Articles

মূল: ফায়িয বিন সাঈদ আয-যাহরানী





অনুবাদ: ইকবাল হোছাইন মাছুম





 সূরা কাফিরূন ও ইখলাস আমাদের যা শেখায়





১.  বল, হে কাফিররা,





২.  তোমরা যার ইবাদাত কর আমি তার ইবাদাত করি না।





৩.  এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও।





৪.  আর তোমরা যার ইবাদত করছ আমি তার ইবাদাতকারী হব না।





৫.  আর আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী হবে না।





৬. তোমাদের জন্য তোমাদের দীন আর আমার জন্য আমার দীন।





১.       বল, তিনিই আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়।





২.       আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন।





৩.      তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।





৪.       আর তাঁর কোন সমকক্ষও নেই।





সূরাদ্বয়ের ফযিলতে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে, এ ক্ষেত্রে বোধ করি এতটুকু বলাই যথেষ্ট হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দিন শুরু করতেন এ সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের মাধ্যমে আর সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের মাধ্যমেই শেষ করতেন দিন। কারণ তিনি অধিকাংশ সময়  ফজরের সুন্নাত ও সালাতুল বিতরে এ সূরাদু’টো তেলাওয়াত করতেন। রমযান মাসে পৃথিবী ব্যাপি মসজিদগুলোতে এ সূরাদ্বয়ের তেলাওয়াতের গুঞ্জরণ চারিদিক মুখরিত করে তুলে। সূরা কাফিরূন দ্বীপ্ত ঘোষণা উচ্চারণ করে যে, তাওহিদ ও শিরকের আকিদার মাঝে কোনোরূপ সামঞ্জস্য নেই। উভয় আকিদার মাঝে ন্যূনতম সাদৃশ্যকেও এ সূরা প্রত্যাখ্যান করে। আর সূরা ইখলাস তাওহিদের আকিদাকে দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিত করে। এ দিক থেকে উভয় সূরাই তাওহিদের নিগুঢ় তত্ত্বকে প্রমাণ করে সুস্পষ্টরূপে। (তাফসির ফী যিলালিল কোরআন ৬/৪০০৫)





চলমান নিবন্ধে আমরা ‌‌ ‍‌‌‌'আল-কোরআনের প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও তার রূপরেখা’র আলোকে কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় উৎসারিত করে নিবন্ধটি কয়েকটি পর্বে সাজাতে চেষ্টা করেছি। মহান আল্লাহর নিকট আকুল আবেদন, তিনি আমাদেরকে সঠিক পথে অগ্রসর হবার তাওফিক দিন এবং বিষয় উন্মোচণে যথাযথ থাকতে সহায়তা করুন... ।





প্রথম পর্ব:





আল্লাহ সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞানের অভাবই সূরাদ্বয় অবতারণের মূল কারণ । তাই শানে নুযুল বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমেই নিবন্ধের সূচনা করছি। তাছাড়া আল-কোরআনের বিভিন্ন আয়াত ও সূরার অর্থ ও তার তত্ত্বগত বিষয়াদি অনুধাবনের ক্ষেত্রে শানে নুযুলের বিশাল ভূমিকা থাকে।





সূরা ইখলাসের শানে নুযুল:





আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভুল ধারণা এ সূরা অবতীর্ণ হবার মূল কারণ। কতিপয় ইহুদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, তুমি আমাদেরকে তোমার রব সম্পর্কে বলতো-তাঁর কিছু বিবরণ দাও। আল্লাহ তাআলা তাওরাতে তাঁর পরিচয় তুলে ধরেছেন এবং কতিপয় গুণাবলী বর্ণনা করেছেন। সুতরাং তুমি আমাদের বল, তিনি কিসের তৈরি ? কোন শ্রেণী ভুক্ত তিনি ? তিনি কি স্বর্ণ না রৌপ্য নাকি তাম্র? তিনি কি খাবার ও পানীয় গ্রহণকরেন ? পৃথিবীর উত্তরাধিকার তিনি কার থেকে পেয়েছেন আর তাঁর উত্তরাধিকারীই বা হবে কে ? এর জবাবে আল্লাহ তাআলা এ সূরা নাযিল করেছেন।





সাহাবি উবাইয় বিন কা’ব রা. বলেন, মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, তুমি আমাদেরকে তোমরা রবের বংশ পরম্পরা বর্ণনা করে শুনাও, তখন আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন, ( قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ . اللَّهُ الصَّمَدُ) (আসবাবুন্নুযূল লিল-ওয়াহিদি)





