানে নামায আদায় বৈধ নয় কী? প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন- আমার আশংকা হল যে, এখানে নামায আদায় করলে পরবর্তীতে মুসলিমগণ গীর্জা ভেঙ্গে ফেলবে এবং সেখানে মসজিদ বানাবে। পরবর্তীতে জেরুজালেম ভ্রমণকারীগণ স্বাক্ষী দিয়েছেন যে, সে স্থানে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে যা মসজিদে ওমর ইবন্ খাত্তাব নামে পরিচিত। অতএব ওমরের আশংকা সঠিক ছিল। আর তিনি গীর্জার বাইরে অন্যত্র নামায আদায় করে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতার মূলনীতি বাস্তবায়ন করেছেন।





অনুরূপভাবে মহিলাদের মহর ধার্য নিয়ে ওমর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু এর মতামতের বিপক্ষে একজন নারী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। তার বক্তব্য ছিল কুরআনের আয়াতের অনুরূপ, তিনি (মহিলা) বলেছিলেন, ওমর কী ﴿ وَءَاتَيۡتُمۡ إِحۡدَىٰهُنَّ قِنطَارٗا ﴾ [النساء: ٢٠]আয়াত পড়নি? ওমর তুমি কি জান قنطار কী? তখন ওমর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু বললেন- মহিলার মত সঠিক এবং ওমরের মত ভুল। এভাবে স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতার উপর ভিত্তি করে ইসলামী মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।





গ. চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত





ইসলাম আকীদাহ, শরী'আত ও আখলাকের উপর প্রতিষ্ঠিত। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ মানুষের চরিত্র সংশোধনের নিমিত্তে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের চরিত্র সংশোধনের উদ্দেশ্যে প্রেরিত হয়েছেন। তিনি সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,





«إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق»





''নিশ্চয় আমি তোমাদের চরিত্রকে পূর্ণতাদানকারী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি।[21]''





উপর্যুক্ত হাদীসটি দীনের অন্যতম মূলনীতি। ইসলামী রাষ্ট্র সর্বদা এ মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। চারিত্রিক গুণাবলী রক্ষা করতে গিয়ে একজন মুসলিম কখনো অপর মুসলিমের সম্মান, সম্পদ ও রক্তহানি ঘটাতে পারে না। এ দিকে লক্ষ্য করেই মুসলিম জাহানের প্রথম খলিফা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু তাঁর সেনা নেতা ইয়াযিদ ইবন্ আবু সুফিয়ানকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন-





''তাদের (সেনাদের) উপর গোয়েন্দাগিরি করবে না, তাহলে তারা তোমাকে লাঞ্ছিত করবে। তাদের গোপন বিষয় প্রকাশ করবে না, প্রকাশ্যে যা আছে তা যথেষ্ট মনে করবে।''[22]





এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীসের বক্তব্যের অনুরূপ, তিনি বলেন:





«كل مسلم على المسلم حرام عرضه وماله ودمه»





“প্রতিটি মুসলিমের সম্মান, সম্পদ ও জান অপর মুসলিমের উপর হারাম"[23]।





আলোচ্য হাদীসে যে নির্দেশনাগুলো পাই সেগুলো মিডিয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামী মিডিয়া সর্বদা এসব অনুসরণ করে পরিচালিত হবে। মুসলিমগণের দোষ-ত্রুটি ও গোপন বিষয় অনুসন্ধানের চেষ্টা করবে না। গোয়েন্দাগিরি করবে না, বিনা প্রয়োজনে মানুষের দোষ অন্বেষণ করবে না। গীবত, চোগলখুরী ও অপবাদ দেয়া হতে বিরত থাকবে। এ মর্মে কুরআনে এসেছে-





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱجۡتَنِبُواْ كَثِيرٗا مِّنَ ٱلظَّنِّ إِنَّ بَعۡضَ ٱلظَّنِّ إِثۡمٞۖ وَ لَا تَجَسَّسُواْ وَلَا يَغۡتَب بَّعۡضُكُم بَعۡضًاۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا فَكَرِهۡتُمُوهُۚ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ تَوَّابٞ رَّحِيمٞ ١٢ ﴾ [الحجرات: ١٢]





''হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিকাংশ অনুমান হতে দূরে থাক; কারণ কোনো কোনো অনুমান পাপ এবং তোমরা একে অন্যের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না এবং একে অন্যের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে চাইবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণ্যই মনে কর। আর তোমরা আল্লাহ্র তাকওয়া অবলম্বন কর; নিশ্চয় আল্লাহ্ তওবা গ্রহণকারী, পরম দয়ালু।'' [24]





এছাড়াও কোনো সংবাদ প্রাপ্ত হলে তার সত্যতা যাচাই করা ব্যতীত প্রচার না করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন-





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ أَن تُصِيبُواْ قَوۡمَۢا بِجَهَٰلَةٖ فَتُصۡبِحُواْ عَلَىٰ مَا فَعَلۡتُمۡ نَٰدِمِينَ ٦ ﴾ [الحجرات: ٦]





''হে ঈমানদারগণ! যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন বার্তা নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখ, এ আশঙ্কায় যে, অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে।'' [25]





উপরোক্ত আয়াত, হাদীস ও আবু বকর রাদিয়াল্লাহু 'আনহু-এর অছিয়াত থেকে আমরা যা পাই তা ইসলামী মিডিয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর এতে মানুষের গোপন বিষয় প্রকাশ না করা, গোয়েন্দাগিরি না করা, প্রয়োজন ব্যতীত প্রকাশমান বিষয়কে যথেষ্ট মনে করার দিকে আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত যেসব খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, বুকলেট আমরা পড়ি এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাহায্যে আমরা যা দেখি তা উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নয়। বিশেষ করে উচ্চ শ্রেণী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এসব বিষয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে ইসলাম মিডিয়াকে এসব খারাপ গুণাবলী পরিহার করে বড় মনের পরিচয় দিয়ে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানে ভূমিকা রাখতে নির্দেশ করে।





ঘ. আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বব্যাপী





মিডিয়ার কাজ হলো বিশ্বের সকল মানুষের কাছে সংবাদ পরিবেশন করা; আর ইসলামী মিডিয়ার লক্ষ্য হলো বিশ্বের সর্বসাধারণের কাছে সত্য ও সঠিক সংবাদ পৌঁছানো যা সাধারণের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়।[26]





ইসলামী মিডিয়া সর্বদা দয়াপরবশ হয়ে দা'ওয়াতী চরিত্র নিয়ে বিশ্বব্যাপী আহ্বান জানায়। এদিকে ইঙ্গিত করেই মহান আল্লাহ বলেন,





﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧ ﴾ [الانبياء: ١٠٧]





''আর আমি তো আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য শুধু রহমতরূপেই পাঠিয়েছি।'' [27]





অতএব, রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রহমত উৎসর্গ করা হয়েছে। আর তাবলীগ বা প্রচারের শর্ত হলো উত্তম কথা। এ মর্মে কুরআনের নির্দেশনা হলো:





﴿ ٱدۡعُ إِلَىٰ سَبِيلِ رَبِّكَ بِٱلۡحِكۡمَةِ وَٱلۡمَوۡعِظَةِ ٱلۡحَسَنَةِۖ وَجَٰدِلۡهُم بِٱلَّتِي هِيَ أَحۡسَنُۚ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعۡلَمُ بِمَن ضَلَّ عَن سَبِيلِهِۦ وَهُوَ أَعۡلَمُ بِٱلۡمُهۡتَدِينَ ١٢٥ ﴾ [النحل: ١٢٥]





''আপনি মানুষকে দা'ওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়। নিশ্চয় আপনার রব, তাঁর পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়েছে, সে সম্বন্ধে তিনি বেশী জানেন এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি ভালভাবেই জানেন।'' [28]





কুরআনের অন্যত্র এসেছে:





﴿ وَقُولُواْ لِلنَّاسِ حُسۡنٗا ٨٣ ﴾ [البقرة: ٨٣]





''মানুষের সাথে সদালাপ করবে।'' [29]





রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশেদীনের দা'ওয়াতী মিশন বিশ্বের সকল মানুষের প্রতি নিবিষ্ট ছিল। আর এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ইসলামী মিডিয়া আন্তর্জাতিক ও বিশ্বব্যাপী তাত্ত্বিক ও ফলিত উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামী দা'ওয়াহ প্রচারের লক্ষ্যে বিভিন্ন সাহাবীকে বিশ্বের অন্যান্য ভাষা শিখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি যায়দ ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু 'আনহু কে সুরিয়ানী ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। অতএব, এ নির্দেশনা ইসলামী মিডিয়া আন্তর্জাতিক হওয়ার পথকে সুগম করেছে।[30]





