Articles

 ছাহাবা : ন্যায়নিষ্ঠতা ও সুমহান মর্যাদা





﴿الصحابة - رضي الله عنهم - عدالتهم وعلوُّ مكانتهم﴾


 ছাহাবা : ন্যায়নিষ্ঠতা ও সুমহান মর্যাদা   





হেদায়াতের নক্ষত্র, তাকওয়ার পূর্ণচন্দ্র, দীপ্তিমান তারকা, সুদীপ্ত পূর্ণিমা; রাতের দরবেশ, দিনের অশ্বারোহী; যারা আপন আঁখি যুগলকে সজ্জিত করেছেন মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নূরের সুরমায়; ইসলাম নিয়ে যারা ছুটে গেছেন পূর্বে ও পশ্চিমে, যার বদৌলতে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে ভূভাগের প্রতিটি দেশে এবং প্রতিটি প্রান্তে। তাঁরা ছিলেন আনসার, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে করেছেন নুসরাত ও সাহায্য। তাঁরা ছিলেন মুহাজির, যারা কেবলই আল্লাহর জন্য  করেছেন হিজরত, বিসর্জন দিয়েছেন নিজেদের দেশ ও সহায়-সম্পদ।





তাঁদের মর্যাদার সবিস্তার বিবরণ দেবার সাধ্যি নেই কোনো ভাষার। তাঁদের পূর্ণ শ্রেষ্ঠত্ব ও আদর্শের আদ্যোপান্ত আলোচনার ক্ষমতা নেই কোনো কলমের। তাঁরা হলেন কবির কথায়,





عَهْدِي بِهِمْ تَسْتَنِيرُ الأَرْضُ إِنْ نَزَلُوا





فِيهَا وَتَجْتَمِعُ الدُّنيَا إِذَا اجْتَمَعُوا





وَيَضْحَكُ الدَّهْرُ مِنْهُمْ عَنْ غَطَارِفَةٍ





كَأَنَّ أَيَّامَهُمْ مِنْ أُنْسِهَا جُمَعُ





‘তাঁদেরকে তো আমি দেখেছি এমন যে, তাঁরা মর্ত্যে নেমে আসলে তা আলোকিত হয়ে যায়; আর তাঁরা সমবেত হলে গোটা জাহানই সমবেত হয়।





তাঁদের বদান্যতা ও আতিথ্যে যুগ হয় অভিভূত, তাঁদের দিনগুলো ভালোবাসা-সম্প্রীতিতে যেন জুমু‘আর দিন!’ [আব্দুস সালাম হারুন, মাজমু‘আতুল মা‘আনী : ১/৫৫৬]





রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর তাঁরাই বহন করেছেন ইসলামের ঝাণ্ডা। ইসলামের পতাকা উড্ডীন করেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। আল্লাহ তাঁদের মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিমকে সম্মানিত করেছেন। এ কারণেই আমরা বিচারের দিন পর্যন্ত তাঁদের নিকট ঋণী। কবি বলেন,





فَمَا العِزُّ لِلْإِسْلاَمِ إِلاَّ بِظِلِّهِمْ





وَمَا الْمَجْدُ إِلاَّ مَا بَنَوْه فَشَيَّدُوا





‘ইসলামের সম্মান তো তাঁদের ছায়াতেই; আর মর্যাদা তো তাই, যা তাঁরা নির্মাণ করে সুদৃঢ় করেছেন!’


 উপক্রমনিকা :





বুখারী রহ. তাঁর সহীহ গ্রন্থে ছাহাবীর সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে :  ‘মুসলিমদের মধ্যে যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গ লাভ করেছেন অথবা তাঁকে দেখেছেন তিনিই ছাহাবী।’ অর্থাৎ ছাহাবী হলেন, যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঈমানসহ দেখেছেন এবং ইসলাম নিয়েই মারা গেছেন।





‘ছাহাবী’র সংজ্ঞায় এ ব্যাপকতা মূলত ছোহবত বা সাহচর্যের মর্যাদা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদার মহত্ত্বের প্রতি লক্ষ্য করে। কেননা নবুওতের নূর দর্শন মুমিনের অন্তরে একটি সংক্রামক শক্তি সঞ্চার করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বরকতে মৃত্যু অবধি এ নূরের প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয় দর্শকের ইবাদত-বন্দেগীতে এবং তার জীবনযাপন প্রণালীতে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি বাণীতে আমরা এর সাক্ষ্য পাই। আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,





طُوبَى لِمَنْ رَآنِي وَآمَنَ بِي ، وَطُوبَى لِمَنْ آمَنَ بِي وَلَمْ يَرَنِي سَبْعَ مِرَارٍ.