তারা বিশ্বাস করত আল্লাহ তাআলার বংশ পরম্পরা ও মেয়ে রয়েছে। ফেরেশতারা হচ্ছে তাঁর মেয়ে। ইহুদি-খ্রিষ্টানরাও অভিন্ন মত পোষণ করত।





আর ইয়াহুদিরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে, মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতঃপূর্বে কুফরি করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে ? (তাওবা : ৩০)





আর সূরা কাফিরূন নাযিল হয়েছে কোরাইশের কিছু লোকের একটি আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে । তারা এসে বলল, হে মুহাম্মাদ- এসো তুমি আমাদের ধর্মের অনুসরণ কর, আমরা তোমার দ্বীনের অনুসরণ করব। তুমি আমাদের উপাস্যদের উপসনা কর এক বছর, আমরা তোমার মাবূদের ইবাদত করব এক বছর। এর মাধ্যমে তোমার আনীত দ্বীন যদি আমাদের অনুসৃত ধর্ম-কর্ম হতে উৎকৃষ্ট হয় তাহলে আমরা তাতে অংশ গ্রহণ করতে পারলাম এবং তা হতে আমাদের নির্ধারিত অংশ নিতে পারলাম। আর যদি তোমার ধর্ম হতে আমাদেরটি উত্তম হয় তাহলে তুমি তাতে অংশ নিতে পারলে এবং তোমার নির্ধারিত অংশ গ্রহণ করতে পারলে। নবীজি বললেন, নাউযুবিল্লাহ- তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরিক করা হতে পানাহ চাই। এরপর আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন,








রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকালে মসজিদে তাশরিফ রাখলেন। পূর্ব হতেই কোরাইশ সম্প্রদায়ের লোকজনে মসজিদ প্রাঙ্গন ছিল পরিপূর্ণ। তিনি তাদের সম্মুখে পূর্ণ সূরা তেলাওয়াত করে শুনালেন। তাদের হেদায়াতের প্রতি রাসূলুল্লাহর সীমাহীন আগ্রহ দেখে তারা আশা করছিল হয়ত তিনি তাদের প্রস্তাবে সম্মত হবেন। কিন্তু সেদিন সকালের পর থেকে তারা আশা ছেড়ে দিল বরং বলা চলে একেবারে নিরাশ হয়ে গেল। (আসবাবুন্নুযূল লিল-ওয়াহিদি)


  দ্বিতীয় পর্ব: আল্লাহ সম্বন্ধে সঠিক ধারণা





আল্লাহ কে ? কী তাঁর পরিচয় ? মহা বরকতময় মহান রব সম্বন্ধে সঠিক ধারণাটি কী?








আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী। আর তাঁর কোন সমকক্ষও নেই।তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।





সাহাবি আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা.-এর মতে الصَّمَد ( অমুখাপেক্ষী) অর্থ,





সাইয়েদ-নেতৃত্বের অধিকারী, যিনি নিজ নেতৃত্বে পূর্ণতায় সমাসীন।





শরীফ- মর্যাদাবান, যিনি আপন মর্যাদায় শীর্ষে অবস্থান করছেন।





আযীম-মহান, যিনি স্বমহিমায় চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত।





হালীম-সহনশীল, যিনি সহনশীলতায় সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে আছেন।





গণী-অভাবহীন, যিনি নিজ অমুখাপেক্ষিতায় পূর্ণাতায় পৌঁছেছেন।





জাব্বার-মহা পরাক্রমশালী, যিনি প্রভাব-বলয়ে পূর্ণতায় অধিষ্ঠিত।





আলিম-জ্ঞানবান, নিজ জ্ঞানে যিনি পূর্ণতায় উপনীত।





হাকীম-প্রজ্ঞাময়, নিজ প্রজ্ঞায় যিনি সকলকে ছাড়িয়ে আছেন।





তিনি এমনই সত্তা, মর্যাদা ও বড়ত্বের সর্বশাখায় যিনি শীর্ষে আছেন। যার সকল গুণাগুণ পূর্ণাঙ্গতার মাপকাঠিতে সর্বাধিক উত্তীর্ণ। মহান আল্লাহ, এ-ই হচ্ছে তাঁর গুণাগুণ। যা তিনি ব্যতীত আর কারো জন্য প্রযোজ্য নয়।





তিনি চিরঞ্জীব সুপ্রতিষ্ঠিত ধারক, মহা দয়ালু অতি মেহেরবান, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, এবং অনেক সৃষ্টিকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন...।





৯৫. নিশ্চয় আল্লাহ বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী। তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন এবং জীবিত থেকে মৃতকে বেরকারী। তিনিই আল্লাহ, সুতরাং (সৎপথ থেকে) কোথায় তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে ?