এছাড়াও মুসলিম সর্ববৃহৎ সম্মেলন যা প্রত্যেক বছর হজ্বের সময় অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে বিশ্বের সকল দেশের মুসলিমগণ একত্রিত হন, যদিও তাদের ভাষা, বর্ণ, অঞ্চল ভিন্ন। আর সেখানে ইসলামের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলী ও অনুপস্থিতদের জন্য নির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করা হয়।





গ. ইসলামী মিডিয়ার ভিত্তিসমূহ





প্রত্যেক বিষয়ের একটি ভিত্তি থাকে। খুঁটি ছাড়া যেমন কোনো ভবন হয় না, তদ্রুপ ইসলামী মিডিয়াও কতিপয় ভিত্তি ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। যেসব মৌলিক নীতিমালার উপর ভিত্তি করে ইসলামী মিডিয়া পরিচালিত হবে, তা-ই ইসলামী মিডিয়ার ভিত্তি। নিম্নে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিসমূহ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা প্রদত্ত হলো:





এক. ঈমান





ইসলামী মিডিয়া এক আল্লাহর উপর ঈমান আনয়নকে আবশ্যক করে। ফলে একনিষ্ঠ তাওহীদ মানব জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর। কেননা এটি উলুহিয়াত ও ইবাদততত্ত্বের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করে। এছাড়াও এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা ও বান্দার মাঝে সম্পর্কের প্রকৃত অবস্থা এবং জগত ও জীবনের অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। অনুরূপভাবে ফিরিশতা, আসমানী কিতাব, রিসালাত, পরকাল, তাকদীর প্রভৃতির প্রতি বিশ্বাস রেখে এ মিডিয়া পরিচালিত হবে। কেননা ঈমান আনয়নের পর ঈমানের উপর অটল-অবিচল থাকা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন,





﴿ فَٱسۡتَقِمۡ كَمَآ أُمِرۡتَ وَمَن تَابَ مَعَكَ وَلَا تَطۡغَوۡاْۚ إِنَّهُۥ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ١١٢ وَلَا تَرۡكَنُوٓاْ إِلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ فَتَمَسَّكُمُ ٱلنَّارُ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِنۡ أَوۡلِيَآءَ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ ١١٣ ﴾ [هود: ١١٢، ١١٣]





''কাজেই আপনি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছেন তাতে অবিচল থাকুন এবং আপনার সাথে যারা তাওবা করেছে তারাও; এবং তোমরা সীমালংঘন করো না। তোমরা যা কর নিশ্চয় তিনি তার সম্যক দ্রষ্টা। আর যারা যুলুম করেছে তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; পড়লে আগুন তোমাদেরকে স্পর্শ করবে। এ অবস্থায় আল্লাহ্ ছাড়া তোমাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। তারপর তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না।'' [31]





এছাড়াও হাদীসে এসেছে,





عن سفيان بن عبد الله الثقفي قال قلت يا رسول الله قل لي في الإسلام قولا لا أسئل عنه أحدا بعدك قال«قل آمنت بالله فاستقم»





''সুফিয়ান ইবন আব্দুল্লাহ আস্-সাকাফী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম 'আমাকে ইসলামের' এমন বিষয়ে বলুন, যার পরে আর কাউকে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করতে হবে না। তিনি সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি বল! আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি, অতঃপর তার উপর দৃঢ় থাক।''[32]





রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপরোক্ত বাণীটি পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের অনুরূপ। মহান আল্লাহ বলেন-





﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ قَالُواْ رَبُّنَا ٱللَّهُ ثُمَّ ٱسۡتَقَٰمُواْ فَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١٣ ﴾ [الاحقاف: ١٣]





''নিশ্চয় যারা বলে, 'আমাদের রব আল্লাহ্' তারপর অবিচল থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।'' [33]





দুই. জ্ঞান





الإعلام (ই'লাম) ও تعليم (তা'লীম) শব্দদ্বয় একই মূল থেকে উদগত। তবে الإعلام(ই'লাম) দ্রুত সংবাদ পরিবেশনের সাথে নির্দিষ্ট। আর تعليم (তা'লীম) পূণরাবৃত্তি ও অধিকের সাথে সম্পৃক্ত যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর অন্তরে প্রভাব সৃষ্টি হয়।[34]