‘সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য যে আমাকে দেখেছে এবং আমার প্রতি ঈমান এনেছে। আর সুসংবাদ ওই ব্যক্তির জন্য যে আমার প্রতি ঈমান এনেছে অথচ আমাকে দেখেনি।’ এ কথা তিনি সাতবার বললেন। [মুসনাদ আহমাদ : ২২৪৮৯]





এ সংজ্ঞা মতে ছাহাবীরা ছোহবত বা সাহচর্যের সৌভাগ্য এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দর্শনের মর্যাদায় অভিষিক্ত। আর তা এ কারণে যে, নেককারদের ছোহবতেরই যেখানে এক বিরাট প্রভাব বিদ্যমান, সেখানে সকল নেককারের সরদার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোহবতের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য। অতএব যখন কোনো মুসলিম তাঁর দর্শন লাভে ধন্য হয়, হোক তা ক্ষণিকের জন্যে, তার আত্মা ঈমানের দৃঢ়তায় টইটুম্বুর হয়ে যায়। কারণ, সে ইসলামে দীক্ষিত হবার মাধ্যমে স্বীয় আত্মাকে ‘গ্রহণ’ তথা কবুলের জন্য প্রস্তুতই রেখেছিল। ফলে যখন সে ওই মহান নূরের মুখোমুখী হয়, তখন তার কায়া ও আত্মায় এর প্রভাব ভাস্কর হয়ে ওঠে।’ [তাকিউদ্দীন সুবুকী, কিতাবুল ইবহাজ ফী শারহিল মিনহাজ : ১/১২]





আল্লাহ তা‘আলা তাঁর পবিত্র গ্রন্থে অনেক স্থানে এ ছাহাবীদের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,





﴿ مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ تَرَىٰهُمۡ رُكَّعٗا سُجَّدٗا يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗاۖ سِيمَاهُمۡ فِي وُجُوهِهِم مِّنۡ أَثَرِ ٱلسُّجُودِۚ ذَٰلِكَ مَثَلُهُمۡ فِي ٱلتَّوۡرَىٰةِۚ وَمَثَلُهُمۡ فِي ٱلۡإِنجِيلِ كَزَرۡعٍ أَخۡرَجَ شَطۡ‍َٔهُۥ فَ‍َٔازَرَهُۥ فَٱسۡتَغۡلَظَ فَٱسۡتَوَىٰ عَلَىٰ سُوقِهِۦ يُعۡجِبُ ٱلزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ ٱلۡكُفَّارَۗ وَعَدَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِنۡهُم مَّغۡفِرَةٗ وَأَجۡرًا عَظِيمَۢا ٢٩ ﴾ [الفتح: ٢٩]


 ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়, তুমি তাদেরকে রুকূকারী, সিজদাকারী অবস্থায় দেখতে পাবে। তারা আল্লাহর করুণা ও সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করছে। তাদের আলামত হচ্ছে, তাদের চেহারায় সিজদার চি‎হ্ন থাকে। এটাই তাওরাতে তাদের দৃষ্টান্ত। আর ইনজীলে তাদের দৃষ্টান্ত হলো একটি চারাগাছের মত, যে তার কচিপাতা উদগত করেছে ও শক্ত করেছে, অতঃপর তা পুষ্ট হয়েছে ও স্বীয় কাণ্ডের ওপর মজবুতভাবে দাঁড়িয়েছে, যা চাষীকে আনন্দ দেয়। যাতে তিনি তাদের দ্বারা কাফিরদেরকে ক্রোধান্বিত করতে পারেন। তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহাপ্রতিদানের ওয়াদা করেছেন।’ {সূরা আল-ফাতহ, আয়াত : ২৯}





আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন,





﴿ وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ وَلَا تَجۡعَلۡ فِي قُلُوبِنَا غِلّٗا لِّلَّذِينَ ءَامَنُواْ رَبَّنَآ إِنَّكَ رَءُوفٞ رَّحِيمٌ ١٠ ﴾ [الحشر: ١٠]





‘যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে : ‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদের ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোনো বিদ্বেষ রাখবেন না; হে আমাদের রব, নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু।’ {সূরা আল-হাশর, আয়াত : ১০}





এ ছাড়া আরও অনেক আয়াতে ছাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে। একইভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও ছাহাবীদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মর্যাদা ও মর্তবার কথা ব্যক্ত করেছেন। এ কথা থেকেই মানুষ তাঁদের মর্যাদা অনুধাবন করতে পারে যে, ইবাদত-বন্দেগী ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে কেউ যতই উচ্চতায় পৌঁছুক না কেন ছাহাবীগণ যে স্তরে পৌঁছেছিলেন তার ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। নিচের হাদীসই সে কথা বলছে। ছাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





«يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ فَيَغْزُو فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ فَيَقُولُونَ فِيكُمْ مَنْ صَاحَبَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُونَ نَعَمْ فَيُفْتَحُ لَهُمْ ثُمَّ يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ فَيَغْزُو فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ فَيُقَالُ هَلْ فِيكُمْ مَنْ صَاحَبَ أَصْحَابَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُونَ نَعَمْ فَيُفْتَحُ لَهُمْ ثُمَّ يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ فَيَغْزُو فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ فَيُقَالُ هَلْ فِيكُمْ مَنْ صَاحَبَ مَنْ صَاحَبَ أَصْحَابَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَيَقُولُونَ نَعَمْ فَيُفْتَحُ لَهُمْ».