৯৬. (তিনি) প্রভাত উদ্ভাসিতকারী। তিনি বানিয়েছেন রাতকে প্রশান্তি এবং সূর্য ও চন্দ্রকে সময় নিরূপক। এটা সর্বজ্ঞ পরাক্রমশালীর নির্ধারণ।





৯৭. আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য তারকারাজি, যাতে তোমরা এ দ্বারা পথপ্রাপ্ত হও স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারে। নিশ্চয় আমি আয়াতসমূহকে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি এমন কওমের জন্য যারা জানে।





৯৮. আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এক নফস থেকে। অতঃপর রয়েছে আবাসস্থল ও সমাধিস্থল। অবশ্যই আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করেছি, এমন কওমের জন্য যারা ভালভাবে বুঝে।





৯৯. আর তিনিই আসমান থেকে বর্ষণ করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর আমি এ দ্বারা উৎপন্ন করেছি সব জাতের উদ্ভিদ। অতঃপর আমি তা থেকে বের করেছি সবুজ ডাল-পালা। আমি তা থেকে বের করি ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা। আর খেজুর বৃক্ষের মাথি থেকে (বের করি) ঝুলন্ত থোকা। আর (তা দ্বারা উৎপন্ন করি) আঙ্গুরের বাগান এবং সাদৃশ্যপূর্ণ ও সাদৃশ্যহীন যয়তুন ও আনার। দেখ তার ফলের দিকে, যখন সে ফলবান হয় এবং তার পাকার প্রতি। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য যারা ঈমান আনে। (সূরা আনআম : ৯৫-৯৯)








নিশ্চয় তোমাদের রব আসমানসমূহ ও যমীন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশে উঠেছেন। তিনি রাত দ্বারা দিনকে ঢেকে দেন। প্রত্যেকটি একে অপরকে দ্রুত অনুসরণ করে। আর (সৃষ্টি করেছেন) সূর্য, চাঁদ ও তারকারাজী, যা তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। জেনে রাখ, সৃষ্টি ও নির্দেশ তাঁরই। আল্লাহ মহান, যিনি সকল সৃষ্টির রব। ( আরাফ : ৫৪)





১০. তিনিই সে সত্তা, যিনি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেন, যাতে রয়েছে তোমাদের জন্য পানীয় এবং তা থেকে হয় উদ্ভিত, যাতে তোমরা জন্তু চরাও।





১১.তার মাধ্যমে তিনি তোমাদের জন্য উৎপন্ন করেন ফসল, যাইতুন, খেজুর গাছ, আঙ্গুর এবং সকল ফল-ফলাদি। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।





১২. আর তিনি তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন রাত ও দিনকে এবং সূর্য ও চাঁদকে আর তারকাসমূহও তাঁর নির্দেশে নিয়োজিত। নিশ্চয় এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য যারা বুঝে।





১৩. আর তিনি তোমাদের জন্য যমীনে যা সৃষ্টি করেছেন, বিচিত্র রঙের করে, নিশ্চয় তাতেও নিদর্শন রয়েছে এমন কওমের জন্য, যারা উপদেশ গ্রহণ করে।





১৪. আর তিনিই সে সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশ্‌ত খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার অলংকারাদি, যা তোমরা পরিধান কর। আর তুমি তাতে নৌযান দেখবে তা পানি চিরে চলছে এবং যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার এবং যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।





১৫. আর যমীনে তিনি স্থাপন করেছেন সুদৃঢ় পর্বতমালা, যাতে তোমাদের নিয়ে যমীন হেলে না যায় এবং নদ-নদী ও পথসমূহ, যাতে তোমরা পথপ্রাপ্ত হও।





১৬. আর (দিনের) পথ-নির্দেশক চি‎হ্নসমূহ, আর (রাতে) তারকার মাধ্যমে তারা পথ পায়।





সুতরাং যে সৃষ্টি করে, সে কি তার মত, যে সৃষ্টি করে না ? অতএব তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না ?