অতএব الإعلام (ই'লাম) ও تعليم (তা'লীম) শব্দদ্বয় যোগাযোগের রূপ বা আকৃতি। প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। আর উভয়ে ইলম এবং মা'আরেফাতের দিকে মুখাপেক্ষী।[35]





ইসলামী মিডিয়া উপরোক্ত প্রশাখার উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃত অবস্থা ও লক্ষ্যের দৃষ্টিতে উভয়টি একই। আল্লাহ তা'আলা বলেন,





﴿ فَٱعۡلَمۡ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ وَٱسۡتَغۡفِرۡ لِذَنۢبِكَ ۡ ١٩ ﴾ [محمد: ١٩]





''কাজেই জেনে রাখুন যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। আর ক্ষমা প্রার্থনা করুন আপনার ত্রুটির জন্য।'' [36]





ইমাম বুখারী রাদিয়াল্লাহু 'আনহু স্বীয় গ্রন্থ সহীহ বুখারীতে আলোচ্য আয়াত দিয়ে একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। যার নাম হল (باب العلم قبل القول والعمل) ''কথা ও কাজের পূর্বে জ্ঞান''। অতএব علم (ইলম) দ্বারা তিনি শুরু করেছেন যা সৎকাজের (আমালে সালিহ) মূলনীতি। আর 'আমালে সালিহ হল মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড। আল্লাহ বলেন:





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣ ﴾ [الحجرات: ١٣]





''হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই বেশী মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশী তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।'' [37]





অতএব, তাকওয়া হল 'আমালে সালিহ'-এর ফল। ফলে إعلام (ই'লাম) বা মিডিয়া প্রকৃত অর্থে জ্ঞান ও শিক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত।





ইসলামী মিডিয়ার ক্ষেত্রে জ্ঞানের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশী। কারণ ইসলাম আল্লাহর নিকট হতে প্রবর্তিত এক পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ঐশী জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রচার-প্রসারে ব্রতী হয়েছেন। যেহেতু এ মিডিয়া ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত থাকে, সেহেতু ইসলামের খুঁটি-নাটি সব বিষয়ে সুস্পষ্ট জ্ঞান লাভ অত্যাবশ্যক। এছাড়াও বিভিন্ন ভাষা সম্পর্কেও মিডিয়া কর্মীদের ধারণা থাকতে হবে। তাহলেই মিডিয়ার সার্বজনীন বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন ভাষা শিখতে সাহাবীদের উদ্বুদ্ধ করতেন। প্রত্যেক জাতির নিকট প্রেরিত সকল নবী-রাসূল স্বজাতীয় ভাষা নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন,





﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوۡمِهِۦ لِيُبَيِّنَ لَهُمۡۖ فَيُضِلُّ ٱللَّهُ مَن يَشَآءُ وَيَهۡدِي مَن يَشَآءُۚ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٤ ﴾ [ابراهيم: ٤]





''আর আমরা প্রত্যেক রাসূলকে তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য, অতঃপর আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে বিভ্রান্ত করেন এবং যাকে ইচ্ছে সৎপথে পরিচালিত করেন এবং তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।'' [38]





অতএব, ভাষাজ্ঞান, অলঙ্কারিত্ব, যোগাযোগ মাধ্যম, স্পষ্ট ও অস্পষ্টতার মধ্যকার অর্থ উদঘাটনের জ্ঞান প্রভৃতি ইসলামী মিডিয়া কর্মীদের জন্য অত্যন্ত জরুরী। ফলে জ্ঞান ব্যতীত এ মিডিয়া কল্পনা করা অমুলক।





তিন. মানবিকতা





ইসলামী মিডিয়া ব্যাপকার্থে মানুষের স্বভাবজাত প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেয়। কেননা শরীর, রূহ ও 'আকল এ তিনের সমন্বয়ে মানব প্রকৃতি গঠিত। আল্লাহ তা'আলা সর্বোত্তমভাবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাতে রূহ প্রবেশ করিয়েছেন। আল্লাহ বলেন,