 ‘লোকদের ওপর এমন এক যুগ আসবে যখন একদল লোক যুদ্ধ করবে, তারা বলবে, তোমাদের মধ্যে কি কেউ আছেন যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গ লাভ করেছেন? সবাই বলবে, হ্যাঁ। তখন তাদের বিজয় দান করা হবে। অতপর লোকদের ওপর এমন এক যুগ আসবে যখন একদল লোক যুদ্ধ করবে, তারা বলবে, তোমাদের মধ্যে কি কেউ আছেন যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গলাভকারী কারও ছোহবত পেয়েছেন? সবাই বলবে, জী হ্যাঁ। তখন তাদের বিজয় দান করা হবে। অতপর লোকদের ওপর এমন এক যুগ আসবে যখন একদল লোক যুদ্ধ করবে, তারা বলবে, তোমাদের মধ্যে কি কেউ আছেন যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গ লাভকারীর সোহবতপ্রাপ্ত কারও সাহচর্য পেয়েছেন? সবাই বলবে, হ্যাঁ। তখন তাদের বিজয় দান করা হবে।’ [বুখারী : ৩৬৪৯; মুসনাদ আহমদ : ২৩০১০]





আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





« النُّجُومُ أَمَنَةٌ لِلسَّمَاءِ فَإِذَا ذَهَبَتِ النُّجُومُ أَتَى السَّمَاءَ مَا تُوعَدُ وَأَنَا أَمَنَةٌ لأَصْحَابِى فَإِذَا ذَهَبْتُ أَتَى أَصْحَابِى مَا يُوعَدُونَ وَأَصْحَابِى أَمَنَةٌ لأُمَّتِى فَإِذَا ذَهَبَ أَصْحَابِى أَتَى أُمَّتِى مَا يُوعَدُونَ ».


 ‘নক্ষত্ররাজি হলো আসমানের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ, তাই যখন তারকারাজি ধ্বংস হয়ে যাবে, আসমানের জন্য যা প্রতিশ্রুত ছিল তা এসে যাবে। একইভাবে আমি আমার ছাহাবীদের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ। অতএব আমি যখন চলে যাব তখন আমার ছাহাবীদের ওপর তা আসবে যা তাদের ওয়াদা করা হয়েছিল। আর আমার ছাহাবীরা আমার উম্মতের জন্য নিরাপত্তাস্বরূপ। যখন আমার ছাহাবীরা চলে যাবে তখন আমার উম্মতের ওপর তা আসবে যা তাদের ওয়াদা করা হয়েছিল।’ [মুসলিম : ৬৬২৯; মুসনাদ আহমদ : ১৯৫৬৬]





জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





إن الله اختار أصحابي على العالمين سوى النبيين والمرسلين ، واختار لي من أصحابي أربعة - يعني : أبا بكر وعمر وعثمان وعليا - رحمهم الله - فجعلهم أصحابي . وقال : في أصحابي كلهم خير ، واختار أمتي على الأمم...».





‘আমার ছাহাবীদেরকে আল্লাহ নবী-রাসূলদের পর সারা জাহানের ওপর নির্বাচিত করেছেন। আর আমার ছাহাবীদের মধ্যে আমার জন্য চারজনকে নির্বাচিত করেছেন : আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। তিনি আরও বলেছেন, আমার ছাহাবীদের সবার কাছেই রয়েছে কল্যাণ। আর [আল্লাহ তা‘আলা] আমার উম্মতকে সকল উম্মতের মধ্য থেকে নির্বাচিত করেছেন।’[1] [মুসনাদ বাযযার : ২৭৬৩]





ছাহাবীদের ফযীলত ও মর্যাদা সম্পর্কে ইমাম আহমদ রহ. একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থই রচনা করেছেন। যাতে তিনি ছাহাবীদের ফযীলত সংক্রান্ত অনেকগুলো হাদীস সংকলন করেছেন। সেখান থেকে আমরা কয়েকটি হাদীস তুলে ধরছি। আবদুল্লাহ ইবন মুগাফফাল রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





« اللَّهَ اللَّهَ فِى أَصْحَابِى اللَّهَ اللَّهَ فِى أَصْحَابِى لاَ تَتَّخِذُوهُمْ غَرَضًا بَعْدِى فَمَنْ أَحَبَّهُمْ فَبِحُبِّى أَحَبَّهُمْ وَمَنْ أَبْغَضَهُمْ فَبِبُغْضِى أَبْغَضَهُمْ وَمَنْ آذَاهُمْ فَقَدْ آذَانِى وَمَنْ آذَانِى فَقَدْ آذَى اللَّهَ وَمَنْ آذَى اللَّهَ فَيُوشِكُ أَنْ يَأْخُذَهُ ».