১৭. আর যদি তোমরা আল্লাহর নিআমত গণনা কর, তবে তার ইয়ত্তা পাবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। {সূরা নাহল:১০-১৭}





৭৮.আর আল্লাহ তোমাদেরকে বের করেছেন, তোমাদের মাতৃগর্ভ থেকে এমতাবস্থায় যে, তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন শ্রবণশক্তি, চক্ষু ও অন্তর। যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় কর।





৭৯. তারা কি আকাশে (উড়ন্ত অবস্থায়) নিয়োজিত পাখিগুলোর দিকে তাকায় না ? আল্লাহ ছাড়া কেউ তাদেরকে ধরে রাখে না। নিশ্চয় তাতে নিদর্শনাবলী রয়েছে সেই কওমের জন্য যারা বিশ্বাস করে।





৮০.আর আল্লাহ তোমাদের ঘরগুলোকে তোমাদের জন্য আবাস করেছেন এবং তোমাদের পশুর চামড়া দিয়ে তাবুর ব্যবস্থা করেছেন, যা খুব সহজেই তোমরা সফরকালে ও অবস্থানকালে বহন করতে পার। আর তাদের পশম, তাদের লোম ও তাদের চুল দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য গৃহসামগ্রী ও ভোগ-উপকরণ (তৈরি করেছেন)।





৮১. আর আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন, তা থেকে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং পাহাড় থেকে তোমাদের জন্য আশ্রয়স্থল বানিয়েছেন, আর ব্যবস্থা করেছেন পোশাকের, যা তোমাদেরকে গরম থেকে রক্ষা করে এবং বর্মেরও ব্যবস্থা করেছেন যা তোমাদেরকে রক্ষা করে যুদ্ধে। এভাবেই তিনি তোমাদের উপর তার নিয়ামতকে পূর্ণ করবেন, যাতে তোমরা অনুগত হও। {সূরা নাহল:৭৮-৮১}





আল্লাহ নিজ সম্বন্ধে মানুষদের যা জানিয়েছেন উপরোল্লেখিত অংশটুকুর আনুপাতিক হার সিন্ধুর তুলনায় বিন্দুর অনুরূপ।





এগুলো নিদর্শনাবলী, আল্লাহর পরিচয় লাভের সহায়ক। এসব নিদর্শন মহান রবের সাথে মানুষের সম্পর্ক তৈরি করে সুনিপুনভাবে এবং একান্ত স্বার্থকভাবে সৃষ্টি করে তাদের অন্তরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ।





আল্লাহ সম্বন্ধে খ্রীষ্টান-নাসারাদের ধারণা কী ? তাঁর সাথে নিখিল বিশ্ব ও মানুষের সম্পর্ক কী?





তারা বিশ্বাস করে আল্লাহর সন্তান আছে।‌ ‘আল্লাহ তা হতে পবিত্র,। জন্ম দেয়া-নেয়া হচ্ছে আবির্ভূত হওয়া, বিস্তার লাভ করা বা শূন্যতার পর একটি অতিরিক্ত অস্তিত্ব যা বলতে গেলে এক প্রকার ঘাটতি। আর এটি মহাপরাক্রমশালী-প্রতাপাপন্ন মাওলার ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে অসম্ভব। কারণ তিনি (لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ   অর্থাৎ তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেয়া হয়নি।) সুতরাং যারা এরূপ বলবে তারা ইসলামি আকিদার দৃষ্টিকোণ থেকে চির জাহান্নামি-কাফের বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তাদের কোনো আমলই গ্রহণ করবেন না।





আর ইহুদিরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারারা বলে, মাসিহ আল্লাহর পুত্র। এটা তাদের মুখের কথা, তারা সেসব লোকের কথার অনুরূপ বলছে যারা ইতঃপূর্বে কুফরি করেছে। আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করুন, কোথায় ফেরানো হচ্ছে এদেরকে? {তাওবা:৩০}





সাহাবি আবু মূসা আশআরি রা. হতে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কোনো কষ্টদায়ক কথা শোনার পর (ধৈর্য্য ধারণের ক্ষেত্রে) আল্লাহ অপেক্ষা অধিক ধৈর্য্যশীল আর কেউ নেই। তারা তাঁর সন্তান আছে মর্মে দাবি করে আর তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন এবং জীবনোপকরণ দিয়ে থাকেন।, {বুখারি ও মুসলিম}