﴿ لَقَدۡ خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ فِيٓ أَحۡسَنِ تَقۡوِيمٖ ٤ ﴾ [التين: ٤]





''অবশ্যই আমরা সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে।'' [39]





কুরআনের অন্যত্র এসেছে,





﴿ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ بِٱلۡحَقِّ وَصَوَّرَكُمۡ فَأَحۡسَنَ صُوَرَكُمۡۖ وَإِلَيۡهِ ٱلۡمَصِيرُ ٣ ﴾ [التغابن: ٣]





''তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমানসমূহ ও যমীন যথাযথভাবে এবং তোমাদেরকে আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর তোমাদের আকৃতি করেছেন সুশোভন। আর ফিরে যাওয়া তো তাঁরই কাছে।'' [40]





ইসলামী মিডিয়া সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টিকারী স্রষ্টার ইবাদত করার জন্য বান্দার সাথে আল্লাহর এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সৃষ্টি করে থাকে। কেননা মানুষ সৃষ্টির মূলে স্রষ্টার একমাত্র উদ্দেশ্য হল তাঁর (আল্লাহ) ইবাদত। এ প্রসঙ্গে কুরআনে এসেছে,





﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ ﴾ [الذاريات: ٥٦]





''আর আমি সৃষ্টি করেছি জ্বিন এবং মানুষকে এজন্যই যে, তারা কেবল আমার ইবাদাত করবে।'' [41]





আর মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে ভাতৃত্ববোধের উপর পারস্পরিক কল্যাণ কামনা, ন্যায়বিচার ও ইহসান-এর ভিত্তিতে। মহান আল্লাহ এদিকে ইঙ্গিত করেই বলেন,





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ إِنَّا خَلَقۡنَٰكُم مِّن ذَكَرٖ وَأُنثَىٰ وَجَعَلۡنَٰكُمۡ شُعُوبٗا وَقَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوٓاْۚ إِنَّ أَكۡرَمَكُمۡ عِندَ ٱللَّهِ أَتۡقَىٰكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٞ ١٣ ﴾ [الحجرات: ١٣]





''হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, আর তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তিই বেশী মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে বেশী তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত।'' [42]





কুরআনের অন্যত্র এসেছে,





﴿ وَقُولُواْ لِلنَّاسِ حُسۡنٗا ٨٣ ﴾ [البقرة: ٨٣]





''আর মানুষকে উত্তম কথা বল।'' [43]





অতএব, ইসলামী মিডিয়ার অন্যতম কাজ হল উত্তম কথা বা বক্তব্য উপস্থাপন। তবে এটি তখনই নিশ্চিত হবে উত্তম বলে, যদি তা ইনসাফপূর্ণ ও সত্য বক্তব্য হয়। ইনসাফ প্রতিষ্ঠার প্রতি আহ্বান জানিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا يَجۡرِمَنَّكُمۡ شَنََٔانُ قَوۡمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعۡدِلُواْۚ ٱعۡدِلُواْ هُوَ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ ٨ ﴾ [المائدة: ٨]





''হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্য দানে তোমরা অবিচল থাকবে; কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদেরকে যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করবে, এটা তাক্ওয়ার কাছাকাছি। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ্ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।''[44]





এ পৃথিবীতে যত সৃষ্টি আছে সবই মানব কল্যাণে নিয়োজিত। মহান আল্লাহ অধিকাংশ সৃষ্টিকে মানুষের অধীন করে দিয়েছেন, যেন তা মানুষের কল্যাণে আসে। প্রাণীকুল, জীবজন্তু, মাটির উপর উদগত গুল্ম- সবকিছু সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করে একমাত্র মানুষ, যাতে তা নিজেদের উপকারে কাজে লাগানো যায়। মহান আল্লাহ বলেন,





﴿ أَلَمۡ تَرَوۡاْ أَنَّ ٱللَّهَ سَخَّرَ لَكُم مَّا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِ ﴾ [لقمان: ٢٠] ''তোমরা কি দেখো না? নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে।'' [45]





ইসলামী মিডিয়া মানুষের পারস্পরিক উপরোক্ত সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টি রেখেই জীবন, জগৎ, আখেরাত প্রভৃতির প্রভূত কল্যাণ সাধনে ব্রতী হয়। তবে এক্ষেত্রে যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় এটা মূলতঃ আল্লাহর সুন্নাহর অন্তর্গত। তিনি কাউকে কাফির আবার কাউকে মু'মিন হিসেবে এ সমাজে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মানবিকতা বিচারে প্রত্যেকেই তাঁর আলো, বাতাস, অক্সিজেনসহ নি'আমতরাজি ভোগ করছে। আল্লাহ বলেন:





﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ فَمِنكُمۡ كَافِرٞ وَمِنكُم مُّؤۡمِنٞۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٌ ٢ ﴾ [التغابن: ٢]





''তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে কতক কাফির এবং কতক মুমিন। আর তোমরা যে আমল করছো আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।'' [46]





ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহু বলেন- নিশ্চয় মানুষের পূর্ণতার পরিধি দু'টি মূলের উপর। বাতিল থেকে হককে জানা। হক বাস্তবায়ণ করা। সৃষ্টির স্থান সম্পর্কে যে ভিন্ন রূপ আল্লাহর নিকট দুনিয়া ও আখেরাতে পরিলক্ষিত হয় তা একমাত্র দু'টি মূলের ভিন্নতার কারণে তাদের মর্যাদায় হয়ে থাকে। আর উভয়টিকেই অনুগ্রহ করে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবীগণকে দিয়েছেন। তিনি বলেন,





﴿وَٱذۡكُرۡ عِبَٰدَنَآ إِبۡرَٰهِيمَ وَإِسۡحَٰقَ وَيَعۡقُوبَ أُوْلِي ٱلۡأَيۡدِي وَٱلۡأَبۡصَٰرِ ٤٥ ﴾ [ص: ٤٥]





''আর স্মরণ করুন, আমাদের বান্দা ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়া'কূবের কথা, তাঁরা ছিলেন শক্তিশালী ও সূক্ষ্মদর্শী।'' [47]





আলোচ্য আয়াতে الأيدي বলতে সত্য বাস্তবায়নের শক্তি-সামর্থকে বুঝানো হয়েছে। الأبصار বলতে দ্বীনের ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি দানকে বুঝায়। অতএব, এগুলো দ্বারা হককে পরিপূর্ণ পাওয়া ও তা বাস্তবায়নকে বুঝায়। এক্ষেত্রে মানুষকে চারভাগে বিভক্ত করা যায়। উপরোক্ত শাখাটি সৃষ্টির মধ্যে সর্বোত্তম শাখা হিসেবে বিবেচিত।





দ্বিতীয়ত: উপরোক্ত শাখার বিপরীত যার দ্বীনের ব্যাপারে কোনো দূরদৃষ্টি নেই এবং হক বাস্তবায়নের কোনো ক্ষমতা নেই। এ প্রকারের মধ্যে সৃষ্টির অধিকাংশ মানুষ অন্তর্ভুক্ত।





তৃতীয়ত: তাদের দীনের ব্যাপারে অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে এবং জ্ঞানও আছে। কিন্তু তার (দীনের) প্রতি আহ্বান জানানোর বা হক বাস্তবায়নের কোনো শক্তি নেই। এ স্তরে দুর্বল মুমিনগণ অন্তর্ভুক্ত।





চতুর্থত: যাদের শক্তি ও সাহস উভয়টি রয়েছে। কিন্তু দীনের কোনো জ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি নেই। তারা রহমানের বন্ধু ও শয়তানের বন্ধুর মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না। তাদের দৃষ্টিতে সবাই সমান।[48]





তবে উপর্যুক্ত প্রথম প্রকারকেই মহান আল্লাহ নেতৃত্বের জন্য মনোনীত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,





﴿ وَجَعَلۡنَا مِنۡهُمۡ أَئِمَّةٗ يَهۡدُونَ بِأَمۡرِنَا لَمَّا صَبَرُواْۖ وَكَانُواْ بَِٔايَٰتِنَا يُوقِنُونَ ٢٤ ﴾ [السجدة: ٢٤]





''আর আমরা তাদের মধ্য থেকে বহু নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমাদের নির্দেশ অনুসারে হেদায়াত করত; যেহেতু তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল। আর তারা আমাদের আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাস রাখত।'' [49]