‘আমার ছাহাবীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আল্লাহকে ভয় কর। আমার পরবর্তীকালে তোমরা তাঁদের সমালোচনার নিশানায় পরিণত করো না। কারণ, যে তাদের ভালোবাসবে সে আমার মুহাব্বতেই তাদের ভালোবাসবে। আর যে তাঁদের অপছন্দ করবে সে আমাকে অপছন্দ করার ফলেই তাদের অপছন্দ করবে। আর যে তাঁদের কষ্ট দেবে সে আমাকেই কষ্ট দেবে। আর যে আমাকে কষ্ট দেবে সে যেন আল্লাহকেই কষ্ট দিল। আর যে আল্লাহকে কষ্ট দেবে অচিরেই আল্লাহ তাকে পাকড়াও করবেন।’ [তিরমিযী : ৪২৩৬; সহীহ ইবন হিব্বান : ৭২৫৬][2]





আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,


 « لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا أَدْرَكَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ ».


 ‘তোমরা আমার ছাহাবীদের গালমন্দ করো না। সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ। যদি তোমাদের কেউ উহুদ পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তবে তা তাদের এক মুদ বা তার অর্ধেকরও সমকক্ষ হতে পারবে না।’ [বুখারী : ৩৬৭৩; মুসলিম : ৬৬৫১]





আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





«مَنْ سَبَّ أَصْحَابِي فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللهِ وَالْمَلائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لاَ يَقْبَلُ اللَّهُ مِنْهُ صَرْفًا وَلا عَدْلا».





‘যে ব্যক্তি আমার ছাহাবীকে গাল দেবে তার ওপর আল্লাহ, ফেরেশতা সকল মানুষের অভিশাপ। আল্লাহ তার নফল বা ফরয কিছুই কবুল করবেন না।’ [তাবরানী : ২১০৮]





আতা ইবন আবী রাবাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





«مَنْ حَفِظَنِي فِي أَصْحَابِي كُنْتُ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَافِظًا ، وَمَنْ سَبَّ أَصْحَابِي فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ».





‘যে আমার ছাহাবীদের ব্যাপারে আমাকে সুরক্ষা দেবে কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য সুরক্ষাকারী হব। আর ‘যে আমার ছাহাবীকে গাল দেবে তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ।’ [আহমাদ বিন হাম্বল, ফাযাইলুস ছাহাবা : ১৭৩৩][3]





আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,





لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابَ مُحَمَّدٍ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ ، فَلَمُقَامُ أَحَدِهِمْ سَاعَةً ، خَيْرٌ مِنْ عَمَلِ أَحَدِكُمْ عُمُرَهُ.





‘তোমরা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহাবীদের গালাগাল করো না। কেননা তাদের এক মুহূর্তের (ইবাদতের) মর্যাদা তোমাদের প্রত্যেকের জীবনের আমলের চেয়ে বেশি।’ [ইবন মাজা : ১৬২; আহমাদ বিন হাম্বল, ফাযাইলুস ছাহাবা : ১৫]





এ ব্যাপারে ইবন হাযম রাহিমাহুল্লাহর একটি মূল্যবান বাক্য রয়েছে, তিনি বলেন, ‘আমাদের কাউকে যদি যুগ-যুগান্তর ব্যাপ্ত সুদীর্ঘ হায়াত প্রদান করা হয় আর সে তাতে অব্যাহতভাবে ইবাদত করে যায়, তবুও তা ওই ব্যক্তির সমকক্ষ হতে পারবে না যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক সেকেন্ড বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য দেখেছেন।’ [ইবন হাযম, আল-ফাছলু ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল : ৩৩/২]





উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে আমরা জানলাম যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাহাবীদের প্রশংসা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের ওপর তাঁর সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ কর্তৃক তাঁদের স্তুতি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক তাঁদের ভূয়সী প্রশংসাই প্রমাণ করে যে তাঁরা হলেন ন্যায়নিষ্ঠ। সর্বোপরি আপন নবীর সঙ্গী ও তাঁর সহযোগী হিসেবে আল্লাহ যাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন তাঁদের তো আর কোনো ন্যায়নিষ্ঠতা প্রমাণের প্রয়োজন নেই। এর চেয়ে বড় আর কোনো সনদ হতে পারে না। এর চেয়ে পূর্ণতার আর কোনো দলীল হতে পারে না। [ইবন আবদিল বার, আল-ইস্তি‘আব ফী মা‘রিতিল আসহাব : ১/১]   





সব ছাহাবীরই একটা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান আর তা হলো তাঁদের কারও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। তাঁদের এ বিষয়ের  ফয়সালা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর দ্ব্যর্থহীন নানা বক্তব্য এবং উম্মাহর ইজমা বলতে যা বুঝায় সে সংখ্যক ব্যক্তির ইজমার মাধ্যমেও বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,





﴿ كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ ﴾ [آل عمران: ١١٠]


 ‘তোমরা হলে সর্বোত্তম উম্মত, যাদেরকে মানুষের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ {সূরা আলে-ইমরান, আয়াত : ১১০}





সকল তাফসীর বিশারদের মতে এ আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহাবীদের উদ্দেশ করে। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,





﴿ وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَٰكُمۡ أُمَّةٗ وَسَطٗا لِّتَكُونُواْ شُهَدَآءَ عَلَى ٱلنَّاسِ ﴾ [البقرة: ١٤٣]


 ‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী উম্মত বানিয়েছি, যাতে তোমরা মানুষের ওপর সাক্ষী হও।’ {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৪৩} আয়াতটি সে সময়ে থাকা সকল ছাহাবীকে সম্বোধন করেই নাযিল হয়। আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন, পূর্বেও যেটি উল্লেখ করা হয়েছে,





﴿ مُّحَمَّدٞ رَّسُولُ ٱللَّهِۚ وَٱلَّذِينَ مَعَهُۥٓ أَشِدَّآءُ عَلَى ٱلۡكُفَّارِ رُحَمَآءُ بَيۡنَهُمۡۖ ﴾ [الفتح: ٢٩]


 ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল এবং তার সাথে যারা আছে তারা কাফিরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; পরস্পরের প্রতি সদয়।’ {সূরা আল-ফাতহ, আয়াত : ২৯}





সুন্নাহর প্রতি দৃষ্টি দিলেও এ সংক্রান্ত হাদীসের অভাব নেই। যেমন বুখারী ও মুসলিম কর্তৃক উদ্ধৃত আবূ সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





« لاَ تَسُبُّوا أَصْحَابِى فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَكُمْ أَنْفَقَ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا أَدْرَكَ مُدَّ أَحَدِهِمْ وَلاَ نَصِيفَهُ ».





‘তোমরা আমার ছাহাবীদের গালমন্দ করো না। সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ। যদি তোমাদের কেউ উহুদ পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তবে তা তাদের এক মুদ বা তার অর্ধেকরও সমকক্ষ হতে পারবে না।’ [বুখারী : ৩৬৭৩; মুসলিম : ৬৬৫১]





অতঃপর সকল ছাহাবীর এমনকি ফিতনা তথা ছাহাবীগণের সময়কার বিভিন্ন ঘটনাবলী (যেমন: উষ্ট্রীর যুদ্ধ, সিফফীনের যুদ্ধ) যাদের স্পর্শ করেছিল সেসব ছাহাবীদের ক্ষেত্রেও তাদের ন্যায়নিষ্ঠতার ব্যাপারে উম্মতের ইজমা কায়েম হয়েছে। তেমনি আলিমদের মধ্যে এমন বৃহৎ সংখ্যার ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যাকে ইজমা দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়। ব্যতিক্রম ছাড়াই তাঁদের সবার ব্যাপারে সুধারণা করে এবং আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের যেসব মর্যাদা ও ফযীলতের কথা বলেছেন তার আলোকে এমন করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। আল্লাহ তাঁদের ব্যাপারে এ জন্যই ইজমা প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন যে তারা হলেন শরীয়তের বার্তাবাহী ও প্রচারকারী। [ড. নূরুদ্দীন ‘ঈতর সম্পাদিত মুকাদ্দামা ইবনু সালাহ, পৃষ্ঠা : ২৯৪]





তাঁদের যাবতীয় অপ্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত আল্লাহ কর্তৃক ন্যায়নিষ্ঠতার ঘোষণার পর তাই আর কোনো সৃষ্টি কর্তৃক তাঁদেরকে ন্যায়নিষ্ঠ ঘোষণার প্রয়োজন নেই। হ্যা, যদি কারো সম্পর্কে এমন কিছু করার প্রমাণ পাওয়া যায় যাকে পাপ আখ্যায়িত করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না কিংবা যা অন্য কোনো ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যাত হবার নয়, তখন তিনি ন্যায়নিষ্ঠতার গুণ থেকে বেরিয়ে যাবেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে এ থেকেও মুক্ত ঘোষণা করেছেন। আর তাঁদের মর্যাদা এমনই প্রশ্নাতীত যে তাঁদের মর্তবা সম্পর্কে যদি আয়াতগুলো নাযিল না করতেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোল্লিখিত হাদীসগুলো উচ্চারণ না করতেন, তথাপি তাঁদের হিজরত, জিহাদ, নুছরত, পদ ও প্রতিপত্তি ত্যাগ, পিতা ও পুত্রের বিরুদ্ধে লড়াই, দীনের জন্য অবর্ণনীয় কল্যাণকামিতা এবং ঈমান ও ইয়াকিনের দৃঢ়তা তাঁদের ন্যায়নিষ্ঠতা থেকে বিচ্যুত হওয়া ঠেকাত। তাঁদের পবিত্রতা ও মহানুভবতার পক্ষে সাক্ষী হত। মোদ্দাকথা তাঁরা তো সকল সত্যায়নকারী ও সাফাইকারীর চেয়েই শ্রেষ্ঠ যারা তাঁদের পর এসেছে। এটাই উল্লেখযোগ্য আলেম এবং ফিকহবিদের মত। [খতীব বাগদাদী, আল-কিফায়া ফী ইলমির রিওয়ায়াহ্ : ১১৮/১]





তাঁরাই সুন্নাহ সম্পর্কে বেশি জানতেন, কুরআনও সবচে ভালো বুঝতেন তাঁরাই। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের কাছে কুরআনের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন, এর অস্পষ্ট বিষয় তাঁদের সামনে স্পষ্ট করেছেন এবং এর কঠিন বিষয় তাঁদের জন্য সহজ করে বলেছেন। তাঁরাই এ কুরআনের তাফসীর সম্পর্কে সবচে বেশি জ্ঞাত। কারণ, তাঁরা কুরআন নাযিলের প্রেক্ষাপট তথা সময় ও অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। [ড. মুহাম্মদ আবূ শাহবা, আল-ইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত ফী কুতুবিত তাফসীর, পৃষ্ঠা : ৫২]





রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহাবীগণই প্রথম বর্ণনা করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসগুলো। (বেশিরভাগ সাহাবী) তাঁর জীবদ্দশায় তাঁরা হাদীসগুলো লিখেন নি বা সংকলন করেন নি, যেমন তাঁদের পরবর্তীতে তাবেয়ী আলেমগণ থেকে নিয়ে আমাদের পর্যন্ত বর্ণনাকারীরা সংকলন ও লিপিবদ্ধ করেছেন। কারণ, তাঁরা দীনের সাহায্য ও কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত ছিলেন। সেটিই তখন সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও আশু কর্তব্য ছিল। কেননা ইসলাম ছিল তখন দুর্বল আর এর অনুসারীরা ছিল সংখ্যায় কম। এ কারণেই তাঁদের ইবাদতে নিমগ্নতা ও জিহাদে ব্যস্ততা নিজেদের জীবিকার প্রতি তাকাতে দেয় নি। অন্য কোনো প্রয়োজনের প্রতি তাঁরা ভ্রুক্ষেপ করার ফুরসত পান নি। তাছাড়া তাঁদের মধ্যে নগণ্য কয়েকজন ছাড়া কেউ লিখতেও পারতেন না। তাঁরা যদি সে যুগেই হাদীস সংকলন করতেন তবে এর সংখ্যা আলেমদের বর্ণিত সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ হত। এ কারণেই আলেমগণ তাঁদের অনেকের ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন। অনেকে তাঁদের অনেককে ছাহাবীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন অনেকে তা করেন নি। ছাহাবীদের বিষয়, অবস্থা, বংশধারা ও জীবনী জানা তাই গুরুত্বপূর্ণ দীনী দায়িত্ব।





আর যার অন্তর রয়েছে বা যে নিবিষ্ট বিত্তে শ্রবণ করে তার কাছে এতে কোনো অস্পষ্টতা নেই, ইসলাম গ্রহণে অগ্রবর্তী আনসার ও মুহাজিরগণ- যারা মদীনাকে নিবাস হিসেবে গ্রহণ করেছেন এবং ঈমান এনেছেন, যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সরাসরি দেখেছেন, তাঁর বাণীসমূহ শুনেছেন, তাঁর অবস্থাদি প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাঁরা তা পরবর্তী সকল স্বাধীন-পরাধীন নারী-পুরুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাঁরাই সংরক্ষণ ও মুখস্তকরণে যোগ্যতর। তাঁরাই সেই দল যাদের ঈমানকে কোনো যুলম স্পর্শ করেনি। তাঁরাই নিরাপদ। নিরাপত্তা তাঁদেরই জন্য। আল্লাহর সাফাই আর তাঁর প্রশংসা সনদের মাধ্যমে তাঁরাই নিশ্চিত হিদায়াতপ্রাপ্ত। আর বিস্তারিত আহকাম এবং হালাল ও হারামের পরিচয়সহ শরীয়তের অন্যতম মৌলভিত্তি যে সুন্নাহর ওপর তা প্রমাণিত হয়েছে এর সূত্রসমূহ ও বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট অবগতির নিরিখে। বলাবাহুল্য এর প্রথম স্তরেই আছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সংস্পর্শ ধন্য ছাহাবীগণ। সুতরাং মানুষ যদি তাঁদের সম্পর্কে অজ্ঞতায় থাকে তবে অন্যদের বেলায় তো আরও অন্ধকারে থাকবে। অন্যদের কথাকে তো আরও তীব্রভাবে অস্বীকার করে বসবে। এ জন্যই প্রয়োজন তাঁদের বংশধারা জানা। তাঁদের অবস্থাদি সম্পর্কে অবগত হওয়া। তাঁদের এবং পরবর্তী সব বর্ণনাকারী  সম্পর্কেই সুস্পষ্ট অবগতি থাকতে হবে। যাতে নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আমল করা শুদ্ধ হয়। তা দিয়ে দলীল ও প্রমাণ প্রতিষ্ঠা হয়। কেননা অজ্ঞাত ব্যক্তির বর্ণনা গ্রহণ করা বৈধ নয়। সে অনুযায়ী আমল করাও সমীচীন নয়। শুধু ব্যক্তির ভালো-মন্দ যাচাই তথা ‘জারহ ওয়া তাদিল’ ছাড়া ছাহাবীগণ হাদীসের সত্যাসত্য যাচাইয়ের অন্য সব পর্যায়েই অন্যদের মতই। কারণ তাঁরা সবাই ন্যায়নিষ্ঠ, তাঁদের ন্যায়নিষ্ঠতা যাচাইয়ের কোনো অবকাশ নেই। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের ব্যাপারে সনদ দিয়েছেন। তাঁদেরকে ন্যায়নিষ্ঠ ঘোষণা করেছেন। আর তা একেবারে স্বতঃসিদ্ধ, এখানে যার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। [ইবনুল আসীর, উসুদুল গাবাহ : ১/১]