তাদের এ ধারণাটি জন্ম নিয়েছে গ্রীক পৌরাণিক প্রমিথিউসের ‘পবিত্র অগ্নি’রূপকথার ধারণা হতে। এসব থিওরির মাধ্যমে সে তাদের চিন্তা-চেতনায় এরূপ অসার বিশ্বাসের ভিত রচনা করছে এবং হেদায়াতের সঠিক রাস্তা হতে দূরে ঠেলে দিয়েছে।





তবে কোনো সন্দেহ নেই, জীবন ও ব্যক্তি সংশোধনের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত সঠিক ধারণা ও তাঁর সম্বন্ধে যথাযথ বোধ-বিবেচনার বিরাট ভূমিকা রয়েছে।


 তৃতীয় পর্ব: একত্ববাদের বিশ্বাস ও তৎপ্রতি দাওয়াত





আল্লাহ বলেন, (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) অর্থাৎ তিনি এক-অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই অনুরূপভাবে উজির, প্রতিপক্ষ, সদৃশ, বিকল্প বলেও কিছু নেই। إثبات তথা প্রমাণের ক্ষেত্রে أَحَدٌ শব্দটি কেবল আল্লাহ তাআলার ব্যাপারে প্রয়োগ হয়। তবে نفي তথা প্রত্যাখ্যান, এর বিপরীত। যেমন لم يخرج من المسجد أحد-মসজিদ হতে কেউ বের হয়নি বলা অশুদ্ধ নয়। এর মূল কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলাই কেবল নিজ গুণাগুণ ও কর্মে এককভাবে পরিপূর্ণ।





এ আয়াত এবং সূরা নাস ও সূরা ফালাকের প্রথম দুই আয়াতের মাঝে এক দিক থেকে সাদৃশ্য আছে অন্য দিক থেকে বৈপরীত্ব। সাদৃশ্য হচ্ছে, এতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সূরার বিষয়বস্তু সম্বন্ধে উচ্চারণের নির্দেশ দিয়েছেন। একইভাবে (قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ) -এও আল্লাহর পক্ষ হতে নিজের তাওহিদের কথা বলা হয়েছে। যেমনিকরে তাওহিদের প্রচার ও দাওয়াতের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (আল-যাওউল মনীর আ’লা তাফসিরি ইবনিল কাইয়িম)





অর্থাৎ হে মুহাম্মাদ, হে মুহাম্মাদের সহচরবৃন্দ, হে মুসলিম সকল, আল্লাহকে এক বলে স্বীকার কর এবং তাঁর একত্ববাদের প্রতি সকল লোককে আহ্বান কর।





সকল নবীর দাওয়াততো এ মহান বিষয়ের প্রতিই ছিল। اعبدواالله ما لكم من إله غيره) তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের জন্য আর কোনো ইলাহ নেই।)


 চতুর্থ পর্ব: অমুসলিম-কাফেররা কি ইসলামে প্রবেশ করে আমাদের মনোতুষ্টি সাধন করবে?





আল্লাহ তাআলা বলেন: (وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ এবং আমি যার ইবাদাত করি তোমরা তার ইবাদাতকারী নও।) অমুসলিমরা আল্লাহ তাআলার ইবাদত করবে এ আয়াত সে সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করছে।





এ আয়াত ও তা বার বার উদ্ধৃত হবার পেছনে বহু অর্থবহ কারণ নিহত আছে। যেমন,





·       আল্লাহর ইবাদত থেকে তাদের বিরত থাকা ইচ্ছাকৃত বা প্রকৃতিগত স্বভাবের কারণে নয় বরং তাদের বিশ্বাসই ছিল তারা আল্লাহর ইবাদত করছে । [ولا يزال كثير منهم كذلك ] (তাদের অধিকাংশের ধারণা ছিল তাই) তবে তারা ছিল আল্লাহ সম্পর্কে অজ্ঞ। {আল-যাওউল মুনীর: ৪৬৬/৬} যতই তারা বিশ্বাস করতো যে আল্লাহর ইবাদত সম্পাদনের মাধ্যমে তারা তাঁর নৈকট্য অর্জন করছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। কারণ সেগুলো মূলত: ইবাদত ছিল না। ইবাদততো আল্লাহর সাথে শিরককে প্রত্যাখ্যান করে। আর তারা শিরক হতে মুক্ত ছিল না। তাছাড়া ‌লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু -এর দাবি হচ্ছে, সত্য মাবূদ আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্যকে অস্বীকার ও প্রত্যাখ্যান করতে হবে।