ইমাম কুরতুবী রাহেমাহুল্লাহ্ বলেন: جعلنا منهم أئمة অর্থাৎ নেতা সৃষ্টি যাদের আনুগত্য করা হয়। আর তারা হলো নবীগণ 'আলা্ইহিমুস সালাম। তাঁরা হককে বাতিলের উপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তারাই মডেল বা অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। কেননা তারা মানুষের সাথে প্রকৃত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও সহজাত প্রবৃত্তি, আল্লাহর উলুহিয়াত, রুবুবিয়াত প্রভৃতির প্রকৃত অর্থ নিয়ে আহ্বান জানিয়েছেন।[50]





চার. সামাজিকতা





রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে ইসলাম মানব জীবনের সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে। অতএব, ইসলাম আকীদা, শরী'আত ও জীবন পদ্ধতির নাম। মানুষের বিভিন্ন কর্মতৎপরতা ও তার পরিধি যুগে যুগে একটি দীনের প্রতি মুখাপেক্ষী ছিল; যাতে তাদের লক্ষ্য ও উত্তম উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট হয় এবং বিধিসম্মত পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বনে সচেষ্ট হয়। আল্লাহ তা'আলা নবী-রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন,





﴿ لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَا رُسُلَنَا بِٱلۡبَيِّنَٰتِ وَأَنزَلۡنَا مَعَهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡمِيزَانَ لِيَقُومَ ٱلنَّاسُ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَأَنزَلۡنَا ٱلۡحَدِيدَ فِيهِ بَأۡسٞ شَدِيدٞ وَمَنَٰفِعُ لِلنَّاسِ ﴾ [الحديد: ٢٥]





''অবশ্যই আমরা আমাদের রাসূলগণকে পাঠিয়েছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাদের সংগে দিয়েছি কিতাব ও ন্যায়ের পাল্লা, যাতে মানুষ সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে। আমরা আরও নাযিল করেছি লোহা যাতে রয়েছে প্রচণ্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ।'' [51]





শায়খুল ইসলাম ইবন্ তাইমিয়্যা রাহেমাহুল্লাহ্ বলেন, كتاب (কিতাব) দ্বারা 'ইলম ও দীন প্রতিষ্ঠিত হয় আর ميزان (মীযান) দ্বারা হকসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়। আর হাদীদ কাফির ও মুনাফিকদের ব্যাপারে حد প্রতিষ্ঠা করে।[52]





কুরআন ও হাদীসে নেতার আনুগত্য করাকে ওয়াজিব করা হয়েছে। সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎকাজে নিষেধ করা, জিহাদ, ন্যায় বিচার, ঐক্যবদ্ধ থাকা, হজ্ব, ঈদ উদযাপন ও অপরাধের শাস্তি বিধান করা নেতৃত্ব ব্যতীত সম্ভব নয়। আর নেতার আনুগত্য করা ওয়াজিব ও তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য অর্জিত হয়।[53]





হাদীসে এসেছে রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





«نضر الله أمرأ سمع منا حديثا فحفظه حتى يبلغه غيره فإنه رب حامل فقه ليس بفقيه ورب حامل فقه إلى من هو أفقه منه ثلاث خصال لا يغل عليهن قلب مسلم أبدا إخلاص العمل لله ومناصحة ولاة الأمر ولزوم الجماعة فإن دعوتهم تحيط من ورائهم»





''আল্লাহ তাকে সমুজ্জল করুন যে আমার কোনো হাদীস শুনেছে অতঃপর তা অন্যের নিকট পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সংরক্ষণ করে। আর এমন কতক সংরক্ষণকারী আছে যারা ফকীহ নয়, আবার এমন অনেক আছেন যারা তাদের থেকে অধিক জ্ঞানী লোকদের মুখাপেক্ষী। তিনটি স্বভাব যা থেকে মুমিনের অন্তর বিচ্যুত হয় না তা হলো, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য কাজ করা, নেতৃবৃন্দের জন্য নসীহত, জামাতবদ্ধ হওয়া। নিশ্চয় তাদের দো'আ তাদেরকে বেষ্টন করে আছে।'' [54]





মুসলিম সমাজে ইসলামী মিডিয়া ব্যবস্থাপনা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার একটি অংশ বিশেষ। আর এটা স্বাধীন ও জবাবদিহীমূলক ব্যবস্থা যা শরী'আতের নিয়ম নীতি দ্বারা অর্থনৈতিক আন্দোলনকে এবং আধুনিক মানব রচিত ব্যবস্থার বিপরীতে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা উন্নয়ন করে।[55]