মুসলিমগণ এ ব্যাপারে একমত যে তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন চার খলীফা রাদিয়াল্লাহু আনহুম। তারপর জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজনের অবশিষ্ট ছয়জন, তারপর বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ, তারপর উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীগণ, অতপর হুদাইবিয়ায় বাইয়াতে রিদওয়ানে অংশগ্রহণকারী ছাহাবীগণ সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁদের সবার কথাই বলা হয়েছে নিম্নোক্ত হাদীসে। ইমরান বিন হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,





« خَيْرُ أُمَّتِى قَرْنِى ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ » . قَالَ عِمْرَانُ فَلاَ أَدْرِى أَذَكَرَ بَعْدَ قَرْنِهِ قَرْنَيْنِ أَوْ ثَلاَثًا « ثُمَّ إِنَّ بَعْدَكُمْ قَوْمًا يَشْهَدُونَ وَلاَ يُسْتَشْهَدُونَ ، وَيَخُونُونَ وَلاَ يُؤْتَمَنُونَ ، وَيَنْذُرُونَ وَلاَ يَفُونَ ، وَيَظْهَرُ فِيهِمُ السِّمَنُ » .





‘আমার উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো আমার প্রজন্মের লোকেরা, তারপর যারা আসবে তাদের পর, অতপর যারা আসবে তাদের পর।’ ইমরান বলেন, জানি না তিনি তাঁর প্রজন্মের পর দুই প্রজন্মের কথা বলেছেন না তিন প্রজন্মের কথা। ‘আর তোমাদের পরবর্তী যুগে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হবে যারা সাক্ষ্য দেবে অথচ তাদের কাছে সাক্ষ্য চাওয়া হবে না, তারা খেয়ানত করবে, তাদের কাছে আমানত রাখা হবে না, তারা প্রতিশ্রুতি দেবে কিন্তু তা রক্ষা করবে না। আর তাদের মধ্যে স্থূলতা দেখা দেবে।’ [বুখারী : ৩৬৫০]





তদুপরি ছাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিশয় মুহাব্বত করেছেন। তাঁকে সীমাহীন সম্মান ও ভক্তি করেছেন। তিনি ছিলেন তাঁদের কাছে সবচে প্রিয়। তাঁরা তাঁর বিচ্ছেদ সইতে পারতেন না। চলুন কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক :





সাইয়েদুনা আলী ইবন আবী তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করা হলো :  





كيف كان حبُّكم لرسول الله صلى الله عليه وسلم  ؟ قال : كان والله أحبّ إلينا من أموالنا وأولادنا وآبائنا وأمهاتنا , ومن الماء البارد على الظمأ





রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আপনাদের ভালোবাসা কেমন ছিল? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, তিনি আমাদের কাছে প্রিয়তর ছিলেন আমাদের সম্পদ, সন্তান ও পিতা-মাতা থেকে। তিনি আমাদের কাছে তীব্র পিপাসায় ঠান্ডা পানি চেয়েও বেশি প্রিয় ছিলেন। [কাযী ‘ইয়াদ, আশ-শিফা : ৫৬৭/২]  





‘আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,





وَمَا كَانَ أَحَدٌ أَحَبَّ إِلَيَّ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا أَجَلَّ فِي عَيْنِي مِنْهُ وَمَا كُنْتُ أُطِيقُ أَنْ أَمْلَأَ عَيْنَيَّ مِنْهُ إِجْلَالًا لَهُ وَلَوْ سُئِلْتُ أَنْ أَصِفَهُ مَا أَطَقْتُ لِأَنِّي لَمْ أَكُنْ أَمْلَأُ عَيْنَيَّ مِنْهُ





‘আমার কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বেশি প্রিয় কিংবা আমাদের দৃষ্টিতে বেশি সম্মানিত আর কেউ ছিলেন না। অধিক সম্মান ও মর্যাদার কারণে আমি তাঁর প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকানোর শক্তি রাখতাম না। আমি যদি তাঁর বিবরণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হই তবে তা আমি বর্ণনা করতে পারব না। কারণ, আমি কখনো পূর্ণ চক্ষু মেলে তাঁর দিকে তাকাতে পারি নি।’ [মুসলিম : ১৭৩]





হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় যখন উরওয়া ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহ আনহু স্বচক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছাহাবীদের পর্যবেক্ষণ করছিলেন, তখন তিনি কী বলেন? তিনি বলেন,