·       আমি নিজ অবস্থান (তাওহিদ) থেকে যতই নিচে নেমে আসি না কেন তোমরা আল্লাহর সাথে শিরক বাদ দিয়ে নিজ অবস্থান থেকে নেমে আসবে না। এমনকি আমি তাওহিদ ছেড়ে আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করে তোমাদের মনোতুষ্টি সাধন করলেও।





  অর্থাৎ আর ইহুদি ও নাসারারা কখনো তোমার প্রতি সন্তষ্ট হবে না, যতক্ষণ না তুমি তাদের মিল্লাতের অনুসরণ কর।} সুতরাং আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করে আমরা তাদের মনোতুষ্টি সাধন করতে পারলেও আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি দিয়ে তারা আমাদের সন্তুষ্ট করবে এমন কোনো আশা নেই।





তাছাড়া শাব্দিক অলংকরণের প্রতি দৃষ্টি দিলেও বিষয়টি প্রতিভাত হয়। কারণ,





-বলে ছুবূতের প্রমাণ বহনকারী কর্তাবাচক বাক্য ব্যবহার করে মহান আল্লাহ এটিই বুঝিয়েছেন যে শিরকের অভ্যাস তাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। একবারের জন্য হলেও এটি তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হবার নয়।





পঞ্চম পর্ব:





অমুসলিমদের আগ্রহের প্রতি সাড়া দিয়ে আমারা তাদের মনোতুষ্টি সাধন করতে পারি না এবং করবও না, এমনকি মাত্র একবারের জন্য হলেও। এটিই আমাদের আদর্শ। এটিই আমাদের দীনের শিক্ষা। {لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ  } ও { وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ} আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে না করে দেওয়া হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মিথ্যা উপাস্যদের ইবাদত করবেন না। বাকি প্রসঙ্গটি একাধিকবার উল্লেখ করার পেছনে রহস্য হচ্ছে, একত্ববাদের ধারণা প্রগাঢ় করা ও শিরক থেকে মুক্তির বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত করা।





শব্দগত দিক থেকে দুই আয়াতে কিছুটা ভিন্নতা আছে। প্রথম আয়াতে না বাচক ক্রিয়া আর দ্বিতীয় আয়াতে কর্তাবাচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ক্রিয়াবাচক ও কর্তাবাচক শব্দের মাঝে পার্থক্য হচ্ছে, ক্রিয়াবাচক শব্দে  নবায়ন, ক্রমাগত ও সংঘটনের অর্থ পাওয়া যায়। আর কর্তাবাচক শব্দ আবশ্যিক গুণ ও স্থির অর্থ বুঝিয়ে থাকে। আয়াতদ্বয়ের মাধ্যমে যেন বলা হয়েছে, তোমাদের উপাস্যের ইবাদত করে তোমাদের মনোতুষ্টি সাধন আমার দ্বারা কখনও হবে না। এটি আমার অভ্যাস নয়, কর্মও নয়। {আল-যাওউল মুনীর: ৪৭০/৬}





সুতরাং আয়াতের মূল সম্বোধিত ব্যক্তিবর্গ- রাসূল অনুসারীদের পক্ষে অমুসলিমদের মনোতুষ্টি কল্পে এমন কোনো কাজ করা সঙ্গত হবে না যার মাধ্যমে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিংবা আকিদা বিনষ্ট হয়। যদিও কাজটি অতিশয় নগণ্য বা মাত্র একবারের জন্য হয়।                                                        





অমুসলিম-কাফেরদের অনুসরণ-আনুগত্য মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করে পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় সুস্পষ্ট ভাষায় মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,





হে মুমিনগণ, যদি তোমরা কাফিরদের আনুগত্য কর, তারা তোমাদেরকে তোমাদের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস- হয়ে ফিরে যাবে। বরং আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক এবং তিনি উত্তম সাহায্যকারী। {আলে ইমরান: ১৪৯-১৫০}





এরূপ আরো বহু আয়াত রয়েছে যাতে আল্লাহ তাদের ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তাদের চরিত্রের বাস্তব অবস্থা ও অন্তরে লুকিত দূরভিসন্ধি চিত্রিত করে দিখিয়েছেন। যেমন,