মুসলিম সমাজের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে ইসলামী মিডিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয়। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, শরী'আত ও জীবন প্রণালীকে ঠিক রেখে ইসলামী রাজনৈতিক জীবনকে সামঞ্জস্যমণ্ডিত করার ক্ষেত্রে মিডিয়া অবদান রাখতে পারে। ইসলামী মিডিয়ার লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধান, অনুরূপভাবে ইসলামী রাজনীতির উদ্দেশ্যও তাই। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পাশাপাশি মানবকল্যাণ সাধন এর লক্ষ্য। অতএব, সামাজিক ভিত্তির উপর এ মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়।





পাঁচ. কার্যক্ষমতা ও প্রায়োগিকতা





ইসলামী মিডিয়া শুধুমাত্র তাত্ত্বিক কোন পদ্ধতি ও চিন্তাপ্রসূত নয়। বরং একে প্রায়োগিক ও ফলিত কার্য হিসেবে ধরা হয়। মিডিয়া কর্মীর সম্বোধন ও প্রচার মাধ্যমসমূহ পরিপূর্ণরূপে লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতঅর্থে মিডিয়া সংগঠন এক সংস্থার নাম যা সৃজনশীল সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রযুক্তি। আর এটি নিম্নের ভিত্তিসমূহের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন:





এক. যোগাযোগের মাধ্যমে মিডিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। মিডিয়া গবেষকগণের অধিকাংশের ঐকমত্যে মিডিয়া কর্মের উপর যোগাযোগের একটা প্রভাব থাকে।[56]





তবে একজন ইসলামী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব কার্যগত ও প্রায়োগিক ভিত্তিকে আবশ্যক করা যথেষ্ট মনে করবে না; বরং এটা আরো কিছু বিষয়ের দিকে সম্বন্ধযুক্ত হবে।





ক. কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার ভিত্তিকে মূল্যায়ন করা। আর এটা জাতির চিন্তা-চেতনা ও প্রিয় সাংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে।





খ. সত্যবাদিতা ও সংবাদ সংগ্রহে অবিচল থাকা। যেমন আল্লাহর বাণী,





﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِن جَآءَكُمۡ فَاسِقُۢ بِنَبَإٖ فَتَبَيَّنُوٓاْ أَن تُصِيبُواْ قَوۡمَۢا بِجَهَٰلَةٖ فَتُصۡبِحُواْ عَلَىٰ مَا فَعَلۡتُمۡ نَٰدِمِينَ ٦ ﴾ [الحجرات: ٦]





''হে ঈমানদারগণ! যদি কোন ফাসিক তোমাদের কাছে কোন বার্তা নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখ, এ আশঙ্কায় যে, অজ্ঞতাবশত তোমরা কোন সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে বসবে, ফলে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে।'' [57]





নিশ্চয় আল্লাহর সাথে, আত্মার সাথে এবং মানুষের সাথে সত্যবাদিতা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতার কারণ। এ সম্পর্কে রাসূলের একটি হাদীস প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন,





«إن الصدق يهدي إلى البر وأن البر يهدي إلى الحنة - وإن الرجن ليصدق حتى يكتب عن يديه صدقا وإن الكذب يهدي إلى الفجور وإن الفجور يهدي إلى النار وإن الرجل ليكذب حتى يكتب عنه كذابا»





নিশ্চয়ই সত্যবাদিতা পূন্যের পথ উম্মুক্ত করে। আর পূন্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। কোন ব্যক্তি যখন সত্য কথা বলতে থাকে এবং সত্য কথা বলার চেষ্টা অব্যহত রাখে তখন এভাবে এক সময় আল্লাহর নিকট সে সত্যবাদী বলে লিখিত হয়ে যায়। আর তোমরা মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকবে। কেননা মিথ্যা পাপের পথ দেখায়। আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর কোন ব্যক্তি যখন মিথ্যা বলতে থাকে এবং মিথ্যা বলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে তখন এক সময় সে আল্লাহর নিকট মিথ্যাবাদি বলেই লিপিবদ্ধ হয়।[58]





গ. সময় ও পরিবেশ বিবেচনায় আনা।





ঘ. মিডিয়া কর্মের অলংকারিত্ব।[59]



Recent Posts

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 3

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 2

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 1