وَاللَّهِ مَا تَنَخَّمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نُخَامَةً إِلا وَقَعَتْ فِي يَدِ رَجُلٍ مِنْهُمْ، فَدَلَكَ بِهَا وَجْهَهُ وَجِلْدَهُ، وَإِذَا أَمَرَ ابْتَدَرُوا أَمَرَهُ، وَإِذَا تَوَضَّأَ كَادُوا يَقْتَتِلُونَ عَلَى وَضُوئِهِ، وَإِذَا تَكَلَّمَوا خَفَضُوا أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَهُ، وَمَا يُحِدُّونَ النَّظَرَ إِلَيْهِ تَعْظِيمًا لَهُ، فَرَجَعَ عُرْوَةُ إِلَى أَصْحَابِهِ، فَقَالَ: أَيْ قَوْمِ، وَاللَّهِ لَقَدْ وَفَدْتُ عَلَى الْمُلُوكِ، وَوَفَدْتُ عَلَى قَيْصَرَ، وَكِسْرَى، وَالنَّجَاشِيِّ، وَاللَّهِ إِنْ رَأَيْتُ مَلِكًا قَطُّ يُعَظِّمُهُ أَصْحَابُهُ مَا يُعَظِّمُ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ مُحَمَّدًا، وَاللَّهِ إِنْ تَنَخَّمَ نُخَامَةً إِلا وَقَعَتْ فِي كَفِّ رَجُلٍ مِنْهُمْ فَدَلَكَ بِهَا وَجْهَهُ وَجِلْدَهُ، وَإِذَا أَمَرَهُمُ ابْتَدَرُوا أَمَرَهُ، وَإِذَا تَوَضَّأَ كَادُوا يَقْتَتِلُونَ عَلَى وَضُوئِهِ، وَإِذَا تَكَلَّمُوا خَفَضُوا أَصْوَاتَهُمْ عِنْدَهُ، وَمَا يُحِدُّونَ النَّظَرَ إِلَيْهِ تَعْظِيمًا لَهُ،





‘আল্লাহর শপথ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই থুথু ফেলছেন তা তাদের কেউ না কেউ হাতে নিয়ে নিচ্ছে। তা নিজের চেহারা ও চামড়ায় মালিশ করছে। যখন তিনি আদেশ দিচ্ছেন, তাঁরা তাঁর আদেশ পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তিনি অযূ করলে তার অযূর অবশিষ্ট পানি নিতে গিয়ে পরস্পর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। যখন তারা কথা বলছে তাঁর সামনে স্বর নিচু করছে। তাঁর প্রতি অতি সম্মানবশত সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারছে না। অতপর উরওয়া তাঁর সঙ্গীদের কাছে ফিরে যান। সেখানে তিনি বলেন, হে আমার সম্প্রদায়, আল্লাহর শপথ, আমি অনেক রাজা-বাদশাহের কাছে সফর করেছি। সফর করেছি পারস্য সম্রাট কিসরা, রোম সম্রাট কায়সার ও হাবসার বাদশা নাজাশীর দরবারে। শপথ আল্লাহর, আমি এমন কোনো রাজাকে দেখি নি যে তার সহচরগণ তাকে এতটা সম্মান করছেন যতটা সম্মান করে মুহাম্মদের সঙ্গীগণ মুহাম্মদকে। আল্লাহর কসম, তিনি থুথু ফেললেই তা তাদের কারও হাতের তালুতে গিয়ে পড়ছে। অতপর সে তা নিজের চেহারা ও গায়ে মাখছে। যখন তিনি তাদের আদেশ দিচ্ছেন, তাঁরা তাঁর নির্দেশ পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তিনি অযূ করলে তার অযূর অবশিষ্ট পানি নিতে গিয়ে রীতিমত যুদ্ধে লিপ্ত হবার উপক্রম হচ্ছে। যখন তারা কথা বলছে তাঁর সামনে স্বর নিচু করছে। তাঁর প্রতি অতি সম্মানবশত সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে পারছে না।’ [তাবরানী : ১৬৪৪৫]





এ কারণেই তাঁরা আল্লাহর প্রশংসা এবং নিজেদের সম্পর্কে আয়াত নাযিলের যোগ্য হয়েছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,





﴿ لِلۡفُقَرَآءِ ٱلۡمُهَٰجِرِينَ ٱلَّذِينَ أُخۡرِجُواْ مِن دِيَٰرِهِمۡ وَأَمۡوَٰلِهِمۡ يَبۡتَغُونَ فَضۡلٗا مِّنَ ٱللَّهِ وَرِضۡوَٰنٗا وَيَنصُرُونَ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥٓۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ٨ وَٱلَّذِينَ تَبَوَّءُو ٱلدَّارَ وَٱلۡإِيمَٰنَ مِن قَبۡلِهِمۡ يُحِبُّونَ مَنۡ هَاجَرَ إِلَيۡهِمۡ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمۡ حَاجَةٗ مِّمَّآ أُوتُواْ وَيُؤۡثِرُونَ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ وَلَوۡ كَانَ بِهِمۡ خَصَاصَةٞۚ وَمَن يُوقَ شُحَّ نَفۡسِهِۦ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ٩ ﴾ [الحشر: ٨،  ٩]





 





 



Recent Posts

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ...

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবদান

জাবালে ‘আরাফা (জাবালে ...

জাবালে ‘আরাফা (জাবালে রহমত)

মুসলিম নারীর অবশ্য পা ...

মুসলিম নারীর অবশ্য পালনীয় কতিপয় আমল