হে মুমিনগণ, তোমরা তোমাদের ছাড়া অন্য কাউকে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা তোমাদের সর্বনাশ করতে ত্রুটি করবে না। তারা তোমাদের মারাত্মক ক্ষতি কামনা করে। তাদের মুখ থেকে তো শত্রুতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে। আর তাদের অন্তরসমূহ যা গোপন করে তা মারাত্মক। অবশ্যই আমি তোমাদের জন্য আয়াতসমূহ স্পষ্ট বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা উপলব্ধি করতে।





শোন, তোমরাই তো তাদেরকে ভালবাস এবং তারা তোমাদেরকে ভালবাসে না। অথচ তোমরা সব কিতাবের প্রতি ঈমান রাখ। আর যখন তারা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’। আর যখন তারা একান্তে মিলিত হয়, তোমাদের উপর রাগে আঙ্গুল কামড়ায়। বল, ‘তোমরা তোমাদের রাগ নিয়ে মর’! নিশ্চয় আল্লাহ অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত।





যদি তোমাদেরকে কোন কল্যাণ স্পর্শ করে, তখন তাদের কষ্ট হয়। আর যদি তোমাদেরকে মন্দ স্পর্শ করে, তখন তারা তাতে খুশি হয়। আর যদি তোমরা ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছু ক্ষতি করবে না। নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে, তা পরিবেষ্টনকারী।{সূরা আলে ইমরান: ১১৮-১২০}


 ষষ্ঠ পর্ব: স্বাতন্ত্রবোধে উজ্জীবিত হওয়া কাম্য, বিগলিত নয়





দ্বীন-ইসলাম একটি স্বতন্ত্র মতবাদ। একটি স্বতন্ত্র বিশ্বাস। আপন স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত একটি জীবন ব্যবস্থার নাম। আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, প্রথা-ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংষ্কৃতি-অভ্যাস বরং জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্রেই ইসলামের একটি স্বাতন্ত্র ও নিজস্বতা রয়েছে। সেটি রক্ষা করেই প্রতিটি মুসলিম নিজের যাবতীয় কর্ম সম্পাদন করে থাকে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,





{لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِين} অর্থাৎ তোমাদের একটি আলাদা মতবাদ রয়েছে, রয়েছে স্বতন্ত্র বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও জীবন বোধ- ব্যক্তিগত চাল চলনে যার প্রভাব তোমাদেরকে প্রভাবিত করে। ঠিক একইভাবে আমাদেরও রয়েছে নিজস্ব মতবাদ, স্বকীয় বিশ্বাস, স্বতন্ত্র জীবনবোধ, রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য, সংষ্কৃতি ও আচরণবিধি যা প্রতিটি নি:শ্বাসে প্রবাহ পায় সকল মুসলমানের দৈনন্দিন জীবনে। সুতরাং আমরা আমাদের দ্বীন ও মতবাদ ছেড়ে তোমাদের অসার দ্বীন ও মতবাদ গ্রহণ করব, এমনটি হতে পারে না। সেটি কেবল তোমাদেরকেই মানায়। আমরা আমাদের দ্বীন ও বিশ্বাসের সাথে তোমাদের মতবাদের মিশ্রণ ঘটিয়ে শিরক করতে পারি না। নিজেদের স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিতে পারি না একটি কাল্পনিক ও ধারণাপ্রসূত বাতিল মতবাদের মাঝে। আর তোমরাও গোঁড়ামি ও নির্বুদ্ধিতার কারণে কখনও আমাদের সত্য ও যুক্তিনির্ভর দ্বীন গ্রহণ করবে না। এটি অমুসলিমদের দ্বীন পরিত্যাগ ও সম্পর্কচ্ছেদ বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ঘোষণা। {আল-যাওউল মুনীর: ৪৭৫/৬}





মুহাজির ও আনসারদের মাঝে সম্পাদিত মৈত্রি-চুক্তিতে খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক উচ্চারিত একটি মৌল-ধারা ছিল, ‘পৃথিবীর সকল মানুষ বাদ দিয়ে মুসলমান নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র  জাতি।‌’





ইহুদি, খ্রিষ্টান কিংবা অগ্নি পূজারি- এককথায় বিশ্বের তাবত মানুষ ধর্ম-কর্ম, আকিদা-বিশ্বাস, শিল্প-সংষ্কৃতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে পারস্পরিক সমঝোতা রক্ষা করে একে অপরের অনুসরণ করে চলে। এ ক্ষেত্রে উম্মতে মুহাম্মাদি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তারা নিজেরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ধর্ম-কর্ম, চাল-চলন, শিল্প-সংষ্কৃতি, বেশ-ভূষা, আকিদা-বিশ্বাসসহ মানব জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গে তাদের রয়েছে স্বকীয় রীতি, নিজস্ব ধারা। কোনো ক্ষেত্রেই তারা অন্য কোনো জাতি ও মানুষের সাদৃশ্য অবলম্বন করে না। এ স্বকীয়তা বজায় রাখার তাগিদে অন্য ধর্মাবলম্বীদের অভ্যাসগত ও জাগতিক রীতি-নীতির অনুসরণকে তারা হারাম জ্ঞান করে। ধর্মীয় বিষয়াদির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখে না।





এ স্বাতন্ত্রবোধ তাদের মর্যাদাগত অবস্থানকে সংহত করেছে সুদৃঢ়ভাবে। আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়েছে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে। এ স্বাতন্ত্রবোধ তাদের ঐতিহ্যের একটি মৌলিক উপাদান। কেবলা পরিবর্তন ও সমজাতীয় কয়েকটি ব্যাপারে সামান্য চিন্তা করলেই বিষয়টি প্রতিভাত হয় সুন্দরভাবে। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এমনকি ইসলমের শুরুযুগেও কেবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। পরবর্তী কালে এটি পরিবর্তন করে কেবলা করা হয় পবিত্র কা’বাকে। এতে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র প্রমাণ হয় সুস্পষ্টরূপে। নবী আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নানা বিষয়ে সে স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছেন নিয়মিত। ইহুদি মতবাদে  মোজা পরে সালাত আদায় ছিল অবৈধ, নবীজি তাঁর সাহাবাদের মোজা পরে সালাতের অনুমতি প্রদান করলেন। তারা পাকা চুল, দাড়িতে রং লাগাতো না, নবীজি মুসলমানদেরকে মেহেদি ও কাতম জাতীয় পদার্থ দ্বারা সাদা চুল-দাড়িকে রঞ্জিত করার অনুমতি দিলেন। আশুরা উপলক্ষে তারা একদিন সওম পালন করত, নবীজি মৃত্যু পূর্ববর্তী বছর তাদের বিরোধিতা কল্পে প্রত্যয় ঘোষণা করলেন, আগামী বছর বেঁচে থাকলে আমি দুই দিন সওম পালন করব।





অমুসলিমদের বিরোধিতাকে রাসূলুল্লাহ মুসলমানদের স্বাতন্ত্র রক্ষার্থে আইনে পরিণত করলেন। বললেন, (যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদের মধ্য হতে গণ্য হবে) আরো বললেন, (তোমরা ইহুদিদের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে না) এ প্রসঙ্গে হাদিসের ভাণ্ডার খুবই সমৃদ্ধ। {ড. আকরাম আল-উমরি, আল-সিরাতুন্নববিয়্যাহ ১/২৯২, আল্লামা ইবন তাইমিয়া, ইকতেজাউস সিরাতিল মুস্তাকীম}





সপ্তম পর্ব:





কোনো ক্ষেত্রেই আমাদের ও অমুসলিমদের মাঝে কোনো মিল নেই। বরং উভয়ের মাঝে সুস্পষ্ট দূরত্ব ও বৈপরীত্ব বিদ্যমান। সুতরাং কোনো ক্ষেত্রেই তাদের সাথে আমাদের মিলন সম্ভব নয়, না আকিদা-বিশ্বাসে না চিন্তা-চেতনায় না মতবাদে এবং না রীতি-নীতিতে।





আকিদা-বিশ্বাসে সম্ভব নয় কারণ আমরা বিশ্বাস করি আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবূদ নেই আর তারা পাথর, গাছপালা, মানুষ ইত্যাদিকে তাঁর সাথে শরিক করে, যে ব্যাপারে কোনো দলিল-প্রমাণ অবতীর্ণ হয়নি।





 



Recent Posts

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 3

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 2

আল-কুরআনুল কারীমের অর ...

আল-কুরআনুল কারীমের অর্থানুবাদ: প্রেক্ষাপট ও আবশ্যকীয় জ্ঞান 1